Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আলোকিত মানুষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৮ এএম

জন্ম ও মৃত্যু দুটিই চিরন্তন সত্য। মৃত্যু সাধারণতঃ প্রকৃতির রহস্যময় নিয়মানুসারে জীবনের স্বাভাবিক ক্রম পরিণতি বলে অভিহিত। সে পরিণতি অর্থাৎ মৃত্যুকে আটকাতে মানুষ ব্যর্থ। তারপরও মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে আরও ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। জর্জ বানার্ড শ বলতেন, মানুষের অন্তত সাড়ে তিনশত বছর বেঁচে থাকা উচিত। তা না হলে একজন ব্যক্তির পক্ষে তার কর্মের প্রাপ্তির ভিত গড়া কিছুতেই সম্ভব হয় না। বানার্ড শ তার নিজের জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি অন্ততঃ দেড় শত বছর বাঁচবেন, যদি না তিনি কোনো দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে ৯৪ বছর বয়সে হঠাৎ স্নানাগারে পা পিছলে তিনি মারা যান। আমাদের আপনজন, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিক, মানবহিতৈষী, অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহা¤মদ আজরফ বেঁচেছিলেন ৯০ বছরেরও বেশি সময়। অনেক চেষ্টা তদবির করেও তাকে মাত্র আর কটা দিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মৃত্যুর মাস খানেক আগে আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ভালমন্দ অনেক আলাপ-আলোচনার পর বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি ক’দিন থেকে লিখছেন না কেন? বললাম, আমার মতো লক্ষ লক্ষ পাঠক আপনার লেখা পড়ার জন্য প্রতিদিন অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে। বলেছিলেন, শরীরটার সব যন্ত্র ধীরে ধীরে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। কত আর সইবে? শেষ পর্যন্ত পা-টাও যন্ত্রণা শুরু করেছে। ব্যথায় নড়াচড়া করা যায় না। মজা করে তাকে বলেছিলাম, দাদা পা-টা বদলে নিলে কেমন হয়! হেসে বলেছিলেন, আর বদলে লাভ কি! ট্রেনে উঠার সময় তো হয়ে গিয়েছে। এ আলাপের পর তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না, বিভিন্ন কাজে আমিও ছিলাম ব্যস্ত। একদিন ভোরে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক আলহাজ্ব এম এ রকিব আমাকে ফোন করে দেওয়ান মোহা¤মদ আজরফের মৃত্যু সংবাদ জানালেন। তখন ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, রকিব ভাই বোধহয় মজা করছেন আমার সঙ্গে। খবরটা বোধহয় সত্য নয়। তাৎক্ষণিক আমি তাঁর মেয়ে সাদিয়া চৌধুরী পরাগের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। আমার জন্য এ ভীষণ দুঃসংবাদটি সত্যই হয়ে গেল।
১৯৭৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তাঁর বাসায় যাওয়া আসা করতাম। সুযোগ পেলেই দু’কথা বলার চেষ্টা করতাম, প্রশ্ন করতাম কিছু জানার বা শিখার আগ্রহে। বয়সের হিসাবে অনেক ফারাক। কিন্তু তিনি আদর করতেন বলেই পাশে যেতাম, কথা বলতাম, দাদা বলে সম্বোধন করতাম। পরবর্তী পর্যায়ে বৈবাহিক সূত্রে দাদা-নাতি সম্পর্ক আমাদের রয়েই গেল। মজা করে বলতেন, তুমিতো আগে থেকেই আমার নাতি, আমি দাদা, বৈবাহিক সূত্রেও তুমি আমার নাতিন জামাই, মন্দ না। আমাদের স¤পর্ক আরো দৃঢ় হলো। আসলে রাশভারি এ মানুষটির ভিতরে যে আরও এক ভিন্ন মানুষ লুকিয়েছিল তার সঙ্গে মেলামেশা না করলে হয়তো জানতেই পারতাম না। আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তার মহৎ জীবনের যতখানি জেনেছি, তারই নিরিখে কালের পরিপ্রেক্ষিতে তার মূল্যায়ন বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য। কাজটি নিঃসন্দেহে দূরূহ। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সঙ্গে আমার যে গভীর ও আন্তরিক স¤পর্ক ছিল তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই এ দায়িত্ব আমাকে নিতে হলো।
অপরিচিত মানুষের সঙ্গে চট করে কথা বলতেন না দেওয়ান সাহেব। কিন্তু একবার মিশে গেলেই হয়, রীতিমত জমিয়ে কথা বলতেন। তাইতো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। ক্লান্তিকর কাজের পর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিত দেওয়ান আজরফের রসালো গল্প আর মন্তব্য। স^ীয় মেধাবলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতেন। ফলে শিক্ষা-হিতৈষী ও মানবপ্রেমিক হিসেবে এক অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক ও প্রেরণার উৎস হয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। শিক্ষা, সমাজ সেবা ও মানব কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।
এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক স্মৃতি। কাগজে লিখতে গিয়ে বা অতীত জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হতো না তথ্য ও পরিসংখ্যান। সে সময় কম্পিপউটার বা ইন্টারনেটও ছিল না এ অঞ্চলে। কিন্তু আমাদের ভরসা ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধ অথবা এ অঞ্চল তথা উপমহাদেশের অতীত ও বর্তমান বিষয়াদি সম্পর্কে তার ছিল গভীর জ্ঞান। ছিলেন এক জীবন্ত তথ্যভাণ্ডার। খুব কম লোকই তার কাছে কোনো কিছু জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন।
ধর্মীয় বিশ্বাসে একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হলেও ধ্যান-ধারণায় একজন যথার্থ মানুষের পরিচয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন। তাই তিনি হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের কাছে সমানভাবে সমাদৃত ছিলেন। এ যুগে বড় দুর্লভ এ ধরনের ভালোবাসা। বিশ্ববিশ্বত অসাম্প্রদায়িক মনীষীদের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বা®েপ জর্জরিত ও ইজম বিভ্রান্ত পৃথিবীর জন্য মহান শিক্ষাই যেন রেখে গেছেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অত্যন্ত বলিষ্ঠ নীতির অধিকারী ছিলেন। কোথাও কোনো ভুল থাকলে স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিতে কোনো দিনই দ্বিধা করতেন না। সামনে প্রশংসা করে পিছনে সমালোচনা করতে কখনও তাকে দেখা যায়নি। এ দিক দিয়েও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায়শই দুঃখ করে বলতেন, এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে গুরুত্বহীন বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণা নিয়ে অসংখ্য খবর, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রকাশ হলেও পাঠকদের সাড়া মিলে নিতান্তই কম। এনিয়ে তার আক্ষেপ ছিল সতত। মাঝে-মধ্যে অনুযোগের সুরে বলতেন, আর কত লিখব? কাদের জন্য লিখব? নিজেদের জীবন-যন্ত্রণা সম্পর্কেই মানুষ এত নিস্পৃহ! শুধু শুধু লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কিছু হয় কি? কোনো দিনই উচ্চ স্বরে কথা বলতে শুনিনি দেওয়ান আজরফের। সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন কারো সমস্যার কথা শুনলেই বিচলিত হয়ে উঠতেন তিনি। জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরেও এ জননন্দিত ব্যক্তিত্বের প্রতি সকল সম্প্রদায়, শ্রেণি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের অব্যাহত শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত ভালোবাসা তার নানা কর্মকাণ্ডের অকপট স্বীকৃতি। এ পরিচয়েই তিনি কিংবদন্তির নায়ক হয়ে বেঁচে থাকবেন মানুষের হ্রদয়ের মনিকোঠায়।
আজ মনে পড়ছে, ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অফিস কক্ষে বসে একদিন কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর মৃত্যুর পর কাগজের পাতায় স্মৃতিচারণ করে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পাশের চেয়ারে বসেছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। ঐ ব্যক্তির ছবি পাচ্ছিলাম না। রসিকতা করে দেওয়ান সাহেবকে বলেছিলাম দাদা প্রয়োজনে কোনো কিছু না পেলে বড় সমস্যায় পড়তে হয়, বিচলিত হতে হয়। নিজের স্মৃতিচারণ করে বিস্তৃত জীবনের একটা লেখা তৈরি করে আমাকে দিয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা ছবিও, যাতে করে সহসাই লে-আউট করে ফেলতে পারি।
না, আমার এ আবদারটুকু তিনি রাখেননি। একেবারে নিঃশব্দে সবার কাছ থেকে তিনি বিদায় নিয়েছেন। সেদিনের সে রসিকতা যে এত তাড়াতাড়ি নির্মম বাস্তব হয়ে দেখা দেবে তা ভাবতে এখনও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাতো কাগজের লে-আউট নয় যে, যখন খুশি একটাকে উঠিয়ে আরেকটা বসিয়ে দেয়া যায়। এটাতো জীবনের লে-আউট। একবার চলে গেলে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। দেওয়ান সাহেব তো চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। সে স্মৃতি নিয়েই পথ চলতে হবে। এটাই নিয়তি, এটাই নিয়ম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • মোঃ আব্দুল কাদির ২ নভেম্বর, ২০১৮, ২:৩৩ এএম says : 0
    বর্তমান মানবতাহীন সমাজে এরকম মানবদরদী মানুষের আজ ভীষণ প্রয়োজন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন