Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের শিক্ষানীতি এবং ঝরে পড়া শিশুরা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য কি দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানীতির প্রণেতারা নিশ্চয়ই তা জানেন। তবে আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার সামাজিক, আত্মিক, অর্থনৈতিক লক্ষ্য সুস্পষ্ট নয়। এক-এগারো পরবর্তি মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকটা তড়িঘড়ি করেই একটা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যেখানে স্বাধীনতার পর চার দশকেও জাতির জন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য শিক্ষানীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, সেখানে এই সরকারের শিক্ষানীতি কে মন্দের ভাল হিসেবেই সর্বমহল গ্রহণ করেছিল। গ্রহণ করেছিল বলছি এই অর্থে যে, গৃহিত শিক্ষানীতি সম্পর্কে নাগরিক সমাজ বা কোন রাজনৈতিক পক্ষের কোন প্রতিবাদ বা অবস্থান দেখা যায়নি। ইতিপূর্বে গত ৪ দশকে ১৯৭৪ সালের ড.কুদরাতই -খুদা নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন থেকে ২০০৩ সালের ড. মনিরুজ্জামান মিয়ার জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন পর্যন্ত অন্তত ৬টি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ইংরেজের ১৯০ বছরের শাসনামলে ১৭৭২ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ৯টি শিক্ষাকমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সময়ে সময়ে শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও ১৯৪৯ সালের মাওলানা আকরম খাঁ কমিশন থেকে ১৯৭০ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন পর্যন্ত রিপোর্টগুলোর প্রায় সবগুলোই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও বাংলাদেশ আমলে গৃহিত রিপোর্ট ও প্রতিবেদন সম্পর্কে দেশের শিক্ষাবিদরা মতাদর্শ ও রাজনৈতিকভাবে একমত হতে না পারায় কোন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। সত্যিকার অর্থে শিক্ষানীতি নির্ধারণ বিষয়ক এসব রিপোর্ট জাতীয় স্বার্থ ও লক্ষ্যের নিরীখে অসম্পুর্ণ ও অপর্যাপ্ত। ২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল তা’ও অপূর্নাঙ্গ ও অপর্যাপ্ত বলা চলে। শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য ও মৈালিক দিক নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে নতুন স্তরবিন্যাস, অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। শিক্ষানীতির সেই রিপোর্টটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ণের উদ্যোগ নেয়া হলেও হয়তো শিক্ষাব্যবস্থার চলমান বিশৃঙ্খলা, সার্টিফিকেট সর্বস্ব বাণিজ্যিকায়ণ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় এমন অধ:পতন ঘটত না।
নানা ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈষম্যমুক্ত করা আমাদের শিক্ষানীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হওয়ার কথা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে মুনাফাবাজি, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, নোটবই-গাইডবই বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের জন্য দুর্মূল্য করে ফেলা হয়েছে পুরো সমাজব্যবস্থায় তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার সে নিশ্চয়তা পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। শিক্ষাবোর্ড নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের আওতায় পরিচালিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটি পাবলিক পরীক্ষায় সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক ভাল ফলাফল করার মধ্য দিয়ে সে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামিদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। বোর্ড পরীক্ষায় শতভাগ পাস ও শত শত জিপিএ-৫ পাওয়ার অলিখিত গ্যারান্টির জন্য সব অভিভাবকরা এসব বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং যেনতেন প্রকারে, প্রচুর টাকা খরচ করে ভর্তি কোচিং করিয়ে, মোটা অংকের ডোনেশনের বিনিময়ে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে জাতে উঠার আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এভাবেই তথাকথিত নামিদামী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছে এবং জয়যাত্রা চলছে। পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ পাস ও উচ্চগ্রেড নিশ্চিত করতে ওরা শিক্ষার্থীদের উপর অমানুসিক নির্যাতন করছে এবং অভিভাবদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের চেয়ে কোনমতে একটি জিপিএ-ফাইভ পাইয়ে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জাত রক্ষা এবং অভিভাবকদের স্বপ্ন পুরণের বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু জরিপে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, জিপিএ-ফাইভ বা গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী মাতৃভাষা, ইংরেজী এবং গণিতের মত বিষয়ে নুন্যতম দক্ষতা অর্জনেও ব্যর্থ হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উচ্চ গ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বেশীরভাগের লক্ষ্য থাকে সরকারী মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পসন্দনীয় বিষয়ে আগ্রহী থাকে। একইভাবে বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করা যাতে তারা খুব সহজেই চাকুরীর বাজারে প্রবেশ করতে পারে। তবে শুধুমাত্র সার্টিফিকেটের গ্রেডকে পুঁজি করে মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিশ্চয়তা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। পক্ষান্তরে অনেক কাঠখড় পুরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ডিগ্রী অর্জনের পর সোনার হরিণ চাকুরীর নিশ্চয়তা এখন আকাশ কুসুম। তাহলে এই শিক্ষানীতি এই শিক্ষাবাণিজ্যের লক্ষ্য কি শুধুমাত্র এমপিও বাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, প্রশ্নপত্র বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, সর্বোপরি একটি মুনাফাবাজ শ্রেনীর পকেট ভারী করা?
গত রবিবার থেকে সারাদেশের স্কুল-মাদরাসার শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। সোমবারে প্রকাশিত খবর হচ্ছে, এবারে পিইসি পরীক্ষায় রেজিস্ট্রিকৃত অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল (৩০ লাখ ৯৫ হাজার ১২৩জন) প্রায় ৩১ লাখ। প্রথমদিনের পরীক্ষায় এদের মধ্যে দেড়লাখের বেশী (১ লাখ ৬০ হাজার ১৬৮জন) শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। অভিভাবকদের পকেট থেকে বছরে হাজার হাজার টাকা খরচ করে, শৈশবের আনন্দময় সময়গুলো স্কুলে-কোচিংয়ে ব্যয় করে ৬ বছর ধরে স্কুল-মাদরাসায় পড়ালেখা করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী কেন জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা থেকে ছটেকে পড়ল? পাবলিক পরীক্ষার প্রস্তুুতি একদিকে অস্বাভাবিক ব্যয়সাধ্য করে তোলা হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিপ্রদ করে তোলা হয়েছে বলেই লাখ লাখ শিশু পাবলিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। অথবা তথাকথিত নামিদামী স্কুলগুলো নিজেদের শতভাগ পাসের হার নিশ্চিত রাখতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছে কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমদিনের পরীক্ষায় দেড় লক্ষাধিক শিশুর অনুপস্থিতির সাথে পরবর্তি পরীক্ষাগুলোতে আর কত সংখ্যক শিশু পরীক্ষা থেকে ঝরে পড়ে তা দেখার বিষয়। পাবলিক পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার নেপথ্যে যে সব কারণই থাক না কেন, দশ-বারো বছর বয়েসী শিশুটি জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা থেকে ছিটকে পড়ার মনস্তাত্তিক প্রভাব সুদূর প্রসারি হতে বাধ্য। এ বয়েসী শিশুরা অনেক বেশী আবেগ প্রবণ ও জেদি হয়ে থাকে। এটা নি:সন্দেহে বলা যায়, এসব শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক বড় ধাক্কা খেল। লাখ লাখ পরিবার তাদের সন্তানদের নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাক্রান্ত হল। এর আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়াও বিশেষ গুরুত্ববহ। আর যারা পরীক্ষায় অংশগ্রণের পর কাঙ্খিত জিপিএ থেকে বঞ্চিত হবে, যারা নামি-দামি স্কুলে কোচিং বাণিজ্য ও মেধাবৃত্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে তাদের বেশীরভাগই ব্যর্থতার স্বপ্নভঙ্গ ঘটবে। একটি শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের জন্য এমন আত্মবিদ্ধংসী সুযোগ রাখার কি যুক্তি থাকতে পারে! বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেক নাগরিককে স্বাক্ষরতা অর্জন ও পড়তে-লিখতে সহায়তা করা এবং এদের ঝরে পড়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক আশঙ্কা দূর করার ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সবর্শেষ শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ৮ বছর, অর্থাৎ অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত। তা ছাড়া দুই দশক আগে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সূচনা লগ্ন থেকেই এই পরীক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছেন দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক সমাজের অনেকে। পঞ্চম শ্রেনীতে সাড়ম্বরে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণের কারণে গ্রামাঞ্চলের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা কিছুটা চাপে পড়ে শিশুদের শিক্ষার প্রতি দায়িত্বশীল হতে বাধ্য হচ্ছেন বলে কেউ কেউ যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। তবে নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেনীতে উন্নীত করার পরও কেন পঞ্চম শ্রেনীতে একটি পাবলিক পরীক্ষায় ঠেলে দিয়ে শিশুদেরকে বড় ধরনের মনস্তাত্তি¡ক চাপে রাখা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের বিনিময়ে বাড়তি কোচিং এবং যেনতেন প্রকারে পাসের হার ও গ্রেড বাড়ানোর প্রতিযোগিতা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারলে এবং পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাথমিক পাবলিক পরীক্ষাকে শিশুদের জন্য আরো সহজ ও আনন্দময় করা গেলে হয়তো এ স্তরের পাবলিক পরীক্ষার একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হতো। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্তে¡ও অতিরিক্ত ব্যয় এবং নিরানন্দ পাঠ্যব্যবস্থার কারণে প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশুদের ঝরে পড়ার উচ্চ হার রোধ করা যাচ্ছে না।
প্রত্যেক জাতির স্বপ্নদ্রষ্টারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রামের নানা মাত্রিক পথ রচনা করেছেন। সেই সাথে প্রত্যাশিত স্বাধীন রাষ্ট্রের মানোজাগতিক ঔৎকর্ষ এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ভবিষ্যত রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ভেবেছেন। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিজস্ব রাষ্ট্রদর্শন এবং শিক্ষাদর্শন ছিল। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিক সমাজের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক চাহিদা ও লক্ষ্য অনুসারে গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির শিখরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের স্বর্ণযুগে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোরানিক অনুশাসন মেনে চলার মধ্য দিয়ে দিগি¦জয়ী মুসলিম শাসকরা ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বৃটিশরা এ দেশের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও লোকজ ঐতিহ্যের ধারার বিপরীতে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল। সে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের সহায়ক জনশক্তি হিসেবে কিছু ইংরেজী শিক্ষিত কেরানী সৃষ্টি করা। সেখানে নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা ছিল অনুপস্থিত। এরপরও ইংরেজী শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক, লোকজ ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণে ভবিষ্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টারা আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল ও নজরুল ইসলামের নিজস্ব রাষ্ট্র ও শিক্ষাদর্শনে নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ, লোকজ সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল। শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটি ব্যাপক ভিত্তিক আলোচ্য বিষয়। খুব স্বল্প পরিসরে এই লক্ষ্য তুলে ধরা সহজ নয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা চাই আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিকে ক্রমেই সজাগ ও জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসেবে ‘ডানপিটে’ ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পুর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না;আর যাহার জান নাই, সে মোর্দা দিয়ে কোন কাজই হয় নাই আর হইবেও না।এই দুই শক্তি, প্রাণশক্তি আর কর্মশক্তিকে একত্রীভ’ত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।” নজরুলের এই শিক্ষাচিন্তা আমাদের আজকের বাস্তবতায় খুবই প্রাসঙ্গিক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা একটি নির্জীব (নজরুলের ভাষায়, মেদা-মারা)প্রজন্ম গড়ে উঠছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদেরকে সারাদিন-সারাক্ষণ কিছু গৎবাঁধা পাঠ্যসূচিতে আটকে রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের শারিরীক, মানসিক বিকাশ, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ এবং জাতিসত্তার উন্নয়নের মন্ত্র এই শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। উপরন্তু শিক্ষাকে একশ্রেনীর শিক্ষক, বিনিয়োগকারী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনের উর্বর ক্ষেত্রে পরিনত করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই চলছে শিক্ষাবাণিজ্যের অনৈতিক প্রতিযোগিতা। শিক্ষাকে মুনাফাবাজি ও অনৈতিক প্রতিযোগিতামুক্ত করতে না পারলে তা কখনো বৈষম্যমুক্ত করা সম্ভব হবে না। নতুন শিক্ষানীতিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত হলেও পঞ্চমশ্রেনীতে একটি অপ্রয়োজনীয় পাবলিক পরীক্ষা বহাল রেখে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে কোচিংম সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও মুনাফাবাজির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। পাঠ্যসূচিতে নতুন নতুন বিষয় ও বইয়ের বোঝা না বাড়িয়ে শিশুদের জন্য খেলা-ধূলা ও বাস্তব জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরী মাঠ ও শৈশবের আনন্দ ও নির্মল চিন্তা ও মননশীল হয়ে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা-জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় লাখ লাখ শিশু পরীক্ষায় অংশ্রগহণ করতেই ভয় পায়, তেমন শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাবলিক পরীক্ষা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে মানসম্পন্ন, বাধ্যতামূলক গণমুখী অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। অশিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূর করার পাশাপাশি প্রশিক্ষিত জাতিগঠন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরীখে এ ধরনের বাধ্যতামূলক শিক্ষার স্তর বা সময় আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে।’ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্যের নিরীখে জাতি গঠনে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছিল। হত ৪৭ বছরেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্র গঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনুকুল করে গড়ে তোলতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায় বহন করছে পুরো জাতি। আজকে আমাদের সমাজে যে সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ঘটেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লুণ্ঠন, দখলবাজি, মাদকের আগ্রাসন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও জননিরাপত্তায় যে অমানিশা ভর করেছে, রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচারাদালত থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনের যে অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও বিদেশে পাচারের মচ্ছব চলছে তার জন্য মূলত আমাদের অথর্ব শিক্ষাব্যবস্থাকেই দায়ী করা যায়। রাষ্ট্র ও সমাজকে এই অবক্ষয়ের গহŸর থেকে টেনে তুলতে হলে প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবন জীবিকা ও নৈতিক-আত্ম্যাত্মিক মানদন্ডে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বৈষম্যহীন, মুনাফাবাজি ও অনৈতিক প্রতিযোগিতামুক্ত রাখার বাস্তব সম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজে, রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে দলবাজী, দখলবাজী, ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবক্ষয়- অনৈতিক ধারা চলছে, তা থেকে জাতিকে মক্ত করে একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে মুনাফাবাজিমুক্ত, বৈষম্য ও রাজনৈতিক দলীয়করণ থেকে মুক্ত করতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশু

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন