পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুনিয়ার বুকে আল্লাহর এবাদত বন্দেগীর জন্য সর্বপ্রথম নির্মিত বায়তুল্লাহ বা আদিগৃহ কাবার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল যুগে সকল জাতির কাছে স্বীকৃত। ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগেও মিল্লাতে ইব্রাহিমী তথা দ্বীনে হানিফের পবিত্র প্রতীক হিসাবেও ভক্তি-শ্রদ্ধার এবং গর্ব-মর্যাদার প্রধান কেন্দ্র রূপে কাবা পরিগণিত হতো। কিন্তু তৎকালীন খ্রিস্টানরা তার সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মর্যাদা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষত আরবের আশেপাশের ক্ষমতাশালী রোমান খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র খানা-ই-কাবা চক্ষুশূল হয়ে বিরাজ করতে থাকে। তারা বিশ^বাসীর কাছে এর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব-মর্যাদা কীভাবে ক্ষুণ করা যায় সে সম্পর্কে নানা অপকৌশলের কথা চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। অবশেষে তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বাস্তব রূপদান করার অসৎ উদ্দেশ্যে তারা স্থির করে যে, বায়তুল্লাহ শরীফের আদলে একটি কৃত্রিম কাবা (গির্জা) নামে নির্মাণ করা হলে তাদের কুমতলব হাসিল হতে পারে। তারা আবিসিনীয় ইয়েমেনের ‘সানা’ নামক প্রসিদ্ধ নগরীকে এ কাজের জন্য মনোনীত করে এবং সেখানে নির্মিত হয় রোমান খ্রিস্টানদের সেই গির্জা। পবিত্র খানা-ই-কাবার মর্যাদাহানির এই অপচেষ্টা বাস্তবায়নের জন্য খ্রিস্টানরা অঢেল অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এ জন্য বিপুল শ্রমশক্তি নিয়োজিত করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী এই ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনা গীর্জার রূপ ধারণ করার পর তাকেই তারা কাবার পরিবর্তে অর্চনা-উপাসনার কেন্দ্রে পরিণত করে। কিন্তু অচিরেই খ্রিস্টানদের এই গির্জা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেননা প্রকৃত কাবার ভক্ত প্রেমিকরা কাবার এই অমর্যাদা-অবমাননা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তাদের কোনো কোনো লোকের দুঃসাহসী পদক্ষেপের ফলে খ্রিস্টানদের এই ষড়যন্ত্র সূচনাতেই বানচাল হয়ে যায়।
বলা যায় যে, ইসলামপূর্ব এই ঘটনার উল্লেখ পবিত্র কোরআনে সূরা ‘ফীল’ এর মধ্যে রয়েছে। পবিত্র খানা-ই-কাবা দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত আল্লাহর আদিগৃহ, যা তারই ইবাদত-বন্দেগীর জন্য প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই এই খানা-ই-কাবাকে ধ্বংস করে তার পরিবর্তে কৃত্রিম কাবা নির্মাণের ধৃষ্টতার ইতিহাস সকলেরই জানা।
পবিত্র কোরআনে এই ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কে ‘ফীল’ নামক একটি সূরার কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। ‘ফীল’ অর্থ হাতি। যেহেতু আবরাহা তার হস্তিবাহিনীসহ কাবা আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল, তাই সূরাটির নামকরণ করা হয় ‘ফীল’। বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায় যে, আবরাহার শাসনকাল ৫২৫-৫৭০ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সে প্রথমে গভর্নর ও পরে স্বাধীন রাজা হিসেবে ইয়েমেনে শাসন কাজ পরিচালনা করতে থাকে। নাজ্জাশীর সেনাপতি হিসেবে ২৫ বছর বয়সে সে শাসনভার গ্রহণ করে এবং পরে ৭০ বছর বয়সে মক্কা আক্রমণকালে তার হস্তিবাহিনীসহ হারাম শরীফের নিকটবর্তী ‘ওয়াদীয়ে মোহাস্সাবে’ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। তার পূর্ণ নাম ‘আবরাহাতুল আশরাম’। অর্থাৎ নাক কাটা আবরাহা। কোনো যুদ্ধে তার নাক ও ঠোঁট কাটা গিয়েছিল বলে তাকে নাক কাটা আবরাহা বলা হয়। আবরাহা কত বড় ধৃষ্ট ছিল তার বড় প্রমাণ কাবা আক্রমণ করার ঘটনায় প্রমাণিত। এই ঘটনা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাদা মহাত্ম্যা আবদুল মোত্তালেবের আমলের।
এই নরাধম কর্তৃক পবিত্র খানা-ই-কাবা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি এই রূপ: খানা-ই-কাবার জনপ্রিয়তা দেখে আবরাহা তা সহ্য করতে পারলো না, তার হিংসা চরম আকার ধারণ করে। হাজীগণ যে সকল নজরানা ও উপঢৌকন পেশ করে, তা সে নিজেই গ্রহণ করার লোভ সামলাতে না পেরে তার রাজ্যের মধ্যে পবিত্র কাবা গৃহের ন্যায় আর একটি গৃহ প্রস্তুত করতে মনস্থির করে। যথাসময়ে ‘সানা’ নামক স্থানে মর্মরপ্রস্তর দ্বারা নানাপ্রকার কারুকার্য খচিত একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে এবং আবিসিনিয়ার বাদশাহকে (নাজ্জাশি) সে জানায় যে, ‘আমি আপনার জন্য একটি অতি মনোরম গির্জা নির্মাণ করেছি এবং আমি চেষ্টা করছি, আগামীতে যেন আরবের লোকেরা খানা-ই-কাবার পরিবর্তে এই নব নির্মিত গির্জায় এসে উপাসনা, হজ¦, ও তাওয়াফ করে।’
আবরাহা লোকদেরকে কাবা গৃহের পরিবর্তে এই গৃহের তাওয়াফ করতে আদেশ দেয়। এতে কোরেশগণ অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হয়। বর্ণনা অনুযায়ী, তাদের মধ্যে বনি কেনানের এক ব্যক্তি কোনো প্রকারে ঐ গৃহের সেবায় নিযুক্ত হয়। এক রাতে সে গৃহে মল ত্যাগ করে গৃহটিকে অপবিত্র করে পালিয়ে যায়। অপর বর্ণনায়, আরবরা এক স্থানে আগুন জ¦ালিয়েছিল, তার অগ্নি শিখা বাতাসে উড়ে গিয়ে ঐ ইমারতে লাগে। যা হোক, এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে লোকদের এই গৃহ তাওয়াফ করতে ঘৃণা জন্মে। আবরাহা এই সংবাদ শুনে ক্রোধে জ¦লে উঠে; এটা যে কোরেশগণের চক্রান্ত, তা বুঝতে তার বাকি থাকে না। সে অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে শপথ করে যে, এই ঘটনার প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে এবং খানা-ই-কাবা ধ্বংস করতে না পারলে সে তার নাম পরিবর্তন করে ফেলবে।
আরবরা তখন ‘দ্বীনে ইব্রাহিম’ প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেলও তাদের কাছে কাবার মর্যাদা ছিল সবকিছুর ঊর্ধে। আবরাহা যে উদ্দেশ্যে গির্জা নির্মাণ করেছিল, সেই উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। আরবদেরকে আকৃষ্ট করা সম্ভব ছিল না। সে ক্রুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। প্রথমে সে আবিসিনিয়ার রাজার নিকট থেকে হাতি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার সৈন্য বাহিনীকে পবিত্র কাবা আক্রমণের নির্দেশ দেয়। আবরাহা তার বাহিনীসহ কাবা ধ্বংসের জন্য যাত্রা করে মক্কা হতে কিছু দূরে অবস্থিত ‘মোগাম্মাম’ নামক স্থানে পৌঁছে একজন নেতাকে নির্দেশ দেয় যেন সে আরবদের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয় এবং প্রথমে আরবদের পশু পাল ধরে আনতে বলে। ইতোমধ্যেই যেসব আরব গোত্র আবরাহার গতিরোধ করেছিল তাদেরকে সে পরাজিত করে। ঐ সময় কাবার মোতাওয়াল্লী ছিলেন রসূলুল্লাহ (সা.) এর দাদা আবদুল মোত্তালেব। আবরাহা বাহিনী মক্কা অবরোধকালে তার দু’শ উট লুট করে নিয়ে যায়।
যেসব আরব গোত্র তার গতিরোধ করেছিল আবরাহা তাদেরকে পরাজিত করে হারাম শরীফের নিকটবর্তী ‘ওয়াদীয়ে মোহাস্সাব’ নামক স্থানে সৈন্য ও হস্তি বাহিনীসহ অবস্থান করে। আবরাহার নির্দেশে হস্তি বাহিনীকে কাবার দিকে পরিচালিত করা হলে ওরা অগ্রসর না হয়ে থেমে যায়। কোরেশগণ বায়তুল্লাহ শরীফের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করে আবদুল মোত্তালেবের সঙ্গে মক্কার একটি পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং কাবা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহর উপর সমর্পণ করেন। তিনি আবরাহার মক্কায় আগমনের এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে আবরাহার নিকট গমন করেন এবং তাঁর অভিযোগ জানান। আবরাহা তাকে সাদরে স্বাগত জানিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমরা আপনাদের কাবা ধ্বংস করার জন্য এসেছি অথচ আপনি সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না, আপনার উট ফেরত চাচ্ছেন।’ আবদুল মোত্তালেব জবাবে বলেন, ‘উট আমার, আমি সেগুলোর মালিক। এ জন্য সেগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি এসেছি। কাবার ব্যাপার হচ্ছে, এর মালিক অপর কেউ, তিনিই এর হেফাজত করবেন।’ এতে আবরাহা স্তম্ভিত হয়ে তাঁর উটগুলো ফেরত দেয়।
এ কথাবার্তার পর আবদুল মোত্তালেব তাঁর কতিপয় সঙ্গীসহ খানা-ই-কবায় আগমন করেন এবং দোয়া করতে থাকেন। এই সময় তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। কবিতার মর্ম হচ্ছে; ‘হে আল্লাহ! বান্দা তার নিজের ঘর রক্ষা করে থাকে, তুমিও তোমার ঘর রক্ষা কর।’ আবদুল মোত্তালেব দোয়া করে তার সাথী সঙ্গীগণসহ পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বর্ণিত আছে, দ্বিতীয় দিন ভোরে আবরাহা বাহিনী কাবা ধ্বংসের জন্য অগ্রসর হয় এবং সঙ্গে আনা হাতিগুলোও অগ্রসর হয়। হাতিগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হাতিটি সকলের আগে আগে চলছিল। কাবা গৃহের অতি সন্নিকটে উপস্থিত হয়েই মাহমুদ নামের হাতিটি হঠাৎ আপন সৈন্যগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাদেরকে পদদলিত করে পশ্চাৎ দিকে ধাবিত হতে লাগল। অন্যান্য হাতিও তাদের প্রধান সেনাপতি মাহমুদের অনুসরণ করে। হস্তি চালকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওদেরকে কাবামুখী করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। আবরাহা বিফল মনোরথ হয়ে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করতে লাগল। কোরেশগণ পাহাড়ের উপর হতে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের দিক হতে সবুজ বর্ণের ঘাড় বিশিষ্ট একদল কৃষ্ণ বর্ণের পাখির আবির্ভাব ঘটল। ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে উড়ে আবরাহার সৈন্যদের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরকণা বর্ষণ করতে লাগল।
প্রতিটি পাখি (আবাবীল) তার চঞ্চুতে একটি এবং দুই পায়ে দুইটি, এই তিনটি প্রস্তর খণ্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। ঐ প্রস্তর খণ্ডের এক একটির উপর কাবাগৃহ আক্রমণকারী এক একটি সৈনিকের নাম লেখা ছিল। যে পাথরে যার নাম ছিল, সেই পাথরই তার মস্তকে পতিত হয়েছিল। প্রস্তরখণ্ড মস্তকে পতিত হয়ে শরীর ভেদ করে অপরদিক দিয়ে নির্গত হয়েছিল। এভাবে আবরাহার সমস্ত সৈন্য ধ্বংস হয়ে যায়। পরে একইভাবে আবরাহারও পতন ঘটে বলে বর্ণিত আছে।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আবরাহা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা কত ছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও মতে সৈন্য সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। মাহমুদ নামক হাতিটি আবরাহার বিশেষ সোয়ারী ছিল। অবশ্য প্রাচীন আরব কবিদের রচনায় আবরাহার সৈন্যসংখ্যা ষাট হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কবির মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে জারারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল আরিয়াত সত্তর হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল। এ জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, আরব কবির বর্ণনায় আশ্চর্যের কিছু নেই। কেননা সৈন্য সংখ্যা উক্ত কবির মতে সঠিক। কারণ আবরাহা ছিল আরিয়াতের নায়েব ও হত্যাকারী, সে ইয়েমেনে দশ হাজার সৈন্য রেখে ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কায় এসেছিল। এই ষাট হাজর সৈন্যের মধ্যে কেউ রক্ষা পায়নি, সকলেই নিহত হয়েছিল। কেউ কেউ মুমূর্ষ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করলেও শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।