Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

শিক্ষা মানব জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। শিক্ষা ছাড়া কোন মানুষ বা জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে পারে না। শিক্ষা যে শুধু দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তা নয়।একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে হলে তার জীবনে প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা। কারণ শিক্ষাই পারে একজন সুস্থ-সবল দেহের অধিকারী জ্ঞান সম্পন্ন একজন মানুষ গড়ে তুলতে। মানুষকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের শিক্ষিত নাগরিক দেশের সম্পদ। তাই দেশের উন্নয়নে সবার আগে চাই শিক্ষা। আমাদের দেশে এমন সময় ছিল যখন স্কুলের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ঐসময় মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য অনেক দূরদূরান্তের স্কুলে পায়ে হেঁটে যেতে হতো। কাছাকাছি কোন স্কুল, কলেজ বা মাদরাসা ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোতো সে সময় পড়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের মারধর করা হতো। তারপরও মানুষ লেখাপড়া করেছে। আজকে যারা দেশ পরিচালনা করছেন তাদের অনেকের জীবনেই এ ধরনের ঘটনা ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন প্রাইমারি স্কুল আছে। আবার কোন কোন গ্রামে হাই স্কুল ও কলেজ রয়েছে। শিক্ষার জন্য যাতে কোন মানুষকে দূরে যেতে না হয় তার জন্য সরকার দেশের প্রতিটি এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে। প্রতিটি ছেলেমেয়ে যাতে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা। দেশের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে শিক্ষার আওতায় আনার জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করছে সরকার। কোন কোন স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুপুরের খানার ব্যবস্থা করছে।কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির অসাধু লোক শিক্ষার মানকে ধবংস করার জন্য সরকারি স্কুলের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে ব্যবসার জন্য। যেগুলোতে শিক্ষার চেয়ে টাকার প্রাধান্যই থাকে বেশি। তারা বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে অভিবাকদের আকর্ষণ করে থাকে, যাতে করে অভিবাবকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য ভর্তি করে।
এখন আর স্কুল দূরে নয়, বাড়ি থেকে খানিক দূরেই একাধিক স্কুল। তাই সেই আনন্দ-বেদনাগুলো এখন ফিকে হয়ে গেছে। ক্লাসে পড়া না পারলে শিক্ষক ছেলেমেয়েদের বেত দিয়ে মারতেন, মানুষ হওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরে জামা খুললেই মা সবার আগে দেখে কাঁদতেন আর বুঝাতেন বাবা ভালো করে পড়িস। তোর গায়ের ব্যথা যে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। মায়ের আকুতি ভরা কান্নার আড়ালে সান্ত¡না ছিল, শিক্ষক তার ভালোর জন্যই মেরেছে। মায়ের কথায় ছেলেমেয়েরা পড়ায় মন দিলেও বাবার আত্মা শান্তি পেত না, ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করতে কোথায় ভালো শিক্ষক আছেন খুঁজে বেড়াতেন, খবর পেলেই নিয়ে যেতেন শিক্ষকের কাছে পড়াতে। এভাবে অনেক বাবাই তার নিজের স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের দিয়ে পূরণ করেছেন। নতুন সাইকেল কিনে বাবা সারপ্রাইজ দিতেন। আবার অনেক ছেলেমেয়ে নিজেদের উদ্যোগে লেখাপড়া শিখে অনেক বিখ্যাত হয়েছেন। ডিজিটাল যুগে বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। স্কুলের শিক্ষক এখন আর ছাত্রছাত্রীদের মারেন না। সব কিছুতেই কেমন একটা আলগা আলগা মনে হয়। ছেলেদের সঙ্গে এখন মেয়েদের ও লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। ঘরের কাজ যে মেয়েদের প্রাত্যহিক কাজ ছিল সেই মেয়েরা এখন অফিসের বস, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের সরব অংশগ্রহণ।
সরকার নিয়ম করেছে শিক্ষার্থীদের শারীরিক প্রহার করা যাবে না। এটা মেনেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের পাঠকার্যক্রম পরিচালনা করছে। সন্তানের গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে মাকে আর কাঁদতে হয় না। তবে আজও বাবাদের খুঁজতে হয় ভালো শিক্ষক কিংবা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এখানেই খোঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক দুঃখজনক ঘটনা, এটাকে প্রতারণাও বলা চলে। সরকারি প্রাথমিক কিংবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর এখন আর বাবা-মা আস্থা রাখতে পারেন না। তাই দেশসেরা কিছু ক্যাডেট কোচিং নামধারী নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের ধরনা দিতে দেখা যায়। বেশির ভাগ অভিভাবক এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান যে তাদের সন্তান সুশিক্ষা আর ভালো মানুষ হতে পারবে। কিন্তু কিছু ঘটনা তাদের চোখের পর্দা খুলে দেয়। আসলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে বড় হলেও, এখানে শিক্ষকতা করেন উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা সম্মান এ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা, যাদের পাঠদানের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নেই। কথা হলো, এসব শিক্ষকদের দিয়ে কতখানি উন্নয়ন হবে শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষক নিজেই লেখাপড়া শেষ করেনি? আর এই শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতো আরও দুর্বলতা প্রকাশ করে। দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার মাসিক বেতনের শিক্ষক দিয়েই চলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রশ্ন হলো, শিক্ষা অফিসার কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি এগুলোর খবর রাখেন? নাকি দেখেও না দেখে থাকেন? উত্তর এই দুটির যে কোনো একটি হলে বুঝতে হবে, এ জাতির শিক্ষার দুনিয়ায় পিছিয়ে পড়তে আর বেশি বাকি নেই। কাউকে ছোট বা অপমান করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। এবার জানতে হবে এসব কোচিং স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন কত? প্রতিটি স্কুলে গড়ে বেতন ১২০০-১৮০০ টাকা যেখানে প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থী থাকে ২০ জন। সুতরাং হিসাব পরিষ্কার, এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় শিক্ষা নয় বিজনেস করতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। অনেক বাবার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তাহলে কেন এসব স্কুলের বিরুদ্ধে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা হচ্ছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব, প্রশাসন এদের খবর রাখে না?
একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে ১৫০০ শিক্ষার্থী হলেও সরকারি প্রাথমিকে খুব বেশি হলে ৩০০-৪০০ জন। এই অনুপাত এটাই নির্দেশ করে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যর্থতাই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার জন্য দায়ী। সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ভবন, মাঠ, শিক্ষকদের উচ্চ বেতন, উপবৃত্তিসহ আরও নানা কর্মকাণ্ডে বড় অঙ্কের বাজেট দিতে হয় সরকারকে, আর সেই টাকার জোগান আসে নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকা থেকে।
সরকারি স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকাদের সরকারি খরচে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে করে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকরাই জানে ছাত্রছাত্রীদের পড়া দেয়া আর তাদের থেকে পড়া আদায় করার কৌশল। প্রশিক্ষিত এই শিক্ষকদের স্কুলে শিক্ষকতা করতে নিয়োজিত করে রাষ্ট্র তাদের জন্য উচ্চ বেতন প্রদান করে। পক্ষান্তরে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার টাকার বেতনের শিক্ষক যাদের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই তারা পাঠদান করে! স্কুলের শিক্ষার্থী বৃদ্ধি করতে, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? যদি দায়িত্ব থাকে তাহলে এই ব্যর্থতা কি দায়িত্ব অবহেলাকেই নির্দেশ করে না? কেন অভিভাবকরা সরকারি প্রাথমিকে তার সন্তানকে পড়তে দিচ্ছেন না আর কেনইবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটছেন, এর কারণ বের করতে হবে প্রাথমিকের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরকেই। গোড়ায় গলদ রেখে সত্যিই কি আমরা এগোতে পারব?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষাব্যবস্থা


আরও
আরও পড়ুন