Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়ন সহজ নয়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাহাকে প্রদত্ত ও তাহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।’ যদিও পরবর্তী ধারা অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) মোতাবেক, রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতা খর্ব করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যাস্ত করা হয়েছে, যা সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবউদ্দিনের মতে, কবর জেয়ারত এবং মিলাদে অংশ গ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্রপতির অন্য কোনো কার্যকর ভ‚মিকা নাই। তারপরও রাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রপ্রধান এবং যিনি নাগরিকদের ঐক্যের প্রতীক। জনগণ প্রত্যাশা করে যে, রাষ্ট্রপতি যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে জনগণকে দলমত নির্বিশেষে সকলের মাথার ওপর মেঘের ছায়া দিয়ে সুরক্ষা দেবেন এবং নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে বাঁচাবেন। অথচ বাস্তবে কী হচ্ছে? (১) তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি একজন নারী, যার বয়স ৭৩ বছর, কারাবন্দী অবস্থায় তাকে সুচিকিৎসার জন্য উচ্চ আদালতে এসে ধর্ণা দিতে হয় এবং রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবীসহ রাষ্ট্রীয় আইনজীবীরা জীবনকে বাজী রেখে তা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার শর্ত প্রভিশন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উক্ত শর্ত প্রভিশনে বলা হয়েছে যে, ‘এই রূপ অপরাধে (অর্থাৎ জামিন অযোগ্য) অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ষোল বছরের নি¤œ বয়স্ক বা স্ত্রী লোক বা পীড়িত বা অক্ষম হইলে আদালত তাহাকে জামিনে মুক্তি দিবার আদেশ দিতে পারিবেন।’ (২) ঘটনা ঘটে নাই অথচ, কাল্পনিক এজাহার করে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী (পুলিশ) প্রতি থানায় এক মাসে ২৫-৩০-৪০ মৃত্যু দÐ হতে পারে এমন ধারায় (বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ১৫(৩) ধারা) মামলা রুজু করে এবং সেই মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী পুলিশকে ভালোভাবেই টু-পাইস কামানোর সুযোগ করে দেয়, পত্রিকার ভাষায় যা গায়েবি মামলা এবং হাইকোর্টের ভাষায় বর্ণিত মামলায় ‘পুলিশের ইমেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।’ (৩) জাতীয় নির্বাচন আসন্ন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যখন হাইকোর্ট, জজকোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বারান্দায়, সেখানে সরকারি দল রাষ্ট্রীয় অর্থে নির্বাচনী প্রচারণায় দেশ চষে বেড়াচ্ছে, অথচ এ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আচার্য হিসেবে তার প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি দেশের চলমান অবস্থা, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, রাষ্ট্র পরিচালনায় ও জাতীয় রাজনীতিতে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ও অনাচার প্রভৃতি সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরেছেন, যার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। তিনি সাদামাটা আঞ্চলিক ও প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন যে, ‘এহন রাজনীতি হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। এখানে যে কেউ, যেকোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। কোনো বাধাবিঘœ নাই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকসের লেকচারার হইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে ঢুকাইবনে না। বা আমি যদি কোনো হাসপাতালে গিয়া বলি, এত দিন রাজনীতি করছি, হাসপাতালে ডাক্তারী করার লাইগ্যা দেও। বোঝেন, অবস্থাটা কী হবে? কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ, সবাই; ইঞ্জিনিয়ার কইন আর ডাক্তারই কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর হইলে কইবো, আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে ৬৭ বছর চাকরি করবো। রিটায়ার্ড কইরা কইবো আমিও রাজনীতি করিব। আর্মির জেনারেল অয়, সেনাপ্রধান অয়, অনেকে রিটায়ারমেন্টে গিয়েই কয়, ‘আমিও রাজনীতি করিব। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি, বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে, আমি রাজনীতি করিব। এটার কোনো রাখঢাক নাই, কোনো নিয়মনীতির বালাই নাই। যে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা তখনই রাজনীতিতে ঢুকছে। ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে, এটা যেন কেমন-কেমন লাগে। যার জন্যেই আমার মনে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। এমনকি পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। আবার মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত পাছার মধ্যে বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা। কই যামু। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা, এই সমস্যার কারণও এটা। বিজনেসম্যানরা তো আছেই। শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। কী করবেন। এগুলো থামানো দরকার। অন্যান্য পেশায় চাইলেই যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও রাজনীতিতে তা আছে। যে কারণে সবাই চাকরি শেষ করে রাজনীতিতে ঢুকতে চায়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

রাষ্ট্রপতি কোন প্রকার রাখ-ঢাক না রেখেই রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কথা বলেছেন। রাজনীতিকে ব্যাংক লুটেরা, জনগণের অধিকার হরণকারী আমলারাদের দুর্বৃত্তায়নের কারণে মাঠ-কর্মী, ত্যাগী-পরীক্ষিত রাজনৈতিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় জাতীয় সংসদ এখন ‘কোটিপতিদের ক্লাব’ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা যারা মানুষের উপর নির্যাতন করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে, যারা দুদকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি যে মন্তব্য করেছেন, এ জন্য অনেক ব্যর্থতার মধ্যে জাতির সামনে একটি কঠিন সত্য উন্মোচিত হয়েছে। পুনরায় বলছি যে, তিনি বলেছেন, ‘এমন কি পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। আবার মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত পাছার মধ্যে বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা, কই যামু।’ রাষ্ট্রপতির এই আক্ষেপ ও অভিযোগ দল মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক কর্মীর মনের আবেগ ও উৎকণ্ঠা বলে আমি মনে করি এবং বাস্তব চিত্রই তিনি তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রপতি ‘পাছায়’ বাড়ি দেয়ার কথা বলেছেন, তিনি যদি গায়েবি মামলার শিকার হয়ে থাকতেন তবে এ সম্পর্কেও হয়তো কথা বলতেন। গায়েবি ও মিথ্যা মোকদ্দমা এক কথা নয়। পুলিশ পূর্বে মিথ্যা মোকদ্দমা দিতো এবং এখন কল্পনাপ্রসূত মামলা দেয়। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি নিশ্চয় অবগত রয়েছেন, কিন্তু মন্তব্য করেন নাই, তবে রাষ্ট্রের অভিভাবকের নিকট থেকে গায়েবি মামলা সম্পর্কে প্রতিকারের আশা না করলেও মন্তব্য প্রকাশিত হলে জনমনে আশার সঞ্চার হতো।

আমলারা রাজনীতির মনবাসনা নিয়ে প্রশাসন চালায় বলেই প্রশাসনে স্বচ্ছতা থাকে না, বরং গ্রæপিং সৃষ্টি করে এলাকা এলাকায় বঞ্চিত হয়েছে। একটি রাষ্ট্র যখন আমলা/পুলিশ/ব্যাংক লুটেরা, ভ‚মিদস্যুদের নিকট জিম্মি হয়ে যায় তখনই রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয় দেশের জনগণ, যারা সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ মোতাবেক এ দেশের মালিক। ফলে দেশের সকল সম্পদ মুষ্ঠিমেয় একটি শ্রেণির নিকট কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। সরকারি আমলাদের সীমাহীন সম্পদ বিদেশের ব্যাংকে জমা হচ্ছে। কুয়াকাটা, কক্সবাজার সি-বিচের সন্নিকটে অনেক সম্পত্তির মালিক আমলারা। পুলিশকে হাতিয়ার করেই সরকার গায়েবি মামলা ও বিনা করণে গ্রেফতার সংস্কৃতি চালুর মাধ্যমে গোটা সমাজের প্রতিবাদের মুখে তালা লাগানোর পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি অচলবস্থা সৃষ্টি করেছে। এ নাটকের জবনিকা কীভাবে হতে পারে তার পূর্বাভাস এখনই দেয়া যাচ্ছে না, তবে সরকারের জন্য এটা বুমেরাং হয়ে পড়তে পারে। জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। সরকারি অর্থ, গাড়ি ও পতাকা ব্যবহার করে সরকারি দল নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে পুলিশ ও আমলাদের সহযোগিতায়। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন একটি ঠুনকো মামলায় অসুস্থ হয়ে জামিন বিহীন অবস্থায় রয়েছেন যা দুর্ভাগ্যজনক।

রাজনীতিতে গুণগত মান ফিরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। রাজনীতিতে গুণগত মান আর নাই। টেন্ডার বাণিজ্যে, রিমান্ড বাণিজ্যের মতই রাজনৈতিক অঙ্গনে কমিটি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য, নমিনেশন বাণিজ্য নামক কথাগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও উপেক্ষিত হচ্ছে চুঙ্গা ফুকানো মাঠ থেকে উঠে আসা তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ, অন্যদিকে লাভবান হয়েছে তারা, যাদের চরিত্র বা নীতি বলতে কোনো কিছু নেই। নীতি আদর্শ ও ত্যাগের কোনো বালাই নাই, চেয়ারটি হলেই হলো, ডান কি বাম, উত্তর কি দক্ষিণ, কোনো বাছ-বিচারের বালাই নেই। দেশে রাজনীতির যদি গুণগত মান থাকতো বা বিন্দুমাত্র চলনসই রাজনীতি থাকতো তবে অনেক কিছুই ঘটতে পারতো না। রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধিসহ সুস্থ ধারায় রাজনীতি চালু হলে দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবিদদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের সহযোগিতাও দরকার।

আইন ও নৈতিকতা এক বিষয় নয়। সরকার নিজেকে নির্বাচিত দাবি করে সুবিধামত আইন প্রণয়ন করে নিজ ইচ্ছামাফিক দেশ শাসন করছে। কিন্তু নৈতিকতার মাপ-কাঠিতে সরকার কি নির্বাচিত? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮কে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তরায়’ বলে জাতিসংঘ মন্তব্য করেছে। আইনটিকে অনুমোদন না করার জন্য সাংবাদিক মহল রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে বিলটি রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে আইনে পরিণত হয়েছে(!) এমতাবস্থায়, নৈতিকতা নিয়ে যদি প্রশ্ন তুলি তবে কতটুকু অগ্রসর হওয়া যাবে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি গণতন্ত্রের পরিপন্থী হয় তবে বর্ণিত আইনটি কালো না সাদা আইনের পর্যায়ভুক্ত হবে?

রাজনীতিতে সুস্থ ধারা বা গুণগত মান বৃদ্ধি না হওয়ার পিছনে জনগণের দায়ও কম নয়। দীর্ঘ দিন যাবৎ বঞ্চিত হতে হতে জনগণের একটি অংশ ‘নগদ যা আছে তা হাত পেতে নাও’ নীতিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছে। এ নীতিতে চললে রাজনীতির গুণগত মানে উন্নতি হবে না, বরং বঞ্চিত হবে জনগণ। জনগণের একটি অংশ নির্বাচন এলে আদর্শ ও নীতিবান প্রার্থী খোঁজে না, তাদের টার্গেট থাকে লুটেরাদের দিকে যারা জনগণের টাকা লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অনুশীলন করবে, কিন্তু নিজেদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট থাকবে না, তা হতে পারে না এবং এর অবসান না হলে স্বাধীনতার চেতনা অর্থহীন হয়ে যাবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • ২০ অক্টোবর, ২০১৮, ১:৪৮ এএম says : 0
    কোন কিছুই বদলাবেনা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন