পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানুষ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল আবাস, বন্দর, ব্যবসাকেন্দ্র ও হাটবাজার। যোগাযোগের জন্য অধিকতর সুবিধা হওয়ায় নদীর পারে গড়ে ওঠা হাটবাজার। কিন্তু প্রবাহিত স্রোতস্বিনী নদীগুলোকে আমরা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। যার দরুন নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদ এখন পরিত্যক্ত হতে চলেছে। নদীতে এক সময় পাল তোলা নৌকার মনোরম দৃশ্য চোখে পড়তো। নদী দিয়ে বড় বড় পাল তোলা নৌকায় ব্যবসায়ীরা মামালাল পরিবহন করতো। পালের সাথে ছিল গুণ টানার জন্য শক্তিশালী এবং দক্ষ মাঝি। বাতাসকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন নদী বন্দরে মালামাল পরিবহন করতো। বাতাস কমে গেলে গুণ টেনে টেনে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতো গন্তব্যে। ইঞ্জিন আসার পর নৌকাগুলো যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। অদৃশ্য হয়েগেছে পালের নৌকা। এখন আগের সেই নদীও নেই আর পাল তোলা নৌকার অপরূপ দৃশ্যও চোখে পড়ে না। আমাদের কৃষি প্রধান দেশে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই কৃষির সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। নদী থেকে অনেক শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত হয়ে সাপের মতো এঁেকঁেবকে অনেক খাল প্রবাহিত হয়েছে। অনেক কৃষক সরাসরি নদীর দেখা না পেলেও খালের পানিকেই সেচের জন্য বড় ধরনের নিয়ামত হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। নদী বেঁচে থাকলে খালগুলো সচল থাকে। আর কৃষিতে বড় ধরনের সেচ সুবিধা প্রদান করা যায়। কৃষি সচল থাকলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আশির দশকের পর দেশে তেমন খাল খনন কর্মসূচি চোখে পড়েনি। সামান্য কিছু খাল খনন শুরু হলেও তার ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি। নদীগুলো আস্তে আস্তে মৃতপ্রায় হয়েগেছে। ইতোমধ্যে দেশের অর্ধেক নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। যে নদী দিয়ে এক সময় স্রো বয়ে যেতো তা এখন শুকিয়ে বালুময় ধূলি- ধূসরিত হয়ে পড়েছে। স্রোতস্বিনী নদীগুলো দিয়ে এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। বর্ষায় স্রোতের সাথে বয়ে আসা বালুতে ভরাট হওয়ায় দেশের অসংখ্য নদী মরে গেছে। আর নদী মরে যাওয়ায় সহজ যোগাযোগ মাধ্যম এখন আর নেই। নদী দিয়ে পরিবহন ব্যবস্থা অল্প খরচেই করা যেতো। পণ্য বোঝাই মালামাল বহনে খরচ পড়তো অনেক কম। নদীকেন্দ্রিক যাতায়ত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় কৃষকরা দূরবর্তী কোন মোকামে তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে যেতে পারছে না। কাঙ্খিত দাম থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। আর তাতে করে পণ্যের মূল্যে বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। নদীর উপকারিতার কথা শেষ করা যাবে না। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে রবি ঠাকুরের এ কবিতা এখন মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। ফারক্কা বাঁধের কারণে অনেক নদীই শুকনা মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে। ভারত উজানের পানি বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ায় নদী ও তার আশপাশের মানুষকে বড় ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তিস্তায় এখনই পানি সংকটে ভুগতে হচ্ছে। আবার যখন ভয়াবহ বন্যার কবলে পতিত হয় তখন ব্যাপকভাবে বাঁধ খুলে দিয়ে উজানের পানিতে আমাদের ভাসিয়ে দেয় ভারত। যখন পানি দরকার তখন পানি মিলে না। আবার যখন বন্যা হয়, তার ঢলে আমাদের জনবসতি ভাসিয়ে দেয়া হয়। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে অনেক দেন-দরবার করলেও সমস্যার সুরাহা করা যায়নি। তাই দেশের অনেক নদীই এখন ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন।
দেশের অসংখ্য নদী-খাল এখন প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। নদীর রক্ষায় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয় কিন্তু তা কখনো আর আলোর মুখে দেখে না। তার বড় প্রধান কারন হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয় নদী রক্ষাকল্পে; কিন্তু তা এক শ্রেণির লোকের পেটে ঢুকে যায়। নদীর নাব্যতা উন্নয়নে সরকার ৪ হাজার ৩ শত ৭১ কোটি টাকার বড় ধনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে পুরনো ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা এ চারটি নদীতে নৌযান যাতে সহজে চলাচল করতে পারে সে লক্ষ্যে এ প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে। এতে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনেরও সুযোগ তৈরি হবে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে প্রথম ৪ বছর ড্রেজিং করা হবে এবং পরের ২ বছর সংরক্ষণ ড্রেজিং করা হবে। প্রকল্পের ব্যয়ের পুরো অর্থ নেয়া হবে দেশজ উৎস থেকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের ২৪টি নদ-নদীর ভাঙন, নদী ভরাট, লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে নদীর নাব্যতা ও ধারণ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ড্রেজিং সমীক্ষা শেষ করেছে। তার মধ্যে চারটি নদীর ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া গঙ্গা, যমুনা এবং মেঘনা নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের মোট নদ-নদী রয়েছে ৪০৫টি। তার মধ্যে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে ১০২টি, উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে ১১৫টি, উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রয়েছে ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ী অঞ্চলে রয়েছে ১৬টি এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ২৪টি। বাকী নদীগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। সরকার এর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ১ হাজার কোটি টাকার একটা প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সে প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল নদীর নিচে যে বর্জ্য জমা হয়েছে তার ২ ফুট পর্যন্ত তুলে ফেলে নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। লক্ষ্য ছিল বুড়িগঙ্গায় টলটলে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বইয়ে দেয়া। তখন কিছু দিন বুড়িগঙ্গা নদীতে ড্রেজিং করতেও দেখা গেছে। তাতে কাজে কাজ কিছুই হয়নি। জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানির নীচে পলিথিনের ১৪ ফুট স্তর জমা হয়েছে। সেখানে ২ ফুট ড্রেজিং করলে কী ফলদায়ক হবে তা কারো বোধগম্য নয়। সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল। এ কথাটিই এখানে প্রযোজ্য হয়েছে। ঢাকার আশপাশে চারটি নদী রয়েছে, যা ঢাকার প্রাণ বলা চলে। সেসব নদী এখন দূষণ এবং দখলের মহামারি রূপ ধারণ করেছে। ঢাকার আশপাশের নদী হত্যায় নদীপারের কলকারখানাগুলো বড় ধরনের দায়ী। তাদের টিপিআই চালু রাখার কথা থাকলেও তা শুধু দিনের বেলায় চালু রাখছে। রাত হলে নদীতে কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হয় অবলীলায়। বুড়িগঙ্গার পানি শুকনা মৌসুমে কুচকুচে কালো আলকাতরার ন্যায় ধারণ করে। তাতে কোনো ধরনের মাছ বেঁচে থাকতে পারে না। নদী দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ যাত্রী চলাচলে করে থাকে। তাদেরই বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তার কারণ, নদীর পানির দুর্গন্ধে তখন লঞ্চে চলাটা যেন দায় হয়ে পড়ে। দেশের পরিবেশ আইন কেন নদীগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারছে না? কেন কলকারখানার মালিকদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না? গলদটি আসলেই কোথায়? মালিকদের কেন টিপিআাই চালু রাখা বাধ্যতামূলক করা যাচ্ছে না? নদী রক্ষায় হাইকোর্টের রায় আছে। নদীগুলোকে দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে স্রোত বইয়ে দেয়ার নির্দেশ আছে। কিন্তু শিয়ালের হাতে মুরগী বর্গা দেয়া হয়েছে যেন। যাদের নদী রক্ষায় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তারাই নদীর সর্বনাশ ডেকে আনছে। বিশেষ করে বলতে হয়, নদীর জন্য সীমানা পিলার বসানো হয়েছে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে সীমানা পিলার নদীতে বসিয়ে দখলদারদের র্স্বাথ রক্ষার কাজটিই করেছেন নদী রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে লাভ কী? কার স্বার্থে বুড়িগঙ্গার পানি শোধনের জন্য হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলো? সে টাকা কারা ভাগাভাগি করে খেয়েছেন তা এখন বের করতে হবে। নদী সংস্কারে সবচেয়ে ভানুমতির খেলা চলে। ড্রেজিংকৃত বালু নদীতেই ফেলা হয়। বর্ষার স্রোতে তা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। দেশের যে চারটি নদীর খনন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সেখানে যাতে ভানুমতির খেলা না চলে তার দিকে নজর দিতে হবে। নদীর নিচে তিন ফুট পর্যন্ত গভীরভাবে কাটার কথা থাকলেও তা যে মানা হবে সেটাও অতীত অভিজ্ঞতায় বলে না। এ খাতের পুরো টাকাই খরচ হবে দেশীয় উৎস থেকে। আর এটা দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকা। তা যথাযথভাবে ব্যয় হলে সেটাই দেশের মানুষের কামনা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।