শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২)-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী সমাজের অর্ন্তভ‚ক্ত। মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বহীন সময়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা একটি বিষ্ময়কর ঘটনা। এ সময়ে মুসলমান লেখকগণ ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসিত। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বর্জন করছিলেন। ফলে, তারা মধ্যযুগের একঘেয়ে সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দো-ভাষী পুঁথি রচনা করেই ছিলেন তৃপ্ত। তাদের মধ্যে নবজাগরণের বিশ্বপ্রতীম মানবিক বোধবুদ্ধি ও জিজ্ঞাসা ছিল না। এই সর্বপ্লাবী সাহিত্যশিল্পের জয়যাত্রার জোয়ারের মুখে মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ করেন ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি অবনমিত মুসলিম সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলেন।
মীর মশাররফ হোসেনের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে, তিনি দো-ভাষী পুঁথির মিশ্র ভাষারীতি থেকে বেরিয়ে এসে এক ধরনের বিশেষ শালীন সাধুগদ্যের চর্চা শুরু করেন। মাইকেল যেমন কবিতায় রামায়ণের কাহিনি নিয়ে এক অপরূপ ট্র্যাজেডি ‘মেঘনাদ বধ’ রচনার মধ্য দিয়ে পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিলেন তেমনি মীর মশাররফ গদ্যে কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ট্র্যাজেডি রচনার মাধ্যমে ইতিহাসের নবজন্ম দান করলেন।
পাশ্চাত্য ভাবধারাপুষ্ট সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ যে সময়ে রস-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে চলেছেন, সে সময়ে মীর মশাররফ হোসেন ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম গদ্য লেখককে সাহিত্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর রচনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্য-ইতিহাস এবং পুঁথি সাহিত্যকে প্রাধান্য দান করলেও তার সৃষ্ট সাহিত্যে প্রচার ধর্মিতার কোন ছাপ নেই। ইসলামী ভাবধারার উজ্জীবন অপেক্ষা সমাজের দোষ-ক্রটি উদ্ঘাটন এবং জীবন চিত্রাঙ্কনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি বেশি নিবন্ধ ছিল। এ কারণে তাঁর সাহিত্য মুসলমান-হিন্দু সকলের কাছে ছিল জনপ্রিয়। তাঁর মত একজন হৃদয়বান এবং মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন সাহিত্যিকের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস, নাটক, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস, ধর্মতত্ব, কাব্য সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ক ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। কাঙাল হরিণাথ তাঁর সাহিত্য গুরু। ছাত্রজীবনেই তার লেখা ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘গ্রাম বার্তায়’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘রত্মাবতী’ (১৮৬৯), ‘বিষাদসিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০), ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ‘রত্নাবতী’ (১৮৬৯) মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম গ্রন্থ। ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস’ নামে চিহ্নিত এটি লেখকের মৌলিক সৃষ্টি, কোন গ্রন্থ বিশেষের অনুবাদ নয়। ‘রত্নাবতী’র সাফল্য তার ভাষার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। বক্তব্য কিংবা বিষয় গৌরবে নয়, মূলত ভাষার সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার প্রশ্নেই স্বীকৃতি ও প্রশংসা মিলেছে। আধুনিককালে মুসলিম রচিত সাহিত্য ধারায় মার্জিত, পরিশীলিত ও বিশুদ্ধ বাংলা গদ্যভাষা প্রয়োগ ও মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিষাদান্তক মর্মন্তুদ কারবালার কাহিনি অবলম্বনে গ্রন্থটি তিনটি খণ্ডে রচিত। মহরম পর্ব (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), এজিদবধ পর্ব (১৮৯১)। গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক দাবী করেছেন, ‘পারস্য ও আরব্য গন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদ সিন্ধু’ বিরচিত হইল।’
‘বিষাদ সিন্ধু’ একটি মহাকাব্যপোম বৃহদাকার উপন্যাস। এ প্রসঙ্গে ক্ষেত্র গুপ্ত বলেছেন, ‘বাংলায় মহাকাব্যিক কিছু অবশ্যই আছে। কিন্তু খাঁটি মহাকাব্যের কাছাকাছি উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। ‘বিষাদ সিন্ধু’ গদ্যে লেখা মহাকাব্য এবং একটি ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্স।’ ‘বিষাদ সিন্ধু’র ‘মহরম পর্বে’ বর্ণিত হয়েছে দামেষ্ক অধিপতি মাবিয়াপুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তি, ব্যর্থতা এবং তার পরিণাম। হাসান পত্নী জয়নবকে সে করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি। এ ব্যর্থতার সূত্রে হাসানের প্রতি সে বৈরিতা পোষণ করে এবং তার ষড়যন্ত্রে কৌশলে হাসানকে জীবন দিতে হয় এবং অবশেষে কারবালা প্রান্তরের এক অসম যুদ্ধে হাসান নৃশংসভাবে নিহত হন। ‘উদ্ধার পর্বে’র কাহিনী অংশে আছে বিপন্ন হোসেন পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষাকারী এবং ক্রোধান্ধ দুর্জয় মহাবীর মোহাম্মদ হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের বিবরণ। শেষ খণ্ড ‘এজিদবধ’ পর্বে বর্ণিত হয়েছে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা, এজিদের ভ‚গর্ভস্থ গুপ্ত কক্ষে পলায়ন ও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নারকীয় কষ্টভোগ, দৈব নির্দেশে বহু পাণ ক্ষয়কারী আবু হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হোসেন বংশধর জয়নাল আবেদীনের রাজ্যলাভের অবশ্যম্ভাবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আমরা ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী জানতে পারি, এজিদের সঙ্গে হাসান-হোসেনের বিরোধ মূলত রাজনৈতিক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, কিন্তু ‘বিষাদ সিন্ধু’তে এই বৈরিতার মূল কারণ হিসেবে এজিদের জয়নব লাভের তীব্র কামনাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ উপন্যাসের এজিদ চরিত্র শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের সমান্তরাল। তার চরিত্র সৃষ্টির কারণেই মায়মুনা, সীমার ইত্যাদি চরিত্র কেবল উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যেই বন্দি থাকেনি। এরা রীতিমতো বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপন্যাসে বিষাদের যে উত্তাল তরঙ্গমালা সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে একটি মাত্র কারণ কাজ করেছে তা হলো জয়নবের প্রতি এজিদের যে প্রণয় সে প্রণয়ের তীব্র-তীক্ষ্ন যন্ত্রণায় এজিদ নামদারের মতো একজন শাসক এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত, সে প্রণয়ই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে গেছে। এককালে বাঙালি মুসলমানদের গৃহে ‘বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থটি ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদায় সংরক্ষিত ও পঠিত হতো।
‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ মীর মশাররফ হোসেনের আত্মকথা যা নিরেট উপন্যাস না বলে একে উপন্যাসের আদলে মশাররফের শ্রুতি স্মৃতিনির্ভর বাস্তব ঘটনার আলেখ্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। মুনীর চৌধুরী এটিকে ‘মশাররফের আত্মজীবনীমূলক রচনা’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মীর মশাররফ হোসেনের ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ দু’টি স্বতন্ত্র ধরা এ গ্রন্থের অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও এর প্রধান আকর্ষণ মীর সাহেবের পিতা-মাতার দাম্পত্য জীবন ও তাঁর নিজের শৈশব জীবনের কাহিনী। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ না গাঢ়বন্ধ উপন্যাস, না যথার্থ আত্মজীবনী। উভয়ের সংমিশ্রণে এটি একটি শংকর সৃষ্টি। তবে মানুষের জীবনে ছোট-বড় নানা ঘটনা একটি সংবেদনশীল মনের ছোঁয়ায় কাহিনী আকারে প্রবাহিত হয়ে গেছে বলে ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’কে শ্লথ বিন্যস্ত উপন্যাস বলা যায়। এ উপন্যাসের কাহিনীর একদিকে রয়েছে নীলকর টি আই কেনীর সঙ্গে সুন্দরপুরের মহিলা জমিদার প্যারী সুন্দরীর দ্বন্দ্ব, রায়ত প্রজার উপর কেনীর অত্যাচার-নিপীড়ন, নীলবিদ্রোহ ও কেনীর পরিণতি। কাহিনির দ্বিতীয় ধারাটি গড়ে উঠেছে মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেনের সঙ্গে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী পতি সা গোলামের তিক্ত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোয়াজ্জম হোসেনের দাম্পত্য জীবনের ঘটনা। আর এ দু’ধারার যোগসূত্র স্থাপন করেছেন মোয়াজ্জম হোসেন।
‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ বাস্তব ঘটনার পটভ‚মিকায় রচিত একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। এ উপন্যাসের কাহিনি ও স্থান-কাল-পাত্র বাস্তবভিত্তিক। কেনী, প্যারী সুন্দরী, মীর মোয়াজ্জম, সা গোলাম এসব প্রধান পাত্র-পাত্রী আঞ্চলিক ইতিহাসের অন্তর্গত বাস্তব ভ‚মিতেই আবির্ভূত। তবে ‘চরিত্র নির্মাণ অপেক্ষা কাহিনি বর্ণনাতেই মশাররফের মনোযোগ অধিক নিবিষ্ট ছিল বলে চরিত্রগুলো পূর্ণবায়ব লাভ করেনি।’ তথাপিও এ গ্রন্থখানি নানা কারণে উল্লেখের দাবী রাখে। বিশেষত এ গ্রন্থে বিবৃত নীলচাষ ও প্রজা আন্দোলনের কাহিনি আঞ্চলিক ইতিহাসের অন্তর্গত বাস্তব ভ‚মিতেই আবিভর্‚ত। তবে ‘চরিত্র নির্মাণ অপেক্ষা কাহিনি বর্ণনাতেই মশাররফের মনোযোগ অধিক নিবিষ্ট ছিল বলে চরিত্রগুলো পূর্ণাবয়ব লাভ করেনি।’ তথাপিও এ গ্রন্থখানি নানা কারণে উল্লেখের দাবী রাখে। বিশেষত এ গ্রন্থে বিবৃত নীলচাষ ও প্রজা আন্দোলনের কাহিনি আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ হলেও বৃহদার্থে তা জাতীয় ইতিহাসেরই অঙ্গ। এ উপন্যাসে মশাররফের সমাজ সচেতন শিল্পি মানসের গভীর পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মূলত পরস্পর সম্পর্কিত কয়েকটি সামন্ত পরিবারের ঈর্ষা ও স্বার্থকেন্দ্রিক অন্তর্কলহ এবং তাদের অন্তপুরের পাপ ও লজ্জার গুপ্ত কথার ব্যাঙ্গাত্মক চিত্রধর্মী কাহিনি। অর্থ-বিত্ত-সামাজিক মর্যাদা বংশকৌলীন্যে শ্রেষ্ঠ ও শ্রদ্ধেয় অভিজাত উচ্চ শ্রেণির নৈতিক স্খলন-পতন, স্বার্থ-প্রবঞ্চনা ও লালসা-লোভের বিচিত্র ও আপাত-অবিশ্বাস্য কাহিনি পরিবেশনই লেখকের মূল অভিপ্রায়।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে মুখ্যত দু’টি সমান্তরাল কাহিনি বিবৃত : কৃঞ্জ নিকেতনের কুট-কৌশলী ভ‚মি অধিকারিণী পয়জারননেসা ওরফে বেগম ঠাকরুণের বেপরোয়া অনৈতিক জীবন-যাপন এবং অপর পক্ষে জমদ্বারের জমিদারীর দুটি প্রতিপক্ষ শরিক সোনাবিবি ও মনিবিবির দ্ব›দ্বকলহ, পাপাচার ও পরিণামের আখ্যান। এই দুটি কাহিনীর সূত্রে গ্রথিত হয়েছে একাধিক শাখা কাহিনি। মানব চরিত্রের মন্দ ও অন্ধকার দিকগুলোই এই উপখ্যানে বিধৃত। মহৎ জীবনাদর্শ, সুরুচি-শালীনতার শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি-কৃতজ্ঞতার মানসিক গুণাবলী ‘বস্তানী’র মানব-মানবীর জীবনে অনুশীলিত হয়নি। তাই রমণীর সতীত্ব দানে সানন্দ সম্মতি লোকনিন্দা উপেক্ষা করে উপপতির মনোরঞ্জন, পুত্রের হাতে গর্ভধারিণীর লাঞ্ছনা, নির্বিচার ল্যাম্পট্য ক্রীড়ায় নিত্য তৃপ্তি, ন্যায়ালয়ের প্রতিনিধির অনাচার, অর্থের কাছে বিবেক-বিশ্বাস-মনুষ্যত্ব বিসর্জন, সংকোচনহীন কৃতঘ্নতা-এসব ঘটনা স্বাভাবিক জীবনযাপন ও জীবনাচরণের অঙ্গ হিসেবেই প্রকাশিত। প্রকৃতপক্ষে ‘এক ক্লেদাক্ত পরিবেশের বিবেকশূন্য, নীতি-বিবর্জিত, অসৎ ও চরিত্রহীন মানুষের কাহিনি এই ‘বস্তানী’।
প্রকৃতপক্ষে ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মশাররফের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এক অবাঞ্ছিত অন্ধকার জগতের কাহিনি। মূল্যবোধহীন ফাঁপা এ সমাজের অকল্পনীয় কুৎসিত জীবনাচরণ ও ভোগসর্বস্ব জীবনদর্শনের কাহিনি এ গ্রন্থ। অর্থ ও অভিজাত্যও সেই নারকীয় ভুবনের কর্মকাণ্ডকে প্রলেপ দিতে বা প্রচ্ছন্ন রাখতে পারেনি। উদ্ভট ও আপাত-হাস্যকর-নামকরণের অন্তরালে প্রকৃত পাত্র-পাত্রী বা স্থানের নাম গোপন করা হলেও মীরের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিতে এরা বাস্তব ও জীবন্ত। যে কোন কারণেই হোক মীরকে এই পরিবেশ ও তার অন্তর্গত অধিবাসীদের প্রতি বিরূপ ও বিক্ষব্ধ হতে হয়েছিল। আক্রান্ত মশাররফ তাই ভয়স্কর এক স্থায়ী প্রতিশোধ গ্রহণের মানসে শিল্পের শক্তি দিয়ে তার প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন। তবে নানা ত্রুটি, অসঙ্গতি ও সীমাবদ্ধতা সত্তেও ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ কালের দর্পণ এবং মশাররফের প্রচলিত শিল্পভ‚বনের বাইরে স্বতন্ত্র শিল্পরীতির নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।
পরিশেষে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, একটি বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস রচনায় শিল্পী-চৈতন্যে যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন তার প্রেক্ষিতেই পুঁথি সাহিত্যের গন্ডি পেরিয়ে আধুনিক জীবন-সাহিত্যে পদার্পণের দরজা উম্মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি ইতিহাসকে তার শিল্প কুশলতার মাধ্যমে নবরূপদানে সক্ষম হয়েছেন। তিনি উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভাষা-বৈশিষ্ট্যের সর্বাধিক সিদ্ধি ও সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।