Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতির মাৎস্যান্যায় এবং সামগ্রিক চরিত্রহীনতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

‘এক মহিষ লোকালয় থেকে বনের দিকে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। তাকে দৌড়াতে দেখে শিয়াল প্রশ্ন করল, কিরে দৌড়াচ্ছিস কেন? হাঁপাতে হাঁপাতে মহিষটি বলল সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপাশে পুলিশ ঢুকেছে হাতি ধরতে। তাহলে তুই দৌড়াচ্ছিস কেন? আরে মিয়া এইটা বঙ্গদেশ, আমি যে মহিষ, হাতি নই, এইটা প্রমাণ করতেই ১০-২০ বছর লেগে যাবে। মাঝখানে বিনাদোষে জেল খেটে জীবন শেষ। এই কথা শুনে মহিষের সাথে সাথে শিয়ালও দৌড়ে বনের দিকে পালাতে লাগল।’ এমন কৌতুক এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। এটি এই সময়ের সামাজিক বাস্তবতার চিত্র। কোন সুনির্দ্দিষ্ট কারণ ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করে থানা হাজত থেকে কোর্টে কোর্ট থেকে কারাগারে অথবা রিমান্ডে পাঠিয়ে দিয়ে যে কারো জীবন দুর্বিসহ করে তোলার ঘটনা অহরহ ঘটছে। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশের পরিচয়ে বাড়ি থেকে ধরে নেয়ার পর দু’চারদিনের মধ্যে রাস্তার পাশে বা ডোবায় লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের হাতে অপহৃত হওয়ার পর লাস হয়ে ঘরে ফেরার পর পিতা হারা সন্তানের, সন্তান হারা পিতাপাতার আহাজারি এখন অতি সাধারণ দৃশ্য। রাষ্ট্র ও সমাজের এমন বাস্তবতাকেই বলে নিরাপত্তাহীনতা। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক সরকারী কর্মচারী,পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্য এখন জনগনের সেবক নয় শোষক ও হন্তারকের ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিপুল সম্ভাবনা সত্বেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে গত এক দশক ধরে দেশে কাঙ্খিত বিনিয়োগ হচ্ছেনা। উপরন্তু দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় মেধা, মানবসম্পদ ও বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ ও সেকেন্ড হোম অফার নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে মুক্তিকামী মানুষের এমন অবরুদ্ধ মৎস্যন্যায় অবস্থা মেনে নেয়া যায়না। যে রাষ্ট্রের সংবিধানে জনগনকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই দেশের সাধারণ মানুষ এখন লুটেরা শাসকশ্রেনীর কাছে অসহায় জিম্মি হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই নির্বাচিত-অনির্বাচিত, সামরিক-বেসামরিক, নিয়মতান্ত্রিক-অনিয়মতান্ত্রিক ও দ্বি-দলীয় শাসকচক্রের হাতে পালাক্রমে এই লুণ্ঠন ও শোষণবঞ্চনা চলছে। গুম-খুন ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় অসংখ্য অজ্ঞাতনামা আসামীর সম্ভাব্য তালিকার টার্গেট অথবা ফেরারী ব্যক্তিদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যাসাইলাম পাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে থাকে। সাবেক মন্ত্রী থেকে ফুটপাতের হকার -দোকানদার পর্যন্ত গুম-খুনের শিকার হওয়ার মত এমন বিভীষিকাময় সময় এ দেশে অতীতে আর কখনো এসেছিল কিনা আমাদের জানা নেই। একাদশ শতকে বাংলায় পাল বংশের শাসনের শেষদিকে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল বলে জানা যায়। ইতিহাসে সেই সময়ের পরিস্থিতিকে মাৎস্যান্যায় বলে অভিহিত করা হয়। আমরা কি এখন একোবিংশ শতকের মাৎস্যন্যায় দেখতে পাচ্ছি?
পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসন এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র মানুষ মেনে নেয়নি বলেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছিল বলেই জনগন ব্যালটের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। দেশের মানুষের হাত থেকে এখন যেন সেই অধিকারও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক বৃত্তে এ নিয়ে বিতর্ক ও বেøম-গেম থাকলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন বিতর্কের চুড়ান্ত রায় ব্যালটের মাধ্যমে জনগণই দিয়ে থাকে। জনগনের সে সুযোগকে পুলিশি শক্তিতে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত গণবিস্ফোরণে রূপ নিয়ে থাকে। গুম-খুনের নিরব সন্ত্রাসের পাশাপাশি হাজার হাজার গায়েবী, মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশের প্রধান বিরোধি দল ও জোটের নেতাকর্মীদের সন্ত্রস্ত রেখে, তাদেরকে রাজনৈতিক কার্যক্রম বা সভা সমাবেশ করতে না দিয়ে, লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে আদালতে ব্যস্ত রেখে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ। অতএব নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ সুবিধার দাবী, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার বা নিরপেক্ষ ও আস্থাপূর্ণ নির্বাচন কমিশনসহ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য কোন দাবীই মানা হবেনা। রাজনৈতিক মতাদর্শগত সব মতভেদ ভুলে গিয়ে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে এসব দাবীতে এক কাতারে সামিল হওয়ার পরও ক্ষমতাসীনরা যখন ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবীর একটিও মানা হবে না, বলে দম্ভ জাহির করেন, তখন জনগনের রাজপথে নেমে আসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। এসব দাবীতে গত ৫ বছরে যখনই বিরোধিদল বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নেমে আসতে চেয়েছে তখনই নানা রকম অগণতান্ত্রিক পন্থায় এসব কর্মসূচি নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত পরিবহন মালিক-শ্রমিক ফেডারেশনকে কাজে লাগিয়ে রাস্তা ও গণপরিবহন বন্ধ রেখে, পথে পথে বাঁধা, হামলা, এমনকি শহরের হোটেল রেঁেস্তারা বন্ধ রেখে, তল্লাশি চালিয়ে, সরকারের দলীয় ক্যাডার এবং পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান ও গুলি-টিয়ারসেল মেরে বিরোধিদলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পন্ড করে দিয়ে বলা হয়েছে, তারা আন্দোলনে ব্যর্থ। রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন আমাদের সংবিধান স্বীকৃতি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার এখন পুলিশের অনুমতির উপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সময় অনুসারে, আর মাত্র ১ সপ্তাহ পরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। অংশগ্রহণ নির্বাচনের শর্ত হিসেবে এ সময়ে বিরোধিদলের সভা সমাবেশ অবারিত থাকার কথা থাকলেও এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, বিরোধিদল ও জোট পুলিশের কাছে সভা-সমাবেশের অনুমতি চাওয়ার পর দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রেখে দু’একদিন আগে অনেকগুলো অযৌক্তিক শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেয়ার পর আয়োজক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশের হানা ও ধর-পাকড়ের পর যে সমাবেশটি হচ্ছে তাতেও হাজার হাজার মানুষের ঢল নামতে দেখা গেছে। তবে সরকারের প্রায় সব কর্মসূচির টেলিকাস্ট হলেও টিভি চ্যানেলে বিরোধিদল ও ঐক্যজোটের সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচারের উপর এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় টিভি চ্যানেলগুলো এসব সভাসমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার করতে সাহস পাচ্ছেনা। মুক্ত গণমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন বাস্তবতা থাকতে পারে না।
এই নিবন্ধ যখন লিখছি তখন সারাদেশে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে কর্মজীবী সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা চলছে। গত সেপ্টেম্বরে পাস হওয়া সড়ক নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের দাবীতে পরিবহন শ্রমিকরা এই কর্মবিরতি পালন করছে। নিজস্ব দাবী-দাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রের কাছে যে কোন নাগরিকের দাবী-দাওয়া পেশ ও কর্মবিরতি পালনের অধিকার নিশ্চয়ই আছে। তবে পরিবহণ শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনকে ¯্রফে কর্মবিরতি বলা চলে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কর্মীরা গায়ের জোরে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা রুদ্ধ করে দিতে চায়। দেশের সব সরকারী-বেসরকারী গণপরিবহন , ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের গাড়ি আন্দোলনকারীদের সংগঠনভুক্ত নয়। তাদের দাবীর সাথেও সবাই একাত্ম নয়। জনগনের চলাচলের অধিকারের কথা বলে, বিরোধিদলের হরতালের সময় যে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় গাড়ি নামানোর পাশাপাশি রাজথে থাকার পাল্টা ঘোষণা দিয়েছে। তারা এখন সড়ক নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনের দাবীতে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে। ব্যক্তিগত গাড়ীর চালক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গাড়ির যাত্রী এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও তাদের হামলার শিকার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে কলেজ ছাত্রীদের গায়ে গোড়া মবিলের কালি মেখে দেয়ার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের এই আন্দোলনে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক দিক হচ্ছে, ওরা মুমুর্ষূ রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকেও কোন ছাড় দেয়নি। হরতাল- অবরোধ তো বটেই, যেখানে কার্ফিউ বা যুদ্ধের সময়ও জরুরী অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে কোন বাঁধা থাকে না। সেখানে বাংলাদেশে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরা মুর্মুষূ রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স চলাচলেও বাঁধা দিয়ে নির্মমতার নজির সৃষ্টি করেছে। দশমাস গর্ভে ধারণ করার পর মায়ের কোল আলো করে জন্মনেয়ার ৭ দিনের মাথায় একটি শিশুর স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয়ার পর মৌলভিবাজারের বড় লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা শিশুটির জরুরী উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের বাঁধায় রাস্তায় ২ ঘন্টা আটকে থাকার পর অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিশুটি। টিভি টকশোর এক আলোচক মাসুদা ভাট্টির সাথে প্রবীণ রাজনীতিবিদ, লেখক ও আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের টেলি বাদানুবাদে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই’। তবে ব্যারিস্টার মইনুল ‘চরিত্রহীন’ শব্দটিকে মাসুদা ভাট্টির পেশাগত চরিত্রহীনতা বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই শব্দ প্রয়োগের জন্য দু:খ প্রকাশ করেছিলেন। তবে সেই নারীর মানহানি ঘটেছে দাবী করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। মাসুদা ভাট্টির মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার পরও রংপুরে আরেক নারীর করা মামলায় ঢাকায় গ্রেফতার হন দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, সম্পাদক এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। কিন্তু মেয়েদের গায়ে মোটরের কালি মেখে দেয়া, অকথ্য গালাগালি করা বা অ্যাম্বুলেন্স আটকে শিশু হত্যার পরও কোন পরিবহন শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কাউকে আটক বিচার বা জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। আরো অনেক মামলার সাথে কুমিল্লায় বাসে পেট্টোলবোমা হামলার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গ্রেফতারী পরোয়ানা হয়েছিল, একইভাবে অ্যাম্বুলেন্স আটকে শিশু হত্যার অভিযোগে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার হওয়া কি সঙ্গত ছিল না?
বর্তমান সরকারের আমলে গুম-খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর অন্যতম একটি ঘটনা হচ্ছে নারায়ন গঞ্জে ৭ খুন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়নগঘ্জের আদালতে মামলার হাজিরা দিতে আসা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, নজরুলের ড্রাইভার, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ী চালক ইব্রাহিমসহ ৭ জনকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তুলে নেয়ার পর এদের কোন হদিস পাওয়া না গেলেও এর দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ৭ জনের লাশ ভেসে উঠে। এরপরের ঘটনা পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। সারাদেশে গুম-খুনের ঘটনায় পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেনীর সদস্যের অপরাধ চিত্রের খানিকটা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। জোট সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষাপটে যে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র‌্যাব) বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর দেশের মানুষ স্বস্তির নি:স্বাস ফেলেছিল, সেই বাহিনীরই এক শ্রেনীর সদস্য এবং ডিবি পুলিশ নামধারী বা ছদ্মবেশ ধারি পেশাদার অপরাধিদের কারণে জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরী হয়েছে। দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব খবরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তরফ থেকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নারয়নগঞ্জের সাতখুন বা সুইডিস এক রেডিওতে ফাঁস হওয়া কথিত র‌্যাব কর্মকর্তার অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার বড় ধরনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর অপরাধপ্রবণ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকেই আস্থাহীনতার সংকটে পড়তে হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধি সদস্যদের বিচারের আওতায় এনে গুরুদন্ডে দন্ডিত করার দৃষ্টান্ত না থাকা। নারায়নগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনার ৪ বছর পর গত সপ্তাহে আবারো নারায়নগঞ্জে একসাথে ৪ খুনের ঘটনা ঘটেছে। আড়াই হাজারের মহাসড়কের পাশে ৪ যুবকের গুলিবিদ্ধ লাস উদ্ধারের পর এবারো অভিযোগের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। পুলিশ অভিযোগ অস্বীকার করলেও এখন পর্যন্ত হত্যাকান্ডের মোটিফ বের করতে পারেনি পুলিশ।গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নিহতদের একজন ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার জানিয়েছেন, তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সে শনিবার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে স্বামীকে খাবার খাওয়ান। রবিবার ফারুককে কোর্টে চালান করার কথা থাকলেও রবিবার ফারুকসহ চার যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের ৭ জনের অপহরণ ও খুনের চাঞ্চল্যকর মামলায় র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের ফাঁসি ও ১১ জনের যাবজ্জীবন সাজার রায় হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এবার ৪ যুবকের গুলিবদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা সাতখুনের মত আলোড়িত বা চাঞ্চল্যকর হয়নি। এর কারণ কি এই যে, সেখানে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বা আইনজীবী চন্দন সরকারের মত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভিক্টিম হননি? অতএব আবারের চারখুন কোন চাঞ্চল্যকর ঘটনা না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ অস্বীকার করছে বটে, তবে কারা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব।
জনগন আশ্বস্ত হতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর কখনো ৭ খুনের মত ঘটনায় জড়িত হবে না। সেই সাথে দেশের জনগণ এটাও দেখতে চায়, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের পেটোয়া বাহিনীর ভ‚মিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাজার হাজার মামলা দিয়ে বিরোধিদলের লাখ লাখ কর্মীকে ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত রাখতে পুলিশ বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যকে প্রচুর সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে দেশের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, বিনিয়োগের সম্ভাবনা সত্বেও দেশে কোন বিনিয়োগ হচ্ছেনা। পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেনীর সদস্য অবাধ দুর্নীতি ও লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছে। এই নিবন্ধটি লেখার সময় পত্রিকায় প্রকাশিত যে সংবাদটি নজরে পড়ল তা হচ্ছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস নগদ ৪৪ লক্ষাধিক টাকা, নানা জনের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকার চেক এবং তিন কোটি টাকার এফডিআরের কাগজপত্রসহ রেল পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন । গ্রেফতারের পর জানা গেল তিনি অবৈধ উপায়ে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা আয় করেন। কারাগারে বন্দিদের নিলামে বিক্রি করা, আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো বন্দিদের নির্যাতন ও পুন:গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে সোহেল রানা। দেশের অন্যান্ন কারাগারের জেলার ও কারারক্ষিরা কি একইভাবে দু হাতে টাকা কামানোর সুযোগ নিচ্ছে না? এক সময়ের মন্ত্রী-এমপিসহ গ্রেফতার হওয়ার বিরোধিদলের নেতাকর্মীরদের সাথে স্বজনদের দেখা সাক্ষাৎ, অসুস্থ হলে(না হলেও) কারা হাসপাতালে আয়েশে থাকার ব্যবস্থা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন থেকে বাঁচতে, জামিন পাওয়া আসামীকে নতুন মামলা বা গায়েবি মামলার অজ্ঞাত আসামী দেখিয়ে কারা ফটক থেকে পুনরায় গ্রেফতার করার ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেনীর পুলিশ কর্মকর্তা ধনকুবের হয়ে উঠেছে। এর বিপরীত চিত্রও আমাদের পুলিশ বাহিনীতে আছে। তাদের কারণে এই পুলিশ বাহিনী এখনো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ভরসাস্থল এবং তাদের হাত ধরেই পুলিশ ও র‌্যাব এখনো মানুষের পরিপূর্ণ আস্থা অর্জনের সুযোগ ও সম্ভাবনা টিকে আছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যে পুলিশ আইন করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সে আইনের সাথে আরো নতুন নতুন নির্বতনমূলক আইন যুক্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও বিরোধিদলের নিরপরাধ নেতা-কর্মীদের গায়েবি মামলায় ফাঁসিয়ে পুলিশের একশ্রেনীর কর্মকর্তার কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার এই সুযোগ চিরদিনের জন্য বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবী।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন