Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

অলিউর রহমান ফিরোজ | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

পৃথিবী একটা গ্রিনহাউজরে মতো। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও অপরাপর গ্রিনহাউজ গ্যাস সূর্যের আলোতে উত্তপ্ত তাপ বায়ু মন্ডলে আটকিয়ে রাখে। আর এর ফলে পৃথিবীর জীবনের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে। যদি গ্রিনহাউজ প্রভাব না থাকতো তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা থাকতো মাইনাস ১৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। বায়ুমন্ডলে তাপ বৃদ্ধি পাওয়া এখন মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ অনেক সময় আয়নার মতো কাজ করে থাকে। এর ওপর পতিত আলো ৯০% বায়ু মন্ডলে ফিরে যায়।আর যতোটুকু অবশিষ্ট থাকে তার আবার ৯০% ভাগ শোষন করে পানি। পানি আবার এই তাপ শোষন করে বরফ গলিয়ে দেয়। অপরদিকে প্রতি বছর মানবসৃষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইডের ৫০% শোষণ করে মহাসাগরের পানি। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এই পানি গরম হলে তা ক্রমহ্রাসমানভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষন করে এবং উপরিতল এবং গভীরতল পানির মিশ্রণে বাধা তৈরি করে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর দ্রæততর হয়। অপরদিকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে মিথেনের গ্রিনহাউজ তীব্রতা ২০ গুণেরও বেশি। সাইবেরিয়া অঞ্চলে ১০ বিলিয়ন টনের বেশি সঞ্চিত জৈববর্জ্য বিপুল পরিমান মিথেন ধারন করে আছে। যা বর্তমান সময়ের মনুষ্যসৃষ্ঠ ৭০ বছরের গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের সমান। তাই সাইবেরিয়ার বরফ গলে যায়ার কারণে নির্গত মিথেন ধরে রাখার কোন উপায় নেই। তাই এই মিথেন বায়ুমন্ডলে আবার ফিরে যাচ্ছে।

বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান প্রতি ১০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) বৃদ্ধির সাথে সাথে তাপ মাত্রা বৃদ্ধিপায় গড়ে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যা বরফ যুগের সাথে উষ্ণ যুগের তাপমাত্রার পার্থক্য। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৭৫০ সালের আগে ছয় লাখ বছরের বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ১৮০ থেকে ৩০০ পিপিএম ছিল, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৩৭৯পিপিএম; মিথেন ছিল ৩২ থেকে ৭৯০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন), ২০০৫ সালে তা হয়েছে ১৭৭৪ পিপিবি; নাইট্রাস অক্সাইড ছিল ২৭০ পিপিবি, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৩১৯ পিপিবি। বায়ুমন্ডলে এসব গ্যাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মিথেন ও নাইট্রাসসহ অন্যান্য গ্যাস হিসাব করলে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩০ পিপিএম কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট। ধারাবাহিকভাবে এভাবে গ্যাস বৃদ্ধি থাকলে বায়ু মন্ডলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৫০ থেকে ৭০০ পিপিএম কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট এবং ২১০০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৫০ থেকে ১২০০ পিপিএম কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট। গ্রিন হাউজ গ্যাসের এ প্রবণতা চলতে থাকলে ২১০০ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এমনকি তা বেড়ে ৪ ডিগ্রী থেকে ৬.৪ ডিগ্রীতে পৌছতে পারে। এমনিতেই পৃথিবী এখন উষ্ণতম সময় পার করছে। তার ওপর যদি শিল্পায়নের কবলে পড়ে গ্রিন হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধির ধারবাহিকতা চলতে থাকে তাহলে মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞে সূচনা ঘটতে পারে। ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা কমপক্ষে ১৮ থেকে ৩৮ ডিগ্রী সেন্টিমিটার এমনকি তা ২৬ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গড় তাপমাত্রা, তাপদাহ ও তীব্র বৃষ্টিপাত বাড়বে ব্যাপকভাবে। তাছাড়া খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্রাস, টাইফুন ও হ্যারিকেনসহ মৌসুমী ঘূর্ণীঝড়ের ব্যাপকতা এবং উঁচু জোয়ারের প্রচন্ডতা বাড়বে তীব্রভাবে। আর্কটিক ও এন্টার্কটিকার বরফ দ্রæত কমে আসবে ও গ্রীষ্ম কালে তা বিলোপ পাবে। তাই গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিরাপদ মাত্রা ৩৫০ পিপিএম-এ নামিয়ে আনতে হবে। না হলে পৃথিবীর অপরিমেয় এবং অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত সংকট এখন আমাদেরও ঘিরে ধরেছে। আমাদের উপক‚লীয় ১০ জেলা রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা। বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিন এশিয়ার জলবায়ু বিষয়ক এক প্রতিবেদনে জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। জলবায়ুর কারণে, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বদলে গেছে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরন। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের ক্ষতিগ্রস্থ হয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জন সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তবে বড় ধরনে শঙ্কার কথা হলো এই যে, জলবায়ুর প্রভাবে কয়েক বছর ধরে আমাদের আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তার মধ্যে বজ্রঝড় অন্যতম। প্রতি বছরই শত শত মানুষ বজ্রঝড়ে নিক্ষিপ্ত বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে অবলীলায়। তাছড়া আকস্মিক পাহাড়ী ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়াও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন ঘটছে। হাওরাঞ্চল ডুবে যাওয়ায় খাদ্যে ঘাটতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেখানকার কৃষকদের। ২০০৭ সালে সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকরী সিডর আমাদের দেশের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে গেছে। বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চল সবচেয়েু বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল। ফসলের ক্ষতির সাথে সাথে ব্যাপক হারে মানুষ এবং গবাদী পশুর মৃত্যু হয়েছিল। তার ভয়াবহতার চিহ্ন আজো মানুষ বহন করে চলেছে। অপরদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতার দরুন এখন নদ-নদী ভাঙনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাতে ব্যাপক লোক বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ছে। তারা এখন শহরমুখী হয়ে শহরের বোঝায় পরিণত হেেচ্ছ।

গত দুই দশকে জলবায়ুর প্রভাবে দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ। ১৯৮০ দশকে দুর্যোগের ঘটনা ছিল ১২০টি। সেখানে বর্তমানে পৌঁছেছে ৫০০ উপরে। বন্যা বেড়েছে ৬ গুণ। বন্যা ও ঝড় ৬০টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪০টিতে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ লোক সংখ্যা ছিল ১৭৪ মিলিয়ন, ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে তা দাঁড়িয়েছে ২৪০ মিলিয়নে। তবে ২০০৭ সালে সবচেয়ে জেলেরা বেশির ক্ষতির মুখে পড়েছে। তখনকার সময়ে বাংলাদেশ বন্দর কর্ক্ষৃপক্ষ ৮৯টি নিম্ম চাপ এবং ঘনীভ‚ত নিম্মচাপের সংকেত জারী করেছিল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির দরুন ঝড়, টর্নেডো, ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছ¡াস বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। বর্ষায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা, আকস্মিক বন্যা ও নদী ভাঙনের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তনের ফলে তীব্র খরা দেখা দেবে। সারা দেশে আবহাওয়ার ধরনে (তাপ, চাপ, বৃষ্টিপাত) ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।

বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে বহুদিন ধরেই সতর্কবাণী করে আসলেও স্বল্পোন্নত এবং ধনী দেশ গুলো তাতে কর্ণপাত করেনি। তাদের বিরতিহীন চাপে অবশেষে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বহুপাক্ষিক কাঠামো ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন কা¬ইমেন্ট চেঞ্জ। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোয় অনুষ্ঠিত ১৯২টি সদস্য দেশ জলবায়ু বিষয়ে একমত পোষন করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ইউএনএফসিসিসির কিয়োটা প্রটোকল ১৭৫টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়, যা ২০০৫ সালে থেকে কার্যকর করা হয়। সবশেষ প্যারিসে ১৯২টি দেশের প্রতিনিধি নিয়ে সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্থ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর সৃষ্ট জলবায়ুর ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ঘোষণা আসে। কিন্তু তাও এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত রূপে লাভ করতে পারেনি। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কার্বন নির্গমনে বিভিন্ন দেশের দায়ভার এবং জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচিতে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে ধনী দেশের ব্যয় সক্ষমতার মাত্রা নির্ধারন করে গরীব দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন ব্যয়ের শতকরা ৪৪ ভাগ বহন করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, ১৩ ভাগ বহন করতে হবে জাপানকে, ৭ ভাগ বন করতে হবে জার্মানীকে, ৫ ভাগ বহন করতে হবে যুক্তরাজ্য, ৪-৫ ভাগ বহন করতে হবে ইটালী, ফ্রান্সও কানাডাকে এবং ৩ ভাগ বহন করতে হবে স্পেন, অস্টেলিয়া ও দক্ষিন কোরিয়াকে। কিন্তু প্যারিসের সেই ওয়াদা ধনী রাষ্ট্র এবং অনেক শিল্পোন্নত রাষ্ট্র তা মানেনি।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কবল থেকে আমাদের মানব সম্পদ, কৃষি এবং অথনৈতিক সকট মোকাবেলা করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০০৭ সালে সিডর আক্রামন করার সময় সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে উপকুলীয় বাসীকে রক্ষা করেছিল। তার অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। তাই উপক‚লীয় অঞ্চলে বনভ‚মি সৃষ্টির লক্ষ্যে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহন করতে হবে। সামনের ভবিষ্যত যেভাবে জলবায়ু আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা গেলে সমস্যা যতোই আসুক, আশা করা যায়, ততোটা আমাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জলবায়ু


আরও
আরও পড়ুন