Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষ

চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে বসতভিটা : দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় দ্বিতীয় দফায় ভাঙন শুরু

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ঘুম ভাঙার আগেই ভেঙে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটা-জমিজমা সব। ভাঙনের শব্দে ঘুম ভাঙছে পদ্মা-যমুনা-তিস্তা আড়িয়াল খাঁ এসব নদী পাড়ের মানুষের। সকালে যাদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা ছিল, সন্ধ্যায় নদীগর্ভে সব বিলীন হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। স্কুল, মাদরাসা, মসজিদসহ নানা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী আগ্রাসী রূপ ধারণ করছে। নদীপাড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। টাঙ্গাইলে যমুনা ও ঝিনাই নদীর ভাঙনে তিন শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুন্সীগঞ্জে পদ্মার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতবাড়িসহ ফসলি জমি। মাদারীপুরে আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে দিশেহারা মানুষ। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পদ্মা পাড়ের কয়েক শত অসহায় পরিবারের। নিরুপায় হয়ে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যেতে হচ্ছে এ সকল মানুষের।
লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলার প্রবল ভাঙনে প্রায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, আবাদিজমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। কুড়িগ্রামে তিস্তার গাবুর হেলান, খিতাবখা, ধরলার সারডোব, পাটেশ্বরীসহ কয়েকটি পয়েন্টে নদীভাঙন তীব্র হয়েছে। সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সারা দেশের নদীভাঙন নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা : যমুনা ও ঝিনাই নদী তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার চরাঞ্চলে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ তিন শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরিভাবে ফেলা জিওব্যাগও যমুনার করাল থাবা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যমুনার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিতে চারটি ও ঝিনাই নদী তীরবর্তী একটি উপজেলায় ইতোমধ্যে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, কালিহাতী, নাগরপুর, ভূঞাপুর ও বাসাইল এই পাঁচটি উপজেলায় যমুনার ও ঝিনাই নদীর পানি কমতে থাকায় নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের ভালকুটিয়া এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেশি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, চরপৌলী হাটখোলা সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, যমুনা নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে। জেলার নদী তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার নদীপাড়ে ভাঙনে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। যমুনাপাড়ের ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ রিক্ত, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের গুনেরগাতী, বেলকুচি, এনায়েতপুর, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী পাচিল শরিফমোড় গ্রাম ও কাজিপুর সদরে আবারো নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যমুনার ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জ চৌহালী উপজেলার দক্ষিণাঞ্চল রক্ষায় পাউবোর জরুরি নদী তীর সংরক্ষণ এলাকায় ভাঙন অব্যাহত গতিতে চলছে। এনায়েতপুর এলাকা প্রায় ৫শত’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হুমকীর মুখে পড়েছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙনে লৌহজং ও টংগীবাড়ী উপজেলার বসতবাড়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্ব এবং ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে শতাধিক পরিবার। লৌহজংয়ে শতবর্ষী ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। লৌহজং উপজেলার খড়িয়া, উত্তর মেধীনীমন্ডল, কান্দিপাড়া, তেউটিয়া, গাওদিয়া ডহুরীসহ শিমুলিয়া-বাংলা বাজার ফেরিঘাট এলাকায় পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে। কামারখাড়া, হাসাইল, মূলচর, কান্দারবাড়ী, বাঘবাড়ী এলাকার অর্ধ-শতাধিক বসত বাড়ী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, হঠাৎ করে আড়িয়াল খাঁ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মাদারীপুরের শিবচরের কলাতলা-শিরুয়াইল নদীভাঙন শুরু হয়েছে। নদীর ভাঙন তীব্র হয়ে ওই এলাকার রাস্তাঘাটসহ বেশকিছু জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, প্রায় অর্ধশত বিঘা ফসলি জমি। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, বসতবাড়ি, মসজিদ ও কবরস্থানসহ হাটবাজার।
লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, বর্ষা মৌসুমে তীব্র ভাঙনে দিশেহারা লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষ। তিস্তা ও ধরলার প্রবল ভাঙনে প্রায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, আবাদিজমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে বাঁধসহ নানান স্থাপনা। তিস্তার ভায়াবহ ভাঙনে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কুটিরপাড়, বালাপাড়া, বাদিয়ারটারী ও চৌরাহা গ্রামে বিলীন হয়েছে ২০টি পরিবারের বসতভিটা। এছাড়া অর্ধশত বসতভিটা ও শতাধিক একর আবাদিজমি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় মোগলহাটের ফলিমারী এলাকায় ধরলা নদীর ডান তীরে গত তিন দিনে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। নদীগর্ভে চলে গেছে বসতভিটা ও ভুট্টাসহ অর্ধশত বিঘা আবাদিজমি। গৃহহারা হয়েছেন অনেক পরিবার। অসহায় পরিবারগুলো স্থানীয় বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়ে আছেন।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, ধরলার ভাঙনে সারডোবে বিকল্প বাঁধের অবশিষ্টাংশ ভেঙে পানি ঢুকে ভাটিতে থাকা ১৫টি গ্রাম নিমজ্জিত হয়েছে। এসব এলাকার গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগ। পানি বাড়ার ফলে তিস্তার গাবুর হেলান, খিতাবখা, ধরলার সারডোব, পাটেশ্বরীসহ কয়েকটি পয়েন্টে নদীভাঙন তীব্র হয়েছে। সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ সংবাদদাতা জানান, পদ¥ার ভাঙনে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পদ্মা পাড়ের কয়েক শত অসহায় পরিবারের নিরুপায় হয়ে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যেতে হচ্ছে। সদর উপজেলার মিজানপুর ও বরাট ইউনিয়নের গোদারবাজার অংশে কংক্রিট দিয়ে নির্মিত সিসি ব্লকের ১৫০ মিটার অংশে ব্যাপক ভাঙনের পর গতকাল সকালে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ফেরিঘাট এলাকায় দ্বিতীয় দফায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে নদী তীরবর্তী প্রায় ৩০মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। হুমকির মধ্যে রয়েছে শত শত বসতবাড়ি। ভাঙন আতঙ্কে নদীপাড় থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি। ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সরেজমিনে সকালে দৌলতদিয়া এলাকায় দেখা যায়, দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট ও ১নং ফেরিঘাট এলাকায় মজিদ শেখর পাড়ার ৩০মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হওয়া ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। দৌলতদিয়া ইউনিয়নের মজিদ শেখের পাড়ার থেকে আবু মেম্বার, আবুল মন্ডল, সোহেল মুন্সী, মোকছেদ মন্ডল, উজ্জল সরদারের বাড়িসহ বেশকিছু বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছে। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজিজুল হক খান মামুন, গোয়ালন্দ পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম মন্ডল, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম। স্থানীয় বাসিন্দা চাঁন্দু মোল্লা বলেন, অব্যাহত পদ্মার ভাঙন রোধে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি ভাঙন রোধে কাজ করা হবে কিন্তু কিছুই হয়নি। স্থানীয় হানেফ মন্ডল বলেন, কয়েক বছর পূর্বে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে ছিল পদ্মা নদী। সেখান থেকে শুনে আসতেছি ভাঙন রোধে কাজ শুরু হবে। বালুর বস্তা ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদীভাঙন

৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ