পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তাকে বাদ দিয়েই শেষ পর্যন্ত গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অথচ তিনিই ছিলেন ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। ‘ গত ১৩ অক্টোবর যখন বিএনপি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ ঘটলো, তখন দেখা গেল সেখানে নেই সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বি. চৌধুরীর এ ছিটকে পড়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্যের। কেন তিনি ও তার দল জাতীয় ঐক্য থেকে বাদ পড়ল তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। কেউ বলছেন, তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, আবার অনেকেই বলছেন, তিনি ইচ্ছে করেই সরে পড়েছেন। তবে, এটা ঠিক যে, যিনি এতদিন একটি ঐক্যের ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন, তার এভাবে বাদ পড়া বা সরে যাওয়াকে সহজভাবে নিচ্ছেন না অনেকেই। এর পেছনে কী রহস্য রয়েছে, তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। সবচেয়ে লক্ষ্যযোগ্য ব্যাপার হলো, যে দু’টি দলকে সঙ্গে নিয়ে ডা. বি. চৌধুরী বছর খানেক আগে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করে এগোচ্ছিলেন, তারা তাকে ফেলে রেখেই শামিল হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। এটা যে চৌধুরী সাহেবের জন্য নিদারুন মনোকষ্টের কারণ তাতে সন্দেহ নেই।
ড. কামালের গণফোরামের সঙ্গে মিলে কয়েক মাস আগে যখন বি. চৌধুরী বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলেন, বিএনপি তাতে বেশ ভালোভাবেই সাড়া দেয়। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার চেষ্টা বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরে করে আসছিল। তারা বি. চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় ঐক্যে শামিল হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তারপর থেকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ তৎপরতা চালিয়ে আসছিল জোট গঠনের লক্ষ্যে। এ লক্ষ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেছেন ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তা দুই প্রবীণ নেতার সাথে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিতে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার কথাও বলেছিল।
কিন্তু বিকল্প ধারার যুগ্ম-মহাসচিব ও বি. চৌধুরীপুত্র মাহী চৌধুরীর কিছু অনাকাঙ্খিত তৎপরতা সুচনাতেই আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিয়েছিল। বি. চৌধুরীর বাসায় বিএনপি মহাসচিব ও বি. চৌধুরীর অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালে মাহী ঐক্য করলে যুক্তফ্রন্টকে দেড় শ’ আসন দিতে হবে বলে দাবি করে বসেন। তার এ দাবির কথা প্রচার হওয়ার পর আলোচনা সমালেচনার ঝড় ওঠে। মাহীর দাবিকে সবাই বাস্তবতা বিবর্জিত হিসেবে আখ্যায়িত করে ‘ভাঁজা মাছে ঝোল’ চাওয়ার সাথে তুলনা করেন। কেননা, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তির বিবেচনায় যুক্তফ্রন্টভ‚ক্ত দলগুলোর দেড় শ’ আসন দাবির ন্যুনতম যৌক্তিকতা নেই। তখনই কেউ কেউ বলেছিলেন, মাহীর এ দাবি বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সরে যাবার উছিলা তৈরির চেষ্টা মাত্র। পরবর্তীতে মাহী চৌধুরী আরো দাবি তোলেন যে, বিএনপিকে যদি বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে হয়, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে আসতে হবে। তার এ দাবির পেছনে পিতা বি. চৌধুরীরও সমর্থন ছিল। এসব কারণে এক পর্যায়ে জাতীয় ঐক্য গঠন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ তখন মন্তব্য করেছিলেন, মাহীর এসব দাবি-দাওয়া মূলত বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়াকে ভুন্ডল করার উদ্দেশ্যপ্রসূত। কেননা, তার পিতা বি. চৌধুরী এক সময় জামায়াতের সমর্থনে গঠিত বিএনপির মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন, এমন কি জামায়াতের সমর্থন নিয়ে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন।
বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হতে গিয়ে বিএনপিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে কিছু অবমাননাকর শর্ত। ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে শর্ত দেয়া হয়েছিল যে,ওই প্ল্যাটফরম থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা তারেক রহমানের মামলার বিষয়ে কোনো দাবি তোলা যাবে না। এ মুহূর্তে বিএনপির যেটি প্রধান দাবি, তা উচ্চারণ না করার এ শর্তকে বিএনপির বিষ খেয়ে বিষ হজম করার শামিল বলেই অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর ঐক্য প্রক্রিয়ার যে সমাবেশ মহানগর নাট্য মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়, তার একদিন আগে বিএনপি মহাসচিবসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা যান বি. চৌধুরীর বাসয় তার মান ভাঙাতে। শোনা যায়, বি. চৌধুরী নাকি শর্ত দিয়েছিলেন বিএনপিকে যদি নাট্য মঞ্চের সমাবেশে অংশ নিতে হয়, তাহলে অতীতে তার সাথে দলটি যে আচরণ করেছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাইতে হবে। শোনা যায় বিএনপি নেতৃবৃন্দ বি. চৌধুরীর কাছে দু:খ প্রকাশ করেন। এরপরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাকে আর পাওয়া গেল না।
বি. চৌধুরী তথা বিকল্প ধারা শুরু থেকেই ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিল। তারা বলেছে, কোনো দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে যাতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্য সংসদীয় আসন বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যনীতি অনুসরণ করতে হবে। এজন্যই তারা দেড় শ’ আসন দাবি করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যদি নির্বাচনে বৃহত্তর ঐক্যজোট জয়লাভ করে, তাহলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিএনপি যেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব হয়তো বিষয়টি বুঝতে একটু দেরি করেছেন। যখন বুঝেছেন, তখন তারা ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিকল্প ধারার নেতারা তা মানতে চাননি। তারা আগে আসন বন্টন চুক্তি করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এক সময় বিএনপি নেতৃবৃন্দের উপলব্ধিতে আসে যে, তারা বৃহত্তর ঐক্যজোটের নামে বিকল্প ধারার জালে অটকা পড়তে যাচ্ছেন। তখনই তারা নতুন সিদ্ধান্ত নেন। অপর দিকে বৃহত্তর ঐক্যজোট হলে এর প্রধান নেতা কে হবেন তা নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বি. চৌধুরীর স্নায়ূযুদ্ধ লেগেই ছিল। এক পর্যায়ে এসে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রয়োজনে বিকল্প ধারাকে বাদ দিয়েই জাতীয় ঐক্য গঠন করা হবে। সে সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন হয়েছে ১৩ অক্টোবর।
বিকল্প ধারা যে শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর ঐক্যে থেকে পিঠটান দেবে তার অলামত আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় খবরও বেরিয়েছিল। ২ অক্টোবর বাংলাদেশের খবর এক প্রতিবেদনে বলেছিল, শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য থেকে সরে যেতে পারে বিকল্প ধারা। ৫ অক্টোবর সমকাল ‘বৃহত্তর ঐক্যে গতি কম’ শিরোনামে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়েছিল, বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিকল্প ধারার আন্তরিকতা বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। ১২ অক্টোবর একই পত্রিকার ‘জাতীয় ঐক্যে টানাপোড়েন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিকল্প ধারার নানান শর্ত ও চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি খুব ভালোভাবে নেয়নি ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এ কারণে ১১ অক্টোবর ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দুই দফা বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েও তা বাতিল করা হয়। এ ক্ষেত্রেও বিকল্প ধারা অনীহা কাজ করেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হবার পর বি. চৌধুরী নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা বিএনপি নেতাকর্মীদের হতবাক করে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের নামে এককভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর ‘চক্রান্তে’র সঙ্গে নেই বিকল্প ধারা।’ তার এ বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য তিনি জাতীয় ঐক্যের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন বিএনপিকে? অনেকেই মনে করছেন, ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলে বিএনপির কাঁধে ভর করে চাহিদামত আসন বাগিয়ে নিয়ে সরকার গঠনের সময় হয়তো তিনি অন্য কাউকে সমর্থন দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। বিএনপি নেতৃত্ব বি. চৌধুরীকে ছাড়াই ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে সে ফাঁদে পা দেয়া থেকে বেঁচে গেল বলে মনে করছেন অনেকে।
পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, জাতীয় ঐক্যে শামিল না হওয়ায় বিকল্প ধারার নেতাকর্মীদের একটি অংশ তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা ইতিমধ্যে বি. চৌধুরীর কয়েকজন র্শীষ নেতাকে অব্যাহত দিয়ে দল নিয়ে তারা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। বিকল্প ধারায় এ ভাঙনের খবর সর্বত্র মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। লোকজন বলাবলি করছে যে, অতিলাভের আশায় বি. চৌধুরী শেষ বয়সে এসে পুত্রের কুপরামর্শে বেশ ভালোই একটি আছাড় খেলেন।
কী করবেন তিনি এখন? তার দল বিকল্প ধারা এমনিতেই একটি ভাঙাচোরা সংগঠন, যেটির পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটিও নেই, জেলা-উপজেলা কমিটি তো দূরের কথা। সে দলও যদি ভাঙনের কবলে পড়ে, তাহলে তা যে প্রমত্তা পদ্মার নড়িয়ার ভাঙনের চেয়ে কোনো অংশে কম ধ্বংসাত্মক হবে না, তা বলাই বাহুল্য। অন্য দিকে যে দু’টি দলকে নিয়ে তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন, তারা বিযুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়ায় সেটিরও আর কার্যকারিতা নেই। ফলে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত তৈরি হয়েছে দেশের বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের জন্য। এখন দেখার বিষয় হলো তিনি কী করেন। নতুন কোনো উদ্যোগ নেবেন, নাকি গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে নৌকার সওয়ারি হওয়ার চেষ্টা করবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।