Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ঐক্যফ্রন্টের ঈমানী শক্তির ওপর নির্ভর করছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

নির্বাচন কমিশনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেশবাসীর চোখে যখন রং বেরং এর একটার পর একটা শংকা, অবিশ্বাস ও অনাস্থার হাওয়া বইতে শুরু করেছে তখনই হঠাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এ কথা আমরা বলি নাই।’ ঝড়ো হাওয়াতে কুপি বাতি যেমন ধপ করে নিভে যায় তেমনি সিইসির বক্তব্যে আসন্ন নির্বাচনের সূতায় যেন একটা হ্যাচকা টান পড়ে। এমনিতেই নির্বাচন কমিশনকে দেশের মানুষ নির্বাহী বিভাগের একটি দপ্তর মনে করে, যদিও সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১৮ (৪) মোতাবেক ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ এরকম স্বাধীনতা বিচার বিভাগকেও দেয়া হয়েছে যার নমুনা বিচারপ্রার্থী জনগণসহ দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কতটুকু স্বাধীন তা তার আচরণ এবং বেগতিক কথা বললেই রাজ ধমক খেয়ে সুবোধ বালকের মতো চুপসে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। জাতির এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব শুধু আমলাদের উপর ছেড়ে দেওয়া কতটুকু সঠিক হয়েছে তাও বিবেচনার বিষয়।
দেশটি দুই বার স্বাধীন (১৯৪৭ ও ১৯৭১) হওয়ার পরও গণমানুষ যখন তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয় তখনই অবিশ্বাস, আত্মবঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে তখনই শ্লোগান শোনা যায়, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এক সময় তারা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়। অতপর ঐক্যমতের ভিত্তিতে ৫৮ক ধারা সংশোধন করে সংবিধানে প্রতিস্থাপন হয়, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের’ ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন ২০১১ পাস করার পর সংবিধানের ৫৮ক ধারা বিলুপ্তি করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান আর রইল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বড় দুই রাজনৈতিক দলই সফল হয়েছিল অর্থাৎ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রথমে জামায়াতে ইসলাম উপস্থাপন করলে আওয়ামী লীগ, বাম দল যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ও পারস্পরিক আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধিত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল, যা ছিল একটি আন্দোলনের ফসল, কিন্তু রাতারাতি সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রভিশন মুছে ফেলা ছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যাভিশারি একটি পদক্ষেপ।
গত ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সভায় অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রদত্ত বিষয়বস্তুর উপর আলোচনা করতে না দেয়ায় তিনি ওয়াক আউট করেন। তার প্রস্তাবিত আলোচনার বিষয়বস্তু যতটুকু জানা যায় তা নিম্নরূপ:
(ক) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন: আগের নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম মূল্যায়ন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে তাদের ব্যবহার করা যায়, তা ঠিক করতে হবে।
(খ) অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন: অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে নির্বাচনে অনিয়মের পথ বন্ধ হয়। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হলে তা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশকে সমর্থন করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন দ্বিপাক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা করতে পারে।
(গ) নির্বাচনে নিরপেক্ষতা: নির্বাচনের নিরপেক্ষতা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় রাখা নির্বাচন কমিশনের একার ওপর নির্ভর করে না। এতে সরকারের সহযোগিতা দরকার।
(ঘ) নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি: নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতাও আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বাস্তবতায় কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কীভাবে আরো নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায়, তা দেখা উচিত।
(ঙ) সরকারের সঙ্গে সংলাপ: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার নির্বাচন কমিশনের বড় অংশীজন। সংলাপে দেখা যায়, কিছু বিষয় রাজনৈতিক বা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপ আবশ্যক।
মাহবুব তালুকদারের ওয়াক আউট বা তার প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর উপর আলোচনা করতে না দেয়ার পিছনে সরকারের প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। উক্ত বিষয়গুলি একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে ছিল কি, ছিল না জনগণ অবশ্যই তা বিশ্লেষণ করে দেখবে। ইতোপূর্বেও ইভিএম সংক্রান্ত বিষয়ে মাহবুব তালুকদার দ্বিমত করেছিলেন। সেখানেও তার বক্তব্যে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি মুখ্য বিষয় নয় বরং আলোচনা না করতে দেয়াটাই সন্দেহের জন্ম দেয়।
একের পর এক সরকার যে সকল কঠিন আইন পাস করছে তার পরিণাম কী হতে পারে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা না রাজতন্ত্র তা অগ্রীম চিন্তা করাও অবান্তর হবে বলে মনে হয় না। মিথ্যা তথ্য দেয়া বা মিথ্যা কথা বলা বা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক কথা বললে যেমন অপরাধ হবে, সরকার যখন পুলিশ দিয়ে বিএনপি ও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেয় আজ তার জন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখলে সরকারের স্বচ্ছতার প্রমাণ মিলতো। কিন্তু সরকার মিথ্যা এজাহার দেবে অথচ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না বা সমালোচনা করা যাবে না। তা হলে নামে মাত্র সংবিধানে রেখে লাভ কি? আইন করে তা তুলে দিলেই তো লেঠা চুকে যায় !
দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) নির্বাচন কমিশনের মতই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার যখন কারো প্রতি বিরাগভাজন হয় তখনই দুদক তার উপর চড়াও হয়। যেমন হয়েছে পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা, আমির খসরু মাহমুদের বেলায়। এখন দেখা যাক ডা. জাফরউল্ল্যাহর ভাগ্যে কী জোটে? সবেমাত্র কোটি টাকার চাঁদাবাজির আসামি হয়েছেন। সরকারের পক্ষে থাকলে সাত খুন মাফ, আর কেউ বিরোধিতা করলেই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলি তার পিছু নেয়। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন দুদক সব স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পরাধীনতার নমুনা জনগণ দেখছে তা থেকে এটাই প্রতিমান হয় যে, সরকারের ইচ্ছাবহির্ভূত কোনো কাজ এ দেশে হবে না, তা যাই হোক না কেন।
‘কোটি টাকার বউ’ নামে একটি সিনেমা রিলিজ হয়েছিল। এখন দেখছি, জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৭০০ কোটি টাকা বাজেট দেয়া হয়েছে, যা এ দেশের কৃষক-জনতার মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো কষ্টার্জিত অর্থ। অথচ যাদের ট্যাক্সের অর্থে নির্বাচনী বাজেট পূরণ হবে তাদের ভোট তারা কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে দিতে পারবে কি না তা এখনও দৃশ্যমান নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বলেছেন, নির্বাচন সক্সক্ষু হবে কিনা এ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না।
বিএনপি’র সামনে এখন কঠিন পরীক্ষা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে কারণে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি সেই একই কারণ নিষ্পত্তি না করে বিএনপি যদি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তবে এতো নেতাকর্মী, যারা জেল-জুলুম সহ্য করেছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাদের নিকট দলটি কি জবাব দেবে? বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি না হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কোনো নমুনা দৃশ্যপটে আসে না। তাছাড়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার নামান্তর হবে সরকারের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের বৈধতা প্রদান করা।
সংবিধানের ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেককে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে, তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানবলী সাপেক্ষে তাহাদের উত্তারাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্বপদে বহাল থাকিবেন।’ এছাড়াও চলমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সময়েও জাতীয় সংসদ সদস্যরা স্বীয় পদে বহাল থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। আর প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল ও সরকার সংবিধান থেকে একচুল পরিমাণ নড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যেমনটি আইউব, ইয়াহিয়া, এরশাদের মুখ থেকে দেশবাসী শুনেছে। তারপরও তাদের নড়তে হয়েছিল বটে, তবে এ জন্য জাতিকে অনেক ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। এটা এখন বলা বাহুল্য যে, চলমান সংবিধান মোতাবেক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকার কোনো সুযোগ নেই। জাতি ঐক্যফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে আছে, ঐক্যফ্রন্ট যদি তার দাবিতে অনড় থাকে, কোনো প্রকার আপোস না করে। ঐক্যফ্রন্টের দৃঢ়তা ও ঈমানী শক্তির উপরই নির্ভর করছে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যত।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • আবু আব্দুল্লাহ ২৮ অক্টোবর, ২০১৮, ৩:৪৪ পিএম says : 0
    আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ট ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও যদি আবার ক্ষমতায় আসে আমাদের কোনো আপত্তি নাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন