Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভূখণ্ডগত কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখতে নদীভাঙন রোধ করতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

এবারের মতো নদী ভাঙনের ভয়াবহতা বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। নদী ভাঙন এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, বাড়িঘর, কৃষিজমি, হারিয়ে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেক বনেদি পরিবার সহায়-সম্বলহীন হয়ে ভাসমান হয়ে গেছে। ভাঙনের তীব্রতায় ভূখণ্ডগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন ভাঙনের ভয়াবহ রূপ তুলে ধরা হলেও এর প্রতিকারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সামনে নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ এবং ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। দুর্গত ও নিরাপত্তাহীন মানুষ নিয়ে তাদের কথা বলার সময় নেই। তাদের মধ্যে একে অপরকে কিভাবে অপ্রাসঙ্গিক ও অতীত ইতিহাস তুলে ধরে ঘায়েল করা যায়, এ নিয়ে তর্কযুদ্ধ চলছে। নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে ভয়াবহ বিপদে পড়া মানুষের দুর্দশা নিয়ে কারোই তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।
দুই.
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো আশীর্বাদ হলেও এখন তা রীতিমত অভিশাপ হয়ে উঠেছে। শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশ-প্রতিবেশকে শুকিয়ে মারছে, অন্যদিকে বর্ষায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। এজন্য আমরা যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রতিবেশি ভারত। প্রধান নদ-নদীসহ ৫৪টি নদী ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত তার অংশে একের পর এক বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ ক্যানেল ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, আবার বর্ষায় বাঁধের সব স্লইস গেট খুলে দিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি এমন যে, ভারতের খেয়াল-খুশির উপর বাংলাদেশের পানি পাওয়া-না পাওয়া নির্ভর করছে। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে চুক্তি এবং পানি পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এর ফল কবে পাওয়া যাবে, তা অনিশ্চিত। এ সমস্যার সমাধান কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা, তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। জনগণ এক প্রকার ধরেই নিয়েছে, এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হওয়া দূরস্ত। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদেরকেও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বন্যায় যাতে ডুবে যেতে না হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে মরতে না হয়, এই ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে জলোচ্ছ¡াস ও বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাঁধ নির্মাণের উপর জোর দেয়া হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও নদীর তীর রক্ষা বাঁধ রয়েছে। প্রায় অর্ধশতাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন নতুন বেড়িবাঁধ ও নদীর তীর রক্ষার কাজ করা হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেয়া মোট বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যয় হয় এসব বাঁধ ও নদী তীর রক্ষার কাজে। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানির যে সংকট দেখা দেয়, তার জন্য কোন ব্যবস্থাই করা হয় না। অর্থাৎ নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে বন্যা থেকে বাঁচার উপায় এবং বন্যার পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে কাজে লাগানোর কোনো প্রকল্প নিতে দেখা যায় না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে মহাপরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও তার বাস্তবায়ন কবে হবে, তা অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে। এক সময় গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণ বা ধরে রাখার জন্য বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের কথা শোনা গিয়েছিল। এ নিয়ে বাজেটও করা হয়েছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর বাস্তবায়ন হলে কি কি উপকার হতে পারে, তা নিয়েও একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। রাজবাড়ির পাংশা থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকবে ২৯শ’ মিলিয়ন মিটার কিউব পানির বিশাল রিজার্ভার। শুষ্ক মৌসুমে এই রিজার্ভার থেকে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক পানি ৮টি সংযোগ খালের মাধ্যমে ছাড়া হবে। এর ফলে গঙ্গা নির্ভর ১৬টি নদী শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা ফিরে পাবে। একই সাথে গঙ্গা অববাহিকা নির্ভর ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি সরাসরি সেচের আওতায় আসবে। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য হবে দুই কিলোমিটারের উপরে। এর গেইট থাকবে ৯৬টি। থাকবে একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখান থেকে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এই ব্যারেজের মূল কাজ হচ্ছে, এর মাধ্যমে সারা বছরই পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যা দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে বিপ্লব সাধিত হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা থেকে শুরু করে মরুময়তা ও লবনাক্ততা থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকা মুক্ত থাকবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এ প্রকল্প বাস্তবায়নেও ভারত আপত্তি জানিয়েছে। অর্থাৎ ভারত নিজেও আমাদের পানি দেবে না, আবার আমাদেরকেও পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে দেবে না। অথচ ভারত ইতোমধ্যে তার অংশের নদ-নদীতে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি পানির রিজার্ভার গড়ে তুলেছে। তাদের অংশের এক ব্র‏হ্মপুত্র নদীতেই ৩৩টি রিজার্ভার গড়ে তোলার মাধ্যমে ৫০ লাখ কিউসেক পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যান্য নদীতেও এরকম আরও অনেক রিজার্ভার গড়ে তুলছে। এসব রির্জাভার পরিপূর্ণভাবে চালু হলে বাংলাদেশের কি অবস্থা হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। পানি প্রাপ্তির বিষয়টি পুরোপুরি তার খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করবে। মনে চাইলে দেবে, না চাইলে দেবে না। আমাদেরকে তার খেয়াল-খুশির ওপর নিয়ে গেছে। তার আচরণ এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের দেশই দখল করে নিতে চায়। সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বলেই ফেলেছেন, বাংলাদেশের শাসন দিল্লী নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে নিয়ে আমাদের সরকার ও বিরোধী দল থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের কারো মুখ থেকে কোনোরূপ প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আমাদের জন্য আর কী হতে পারে! ভারত এখন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে যা খুশি তা বলে বেড়াচ্ছে। অনেকটা যেন ছিনিমিনি খেলছে। তার আচরণে পরিলক্ষিত হচ্ছে, সে আমাদের ন্যায্য পাওনা তো দেবেই না, উল্টো বাংলাদেশই তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে।
তিন.
এবার আভ্যন্তরীণ নদী ভাঙনের পাশাপাশি সীমান্ত নদীর ভাঙনও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এতে একদিকে যেমন দেশের আভ্যন্তরীন ভৌগলিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্ত নদীর ভাঙনে মানচিত্রও বদলে যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পদ্মার ভাঙনে রাজশাহীর পবা উপজেলার চর খানপুর ও চর খিদিরপুর মৌজা বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। চর দু’টি বিলীন হলে আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী পদ্মায় বাংলাদেশের অংশে প্রবেশের সুযোগ পাবে। ইতোমধ্যে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বিজিবি’র একটি বর্ডার আউট পোস্ট, ঘরবাড়ি, আবাদি জমি ও গাছপালা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আশংকা প্রকাশ করেছে, চর দুটিতে যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তা রোধ করা না গেলে পদ্মার অর্ধেক অংশের নিয়ন্ত্রণ বিএসএফ-এর হাতে চলে যাবে। তখন বাংলাদেশিদের চলাচলে তারা বাধা দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী বিএসএফ তা করতে পারে। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী, দুই দেশের সীমান্ত নদীর মাঝ¯্রােত বরাবর সীমান্ত রেখা টানা হয়। দেখা যাচ্ছে, পদ্মাসহ দেশের অন্যান্য সীমান্ত নদীর ভাঙনের ফলে নদীর স্রোতধারা বাংলাদেশের দিকে ক্রমশ এগুচ্ছে আর ভারতের দিকে চর জাগছে। ভারত এসব জেগে উঠা ভূখণ্ড রক্ষা এবং তাদের অংশে ভাঙন রোধে বাঁধ দিচ্ছে। শুধু পদ্মাই নয়, সীমান্ত সংলগ্ন সুরমা, কুশিয়ারা, ইছামতি ও অন্যান্য নদীর ভাঙনেও বাংলাদেশ ভূখণ্ড হারাচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চার দশকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর ভাঙনে দেড় লাখ হেক্টর জমি হারিয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের চেয়ে বেশি। এর বিপরীতে চর জেগেছে মাত্র ৫৩ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ প্রতি বছরই নদ-নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এই ভাঙন রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না। যেসব উদ্যোগের কথা শোনা যায়, তা বলতে গেলে নামকাওয়াস্তে নেয়া হয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকায় যেসব বাঁধ নির্মাণ ও ভাঙন রোধের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলোর নির্মাণ ও স্থায়িত্ব এত কম যে নদীর পানির স্রোত ঠেকানোর মতো সক্ষমতা নেই। কোন কোন এলাকায় বাঁধগুলো বালির বাঁধে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রতি বছর বাঁধগুলো পুননির্মাণ ও সংস্কারে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশজুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে নদীভাঙন ও বন্যা মোকাবেলার বাঁধ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ভেঙে যায় সেই বাঁধ। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কারের নামে পায় শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ। শুরু হয় দায়সারা কাজ। সীমাহীন গাফিলতি ও টাকা লুটপাটের ফলে নড়বড়ে বাঁধ বন্যা এলেই ভাঙতে থাকে। হাজার হাজার কোটি টাকা পানিতেই ভেসে যায়। মানুষের ভোগান্তি আর কমে না। আক্ষরিক অর্থেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী ভাঙন ঠেকানোর অধিকাংশ বাঁধ ‘বালির বাঁধ’-এ পরিণত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের জন্য বাঁধগুলো অর্থ লুটপাটের একটি স্থায়ী উৎসে পরিণত হয়েছে। একে দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে ব্যবসা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! দায়সারাগোছের কাজের ফলাফল দেখা গেছে এবারের বন্যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা কবলিত এলাকায় পানির প্রবল স্রোতে বাঁধ ভেঙ্গে শত শত গ্রাম, ফসলি জমি, গবাদি পশু তলিয়ে গেছে। নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, কৃষি জমি ও জনপদ। নদী ভাঙন শুধু ভূখণ্ডগত কাঠামো পরিবর্তন নয়, হাজার হাজার মানুষকেও উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে। পরিবার নিয়ে কৃষক ও কাজের লোক বেকার হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাষ্ট্র কীভাবে করবে? ব্যবস্থা নিলেও তার চাপ কি অর্থনীতিতে পড়বে না? অর্থনীতির ভাষায়, দেশে একজন লোকও যদি বেকার থাকে, তবে তার ভরণপোষণের চাপ পরিবার থেকে রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর পড়ে। আর রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অবহেলায় যদি কর্মক্ষম হাজার হাজার কৃষক ও ব্যক্তি বেকার হয়, তবে তাদের কর্মসংস্থানের চাপ অর্থনীতির উপর কি পরিমাণ পড়ে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন দেখছি, এবারের বাঁধ ও নদী ভাঙনে অসংখ্য মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে সেই স্বপ্নের উপর পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এত বড় ক্ষতির দায় কে নেবে? এই দায় কি বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্বে নিয়োজিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঐসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদার নেবে? তাদের দুর্নীতি, গাফিলতি ও করি-করছি মনোভাবের কারণে দেশের মানচিত্র বদলে যাওয়া, আভ্যন্তরীণ ভূখণ্ড হারানো এবং মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া কি কোনোভাবেই বরদাস্ত করা উচিত? এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জিডিপি’র ১.৮ শতাংশ হারাচ্ছে। ১৯৭০ সালের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ ৫ গুণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে ৯ গুণ। আর কয়েক বছর আগে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট অনুযায়ী, দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশ কতটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাস ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সরকার ৫০ থেকে ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান অচিরেই প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। সরকারের এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এসব পরিকল্পনা যে মন্ত্রণালয় এবং যেসব প্রকল্প বিভাগ বাস্তবায়ন করবে, তাদের আন্তরিকতা ও সততা এবং যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি কঠোরভাবে যদি মনিটর করা না হয়, তবে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার নিয়ে চলমান প্রকল্পগুলোতে এর নজির রয়েছে। বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও যথাসময়ে সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল উল্লেখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব।
চার.
বন্যার্তদের ত্রানকার্যক্রম ও পুনর্বাসনের কাজের প্রধান দায়িত্ব সরকারের হলেও সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসহ এনজিও, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিত্তবানদের মধ্যে মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া অপরিহার্য। বাঁধ ও নদী ভাঙনের যে ভয়াবহতা ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য ও গাফিলতি কাম্য নয়। তাদেরকে যথাসময়ে যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এই নির্মাণ ও সংস্কার যাতে স্থায়ী হয়, বালির বাঁধে পরিণত না হয়, এজন্য কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে এবং দুর্বলভাবে নির্মিত হয়েছে, কেন এমন হলো, এ নিয়ে সেসব এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার এবং নদী ভাঙন রোধ প্রকল্প নিয়ে বছরের পর বছর ধরে কিছু লোকের অসৎ বাণিজ্য চলতে পারে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু বাঁধ নির্মাণ করলেই হবে না, বন্যার পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে শুষ্ক মৌসুমে কাজে লাগাতে হবে। পানির রিজার্ভার গড়ে তুলতে হবে। এজন্য, নদীর নাব্যতা বজায় রাখার কার্যক্রম জোরদার, খাল খনন কর্মসূচি, লেক, হাওর-বাওর, বিল-ঝিল-পুকুর সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগ সফল করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষদের উদ্বুদ্ধ ও কাজে লাগাতে হবে। এতে যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, তেমনি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে ক্রাইসিস ব্যবস্থাপনার চেয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ১ ডলার ব্যয় করলে ১০ ডলার পরিমাণ সম্পদ রক্ষা পায়। অর্থাৎ ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আগে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। বাংলাদেশে বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেয়াই যথার্থ এবং সময়োপযোগী।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদীভাঙন

৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন