Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে নৈরাজ্য

| প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম


সড়কে নৈরাজ্য চলছেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন আন্দোলন হওয়ার পরও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি, শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং জনসচেতনতা বাড়েনি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সূচনা করলেও তাতে শামিল হয়েছিল তাদের পিতামাতা-অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ। আশা করা গিয়েছিল, এই আন্দোলনের পর যানবাহন চালকরা সতর্ক হবে, বেপরোয়া যানচালনা থেকে বিরত থাকবে। পথচারিসহ নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে, ট্রাফিক আইন লংঘন কমবে। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে অধিকতর দায়িত্বশীলতা দেখা দেবে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তারা আরো কঠোর হবে। এ সবের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, ও মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং সড়কশৃংখলায় নব অধ্যায় সংযোজিত হবে। অত্যন্ত হতাশার সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, এ আশাবাদ সত্য হয়ে ওঠেনি। দেশব্যাপী এই আন্দোলনের কোনো প্রভাবই যেন পড়েনি। রাজধানী থেকে বড় বড় শহর, মহাসড়ক থেকে আঞ্চলিক সড়ক-কোথাও দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনা কমেনি। সর্বত্র সেই আগের চিত্রই বহাল তবিয়তে বিদ্যামান রয়েছে। গত রোববার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এক বছরের এক শিশু ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয়েছে। রিকশায় মা ও মামার সঙ্গে থাকা অবস্থায় ট্রাকটি রিকশায় ধাক্কা দিলে সে মাটিতে ছিটকে পড়ে। হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। গত শনিবার রাজধানীর কলেজ গেটে এক মহিলাকে একটি বাস ধাক্কা দিলে তিনি গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গতকালের খবরে জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় এক পুলিশ সদস্য, মাগুরায় বাসচাপায় এক স্কুল শিক্ষক, শ্রীনগরে মোটরসাইকেলচাপায় এক বৃদ্ধ এবং কুষ্টিয়ায় বাবা-ছেলে এবং শ্রীমঙ্গলে এক বিএনপি নেতা। প্রতিদিনই সড়কে এভাবে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সড়ক যে সম্পূর্ণরূপেই অনিরাপদ, এসব দুর্ঘটনা ও মৃত্যু তারই প্রমাণ বহন করে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। বাস্তবে কিন্তু তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। সড়কে বিশৃংখলা ও অনিয়ম বন্ধে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কিছু পদক্ষেপ অবশ্য গ্রহণ করা হয়। পালন করা হয় ট্রাফিক সপ্তাহ। এসব উদ্যোগ-পদক্ষেপ সুফল বয়ে আনেনি। এখনো রাজধানীসহ সারা দেশে ফিটনেসবিহীন লক্কড়মার্কা যানবাহন চলাচল করছে। নিষেধাজ্ঞা বেতোয়াক্কা করে মহাসড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান, নসিমন-করিমন-ভটভটি ইত্যাদি দিব্যি চলাচল করছে। চালকদের বেপরোয়া যানচালনা বন্ধ হয়নি। তাদের বেতোয়াক্কা মনোভাবেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। যাত্রী ও পথচারিদের মধ্যে কিছু মাত্র সচেতনতা এসেছে, বলার উপায় নেই। তারা ট্রাফিক বিধি অমান্য করে যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছে, ঝুঁকি নিয়ে যানবাহনে চড়ছে। ফলে যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মানুষ হতাহত হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের হিসাবে গত জুলাই মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২১৩টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৭৭ জন। আগস্ট মাসে দুর্ঘটনা ঘটে ৩০০টি। প্রাণ হারায় ৩৬১ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ২৮৬টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৩০৯ জন। অন্য এক হিসাবে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ১১ জন নিহত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সড়ক দুর্ঘটনায় যতজন মারা যায়, আহত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। দেখা গেছে, যারা সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয় তাদের পরিবার-পরিজন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়ে। হতাহতদের একটা বড় অংশই কর্মজীবি। হত, আহত বা পঙ্গু হওয়ার কারণে মারাত্মক আর্থিক বিপদের মধ্যে পতিত হয় তাদের পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের তেমন ব্যবস্থা নেই। মামলা-মোকাদ্দমার পর নির্ধারণকৃত ক্ষতিপূরণও ত্বরিত পাওয়া যায় না। মামলার প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। ফলে হতাহতের পরিবার এক কঠিন দু:সময়ের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাবিচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে শীর্ষ দু’য়ের মধ্যে। এমতাবস্থায়, গতকাল পালিত হয়েছে নিরাপদ সড়ক দিবস। এ উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শোভাযাত্রা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে এসব কর্মসূচী কতটা ভূমিকা রাখবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলার উপায় নেই। গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ পূর্বক প্রতিকার সম্পর্কে এপর্যন্ত যত সুপারিশ করা হয়েছে তার ক্ষুদ্রাংশও বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭টি নির্দেশনা জারি করা হয়। এর মধ্যে ৭টি নির্দেশনা দ্রুত কার্যকরযোগ্য। আর বাকীগুলো দীর্ঘমেয়াদী। দেখা গেছে, দ্রুত কার্যকরযোগ্য নির্দেশনাগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার যত কারণই থাক, সবচেয়ে বড় কারণ, সচেতনার অভাব। সচেতনতার অভাব যেমন চালকদের মধ্যে আছে, তেমনি আছে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে। আর সবচেয়ে বেশি আছে যাত্রী ও পথচারিদের মধ্যে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারায় তাদের প্রায় অর্ধেকই পথচারি। সারাদেশের হিসাবেও এ সংখ্যার তেমন হেরফের হবে বলে মনে হয়না। চালকের বেপরোয়া যান চালানো দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বটে, তবে যাত্রী ও পথচারিরা যে ধরনের আচরণ প্রদর্শন করে তাতে অনেক সময়ই দুর্ঘটনা অনিবার্য-অবধারিত হয়ে পড়ে। যাত্রী ও পথচারিরা যদি সতর্ক ও সচেতন হয়, ট্রাফিক বিধি যথাযথভাবে মেনে চলে তবে বহু দুর্ঘটনা থেকেই রেহাই পাওয়া সম্ভব। পুলিশের পক্ষে দুর্ঘটনা কমানো বা নিরোধ করা সম্ভব হয়, যদি যাত্রী-পথচারি পদে পদে শৃংখলা ও বিধিভঙ্গ করে। আমরা মনে করি, চালক-মালিক-শ্রমিক ও যাত্রী-পথচারির সচেতনতা এবং পুলিশের উচ্চ দায়িত্বশীলতাই কেবল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে পারে। আমরা এই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতাই সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রত্যাশা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন