পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আগামী নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিদেশিদের তৎপরতাও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চান। এ নিয়ে তারা সরকারসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। একটি দেশের নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে যদি বিদেশিদের পরামর্শ দিতে হয়, তবে সেটা খুবই দুঃখের বিষয়। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ আমাদের দেশে এখনও সঠিকভাবে বিতর্কমুক্ত ও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলো সৃষ্টি করতে পারেনি। এই না পারার কারণেই বিদেশিরা অনেকটা যেচে পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসেন। এর অন্য একটি কারণ হচ্ছে, তাদের দেশ ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে ঋণ ও আর্থিক সহযোগিতা নিতে হয়। ফলে তাদের প্রভাব দেশের ওপর রয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকেই বিদেশিদের এ প্রভাব চলে আসছে। সদ্য স্বাধীন হওয়া অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য বন্ধু প্রতিম দেশ হিসেবে সাহায্য-সহযোগিতা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তা যদি যুগের পর যুগ চলতে থাকে, তখন দেশটির নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা আত্মমর্যাদা নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়ে, যে নেতৃত্ব দেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে। এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে, যারা বন্ধু হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বা দিয়েছে, তারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে নামার তাকিদ ও পরামর্শ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কেউই সুদৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমর্থ্য হয়নি। বরং বিদেশীদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য মুখিয়ে থেকেছে। মুখে মুখে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বললেও বিদেশী সহযোগিতা থেকে এতটুকু বের হতে পারেনি। দেশের মানুষ দেখছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তাদের প্রদেয় অর্থ কীভাবে ব্যয় করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, আইডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠী দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি কীভাবে চলবে তার ওপর প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ চাপ দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে হলে এসব দাতা সংস্থার কথা মতোই যেন আমাদের চলতে হবে।। বিদেশিদের এমন অলিখিত ও অদৃশ্য খবরদারি বরাবরই আমাদের উপর রয়েছে। এ থেকে কবে মুক্ত হবো, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটা সবাই জানে, বিশ্বব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার জন্মই হয়েছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর খবরদারি করার জন্য। দেশগুলোর উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি তার নিয়ন্ত্রণে। পুঁজিবাদি বিশ্বের অগ্রযাত্রায় ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য ও সা¤্রাজ্যবাদী মনোভাব দরিদ্র দেশগুলোর উপর ধরে রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যেই ব্যাংকটির জন্ম দেয়া হয়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রথমত, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে এগুতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন, তা ঋণস্বরূপ যোগান দেয়া। দ্বিতীয়ত, দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা, যাতে তাদের কথার বাইরে টুঁ শব্দ করতে না পারে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর এছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না। বাধ্য হয়ে তাদের সহায়তা নিতে হয় এবং সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কথা শুনতে হয়। এখনও অনেক দেশের অর্থনীতি ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অবশ্য ব্রাজিলসহ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই বিশ্বব্যাংককে বিদায় জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের মতো দেশগুলো এখনও এ অবস্থায় উপনীত হতে পারেনি।
দুই.
বিদেশি দাতা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের খবরদারির মধ্যেই আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি বলে দাবি করছি। অথচ আমাদের উপর বিদেশিদের বিশাল ঋণের বোঝা চেপে রয়েছে। এদিকটি কেউ ভেবে দেখছে না। বলা হয়, আমাদের দেশে বিদেশিদের যে ঋণ রয়েছে, তার মাথাপিছু পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার উপরে। ধনী থেকে হতদরিদ্র মানুষটিও এই ঋণের বোঝা বয়ে চলেছে। বোঝাটি যদি না থাকত, তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম, তা কল্পনাও করা যায় না। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবো বলে যে দাবী করা হচ্ছে, ঋণের এই বোঝা যদি এত বেশি না হতো বা না থাকত তবে তা এ মুহূর্তেই অর্জন করা সম্ভব ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এ বোঝা আমরা চাইলেই নামিয়ে দিতে পারি না। ২০৪১ সালের মধ্যে পারব কিনা, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এ সময়ের মধ্যে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা দাতা সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংককে বিদায় করতে পারব কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ’৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশকে উন্নত দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়তো আমাদের অনেকেরই হবে না। ততদিনে অনেক মানুষই জীবিত থাকবে না। এ ধরনের কথা বলা, অনেকটা মানুষের সামনে আশার ফানুস ঝুলিয়ে দেয়ার মতো। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন এ আশাবাদের রাজনীতি করছে। তারা ভিশন-মিশনের তত্ত¡ হাজির করছে। মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। অবশ্য স্বপ্ন দেখানো দোষের কিছু না। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেশে যে ধরনের সুস্থ্য রাজনীতি এবং সুশাসন দরাকর তা কি আমাদের দেশে আছে? বরং আমরা দেখছি রাজনৈতিক সংঘাত, অস্থিতিশীলতা এবং লুটপাটের সংস্কৃতি। এ পরিস্থিতির মধ্যে স্বপ্ন দেখা কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। বর্তমানের দিকে না তাকিয়ে দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর যৌক্তিকতাও প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে মানুষের যে দুঃখ-কষ্ট, তা ঘোচানোর কোনো নামগন্ধ নাই। মানুষের মধ্যে যে চরম হতাশা বিরাজ করছে, তা দূর করার পদক্ষেপ নেই। দেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়ে রয়েছে। তাদের কর্মসংস্থানের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হচ্ছে না, আগামী দশ বছরে দেশে একজনও বেকার থাকবে না। এ আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে না। উপরন্তু একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগের যে চরম মন্দাবস্থ চলছে, তা কাটছে না এবং কাটানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যাংকগুলোতে লাখ লাখ টাকা অলস পড়ে আছে। এ অর্থ কোনো কাজে আসছে না। বৈদেশিক রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। বিদেশি ঋণের বোঝার নিচে অর্থনীতির এই যে বেহাল দশা, এ দশা থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেবল দিনে দিনে বাড়ছে ঋণ। তবে সরকারের উন্নয়নের ফানুস উড়ানো থেমে নেই। কয়েক দিন পরপর সরকারের তরফ থেকে উন্নতির সূচকের তথ্য তুলে ধরা হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি থেকে শুরু করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কথা বলা হয়। অর্থনীতির এসব সূচক বাড়লেই কি আর নামলেই কি-এ নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন মাথা ঘামায় না। আলোচনা করতেও শোনা যায় না। তাদের আলোচনার প্রয়োজনও নেই। কারণ তাদের দুর্গতি কেবল তারাই জানে। তারা জানে, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। যে টাকা নিয়ে বাজারে যায়, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারে না। পকেট থেকে টাকা বের হয়ে যায় ঠিকই, বাজারের ব্যাগ আর ভরে না। তারা এটাও জানে, সরকার মানুষের পকেট ভরার চেয়ে উল্টো কীভাবে পকেট থেকে অর্থ বের করে নেয়া যায়, তার কায়দা-কৌশল ভাল করে জানে। সাধারণ মানুষ এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পড়েছে যে, তাদের নিদারুণ টানাপড়েনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণী ধনী থেকে ধনী হচ্ছে। দেশে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য আকাশসম হয়ে গেছে। সরকার কেবল তার চারপাশে থাকা ধনী শ্রেণীর দিকে তাকিয়েই দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছে। এতে অসহায় সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় থাকছে না। সরকারের উন্নয়নের গর্ব পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ বড় বড় ইট-পাথরের প্রকল্পগুলো তখন তাদের কাছে বড় বড় স্থাপনা ছাড়া কিছু মনে হয় না। তারা কেবল দেখছে, তাদের অর্থে গড়া এসব প্রকল্প ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা ঘোছাতে পারছে না। এসব উন্নয়নের যে প্রয়োজন নেই, তা নয়। তবে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার মধ্যে যদি এসব উন্নয়ন প্রকল্প করা হতো, তাহলে এগুলো নিয়ে তাদের উচ্ছাসও থাকত। আর সরকারের কাজই হচ্ছে, দেশের ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করা, হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। এটা রুটিন কাজ এবং তার দায়িত্ব। উন্নয়নের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কিছু নেই। উন্নয়ন হলে তা মানুষই বলবে।
তিন.
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যেমন বিদেশিদের আধিপত্য রয়েছে, তেমনি রাজনীতিতেও রয়েছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে বিদেশিদের তুষ্ট করে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। আবার বিরোধী দলকেও বিদেশীদের তুষ্ট করে ক্ষমতায় যেতে বেশ তৎপর দেখা যায়। বিষয়টি অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিদেশিদের তুষ্ট না করে যেন ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন। এর বাস্তব নজির দেশের মানুষ বহুবার দেখেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে যদি দৃষ্টি দেয়া যায় তবে দেখা যাবে, সে নির্বাচনে কী নগ্নভাবেই না প্রতিবেশি ভারত ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় রাখতে ভূমিকা রেখেছে। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব নিজে এসে কাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে হবে, কাকে করাতে হবে না-তা প্রকাশ্যে ঠিক করে দিয়ে যান। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতিতে এমন হস্তক্ষেপ আর কখনো ঘটার নজির নেই। ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দূতিয়ালী করার জন্য বিদেশিদের আগমনের দৃশ্য মানুষ দেখেছে। দিনের পর দিন তারা উভয় দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। তারপর ব্যর্থ হয়ে চলে গেছেন। এ ধরনের দূতিয়ালী কাম্য না হলেও, অনিবার্য সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ হিসেবে দেশের মানুষ তা মেনে নিয়েছে। আমরা প্রথম এ ধরনের দূতিয়ালীর দৃশ্য দেখি ১৯৯৪ সালে। সে সময় ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে সংকট নিরসনে আলোচনা করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি উভয় দলের সাথে বেশ কয়েক দিন আলোচনা করে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হন। তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত আর্জেন্টিনার কূটনীতিক অস্কার ফার্নান্দেজ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। কয়েক দিনের আলাপ-আলোচনার পর তিনিও ব্যর্থ হয়ে চলে যান। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এসব উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানের না হলেও, শান্তির জন্য দেশের মানুষ মেনে নিয়েছিল। তবে যখন একটি দেশ সরাসরি দূত পাঠিয়ে কীভাবে নির্বাচন করতে হবে, তা ঠিক করে দিয়ে যায়, তখন দেশের আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত যে কাজটি করেছে, সচেতন ও দেশপ্রেমিক কোনো মানুষই তা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। ভারতের এ ভূমিকাকে যারা স্বাগত জানিয়েছে তাদের বলতে শোনা যায়, বন্ধুরাষ্ট্র বলে সে তা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বন্ধুরাষ্ট্র মানে কি এই যে, আমরা কীভাবে চলব, কী খাব, কী খাব না, তা তার পছন্দ মতো করতে হবে? আত্মমর্যাদাশীল কোনো রাষ্ট্র কি তা মেনে নিতে পারে? এর ফলাফল কি ভাল হয়েছে? হয়নি। কারণ ভারতের এই একতরফা ভূমিকা বাংলাদেশের অন্যান্য বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ভালভাবে নেয়নি। তারা নাখোশ হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী অন্য দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখনও বিরাগভাজন হয়ে আছে। তারা স্পষ্টভাবেই ঐ নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। এর ফলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তারা এখন থেকেই বলতে শুরু করেছে, সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। যে ভারত একটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছে, সেই ভারতও আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। বাংলাদেশে দেশটির হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ভারত। এখন এ প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারত কি আসলেই বাংলাদেশে এমন নির্বাচন দেখতে চায় বা এটা কি তার মনের কথা? নাকি ৫ জানুয়ারির মতো একটি বিতর্কিত নির্বাচন দেখতে চায়? এ প্রশ্নের জবাব পেতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দুঃখের বিষয়, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো যখন ভারতের আধিপত্যবাদ থেকে বের হয়ে আসছে, তখন আমরা তাকে তোষণ করেই চলেছি। সে তার সুবিধার জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে যা চাইছে তার সবই দিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তিরা যা খুশি তা বললেও এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে তো নয়ই, কোনো বিরোধী দলকেই এর প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারত যাতে কোনোভাবেই নাখোশ না হয়, এজন্য কোনো ধরনের প্রতিবাদ করছে না। এটা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি ছাড়া আর কি হতে পারে? সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে মনে হচ্ছে, দেশের আত্মমর্যাদা থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না, যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে ও যেতে হবে।
চার.
আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছি বলে সরকার যতই বলুক, তার প্রকৃত চিত্র বিপরীতমুখী। আমরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এখনও স্বাধীন হতে পারিনি। বন্ধুত্বের নামে বিদেশিদের কাছে অনেকটা বন্ধি হয়ে আছি। স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে অগ্রসর হতে পারিনি। যে দেশের অর্থনীতির বৃহদাংশ বিদেশিদের আর্থিক সহায়তা এবং ক্ষমতাকামী দলগুলো বিদেশিদের সহায়তা ও পরামর্শের উপর নির্ভরশীল, সে দেশের আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না। আমরা এখন যতই উন্নতির কথা বলি না কেন, অর্থনীতিতে ইমার্জিং টাইগার বলে আখ্যায়িত হই না কেন, বিদেশিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে না পারলে, তা কেবল কথার কথাই হয়ে থাকবে। আত্মমর্যাদাশীর জাতি হিসেবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমাদের বন্ধু প্রয়োজন, কর্তার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়টি সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য পেশাদারি মনোভাব ও কূটনৈতিক বন্ধুত্বের পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এখানে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। নির্দিষ্ট কোনো দেশের উপর অতি নির্ভরশীল না হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশিদের কর্তৃত্ব খাটানোর মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সকলেরই সতর্ক থাকা দরকার। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিদেশিদের কোনো ধরনের সহায়তা ও হস্তক্ষেপ ছাড়া রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা সমাধানের নজির আমাদের দেশে রয়েছে। এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের নবযাত্রাকালে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল দেশের রাজনীতিতে এখন সে ধরনের চেতনা ও ঐক্য খুবই জরুরী। এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব বেশি। তার উচিত হবে, আসন্ন নির্বাচনের আগে সব দলের সাথে সমঝোতা ও ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে গোঁ ধরে বসে থাকলে দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।