Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জবাবদিহিহীনতার মধ্যে বসবাস

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম


‘জবাবদিহিতা’ শব্দটি মনে হয় অভিধান থেকে উঠেই যাবে। কারণ যে যে দায়িত্বেই থাকুক না কেন, হোক সাংবিধানিক বা নিম্ন পর্যায়ের, সকলেই যেন এখন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। প্রজাতন্ত্রের যারা কর্মচারী বা কর্মকর্তা তারা সীমাহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়োগকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য মিথ্যাকে সত্যে এবং সত্যকে মিথ্যা বলে নির্দ্বিধায় জনগণকে বঞ্চিত করছে ন্যায্য অধিকার থেকে।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ‘তেলের বাটি’ যেন একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি। কর্তা খুশি তো সব খুশি, এ বিবেচনায়ই চলছে প্রশাসনসহ সার্বিক ব্যবস্থা। ব্রিটিশ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্লু ব্লাড বা নীল রক্তের অধিকারী একটা সমাজ রয়েছে, যে সমাজের লোকজনদের জন্য আইন ও আইনের শাসন অনেক শিথীল থাকে। বাংলাদেশেও একটি ব্লু ব্লাড বা নীল রক্তের অধিকারী সমাজ সৃষ্টি হয়েছে, যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে। ব্লু ব্লাডের প্রতিনিধি ও রক্ত কণিকা ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী, যারা ব্যবসা, বাণিজ্য, ঠিকাধারী, সর্দারী, মাতব্বরী সবই নিয়ন্ত্রণ করে এবং যাদের সেবাদাস হিসাবে সদা প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ ও প্রশাসন। ব্লু ব্লাডেরা যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেহেতু সুবিধা সন্ধানী ও সুবিধাভোগীরা তাদের পক্ষেই হাত তালি দিচ্ছে, যোগান দিচ্ছে সমস্ত শক্তি এবং লুটে খাচ্ছে সাধারণ জনগণের আহার, বিপদগ্রস্থ হচ্ছে তারা যারা বিবেকের তাড়নায় ভোল পাল্টিয়ে ব্লু ব্লাডের পদতলে নিজেকে আত্মহুতি দিতে পারছে না।

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের বেতন ভাতা চলে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে, কিন্তু তারা ব্লু ব্লাডের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। অথচ সংবিধান বলছে যে, [অনুচ্ছেদ ২১(২)] ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ অথচ নিম্ন বর্ণিত ঘটনা থেকেই উপলব্ধি করা যাবে, জনগণের বেতনভুক্ত আমলাতন্ত্র দল মত নির্বিশেষে জনগণকে কতটুকু সেবা দিয়ে যাচ্ছে? ঘটনাটি হলো একদিন (চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস) সুপ্রিম কোর্টের একজন স্বনাম ধন্য ব্যারিস্টার গাজীপুর জেলার সাভারে গিয়েছিলেন তার একটি ব্যক্তিগত কাজে। হঠাৎ একটি ট্রাক উল্টো পথে এসে গাড়িটিকে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ায় তিনি নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার শরনাপন্ন হলে ও.সি সাহেব ব্যবহারটা এমন করেন যে, মামলা নেয়া তো দূরের কথা ব্যারিস্টার সাহেবকে ও.সি সাহেব পাত্তা না দিয়ে পাল্টা তার (ব্যারিস্টারের) দোষ খুঁজতে থাকেন। ব্যর্থ মন নিয়ে পরের দিন ব্যারিস্টার সাহেব শরনাপন্ন হলেন এক দূর সর্ম্পকীয় মামার, যিনি পুলিশের একজন ডি.আই.জি (পুলিশের উপ-মহা পরিদর্শক)। ডি.আই.জি ফোন করে ব্যারিস্টার সাহেবকে সহযোগিতা করার জন্য ও.সি’কে বলে দিলে ব্যারিস্টার সাহেব পরের দিন থানায় পৌঁছা মাত্র ও.সি সাহেব এগিয়ে এসে ব্যারিস্টার সাহেবকে বলেন যে, ‘আপনি তো আমার মামা লাগেন, এখন বলেন আপনার জন্য আমি কী কী করতে পারি?’ তখন ও.সি ট্রাক ড্রাইভার ও মালিককে ডেকে এনে নগদ ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেন। ফলে ব্যারিস্টার সাহেবকে মামলা করতে হলো না, কোর্টে যেতে হলো না, নগদ নগদেই বিচারটা পেয়ে গেলেন, শুধু মাত্র ব্লু ব্লাডের (ডি.আই.জি) একটি টেলিফোনের কারণে। দুর্ভাগ্য এই জাতির! যার কোনো ব্লু ব্লাডের রেফারেন্স নাই সে এখন সর্বহারা, মার খেয়ে বিচার পাবে না, অথচ রেফারেন্স থাকলে খুনীও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, নিজে আত্মতৃপ্তি লাভ করবে, অথচ খুনিকে খুনী বলা যাবে না, এটাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।

বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলা হয় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই। এর জন্য দায়ী কে? বিচারকরা নিজেই যদি নিজের মেরুদন্ড সোজা রাখতে না পারেন তবে আইন করে তাকে কতটুকু সোজা রাখা যাবে? দেশব্যাপী এখন সরকার কর্তৃক পুলিশকে বাদী করে গায়েবি মোকদ্দমা হচ্ছে। গায়েবি মোকদ্দমা অর্থাৎ যেখানে কোন ঘটনা ঘটে নাই, মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী সাজিয়ে প্রতি থানায় প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে যেখানে মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এমন কেউই গায়েবি মামলা অর্থাৎ গায়েবি গজব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় যে, সেপ্টেম্বর/২০১৮ মাসে দেশব্যাপী গায়েবি মামলার সংখ্যা ৪,০৯৬ যার মধ্যে এজাহার নামীয় আসামী ৮৪,৫৩৫ জন, অজ্ঞাত রয়েছে ২৭,৩০৭৫ জন। দন্ডবিধির ১৭৭ ধারা থেকে ২২১ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা মামলা, মিথ্যা স্বাক্ষ্য প্রদান, মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান প্রভৃতি অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান থাকা স্বত্তে¡ও পুলিশ জেনে শুনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কীভাবে মিথ্যা ও মিথ্যা গায়েবি মামলা সৃজন করছে? সরকারের আমলা বা পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তার দায়িত্ব কি মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করা? পুলিশ কি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে?

এ দেশের একটি বুদ্ধিজীবী সমাজ রয়েছে। জাতির ক্রান্তি লগ্নে জাতির পাশে তারা এগিয়ে আসবেন এটাই জাতির প্রত্যাশা। কিন্তু তারাও এখন দলবাজিতে ব্যস্ত। সম্প্রতি পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সম্পর্কে তাদের ঐক্যবদ্ধ কোন ‘রা নাই’। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কুফল সম্পর্কে সরকারি ঘরনার হাই প্রো-ফাইল বুদ্ধিজীবীরা এখন নিরব নিস্তব্দ। এটাই স্বচ্ছতা? এটাই কি গণতন্ত্র?

গণমানুষের জানমালের নিরাপত্তা এবং গণমানুষ রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের ভয়ের ঊর্ধ্বে থাকবে, এটাই গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজের দাবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গণমানুষ, যারা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী তারা এখন ভয়ে সবচেয়ে বেশি কাতর থাকে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনাকারীদের যেখানে আশ্রয় পাওয়ার কথা তারা কি সেখানে তা পাচ্ছে?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জবাবদিহি


আরও
আরও পড়ুন