পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মাদরাসা অঙ্গনের একটি জনপ্রিয় সেøাগান হল, ইবনে সীনা, আবু রুশদ, আল-রাজী, ইমাম গাযযালী, ইবনে খালদুনের মতো মনীষী অতীতে দুনিয়ার বুকে জ্ঞানের আলো জ্বেলেছেন। কাজেই বর্তমান মাদরাসা শিক্ষায় এ ধরনের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদ, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সেøাগান আমি নিজেও দিয়েছি ছাত্র জীবনে। বিলম্বে উপলব্ধি হল, মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি এ ধরনের বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদ, কৃষিবিদ ইত্যাদি সৃষ্টি করতে হয় তাহলে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে কোত্থেকে। অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, সমরবিদ সব যদি মাদরাসা থেকে তৈরি হয় তাহলে আমাদের জেনারেল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কিসের জন্য। কাজেই বর্তমান মাদরাসা শিক্ষা হল ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তৈরির ব্যবস্থা। যেমন যোদ্ধা ও সমরবিদ তৈরির আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে ক্যাডট কলেজের মাধ্যমে। ডাক্তার তৈরির আলাদা ব্যবস্থাপনা ও অনুশীলন হয় মেডিক্যাল কলেজগুলোতে। কৃষিবিদ তৈরির জন্য রয়েছে কৃষি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট নামের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজই তো দেশের চাহিদা মোতাবেক প্রকৌশলী তৈরি করা। যদি মাদরাসাতেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ সমরবিদ তৈরি করা হয় বা জেনারেল প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তৈরির সেøাগান দেয়া হয় তাতে কী ধরনের হ য ব র ল অবস্থার সৃষ্টি হবে তা কি চিন্তা করা যায়!
মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার বা আধুনিকায়নের সেøাগান যারা দেয় তারা চিন্তার এ জাতীয় বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অতীতের নিউস্কীম মাদাসা এবং হালের আলিয়া নেসাবের মাদরাসাসমূহের ভাগ্যে দুর্দশা নেমে এসেছে। এতদিন খাঁটি দ্বীনি মাদরাসা ও আলেম তৈরির কারখানা বলে গর্বিত কওমী মাদরাসাগুলোও সেই পরিণতির দিকে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ১৯১৫ সালে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসাকেন্দ্রিক আলিয়া নেসাবের মাদরাসাসমূহ যখন নিউস্কীম ও ওল্ডস্কীম নামে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সিলেট আলিয়া, ছারছীনা আলিয়া ও কলিকাতা আলিয়ার একাংশ বাদে সব মাদরাসা নিউস্কীমের টোপ গলধকরণ করে তখন সবাই নিউস্কীম পদ্ধতির প্রশংসা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল, কালের বিবর্তনে নিউস্কীমভুক্ত হাই মাদরাসাগুলো স্কুল কলেজের জেনারেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস মরহুম ড. সিরাজুল হকের একটি নিবন্ধ সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে ১০৭৪টি মাদরাসাকে রাতারাতি জুনিয়র হাইস্কুল ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করে। তখন এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছে বলেও জানা যায় না। ড. সিরাজুল হক সাহেব নিজেও ঐ প্রবন্ধে নিউস্কীম পদ্ধতির প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, নিউস্কীমের টোপ গিলে মাদরাসাগুলো ভেতর থেকে এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় যে, বাইরে মাদরাসা নাম থাকলেও ভেতর থেকে স্কুল হয়ে যায় এবং এক সময় বাইরের খোলসও পাল্টায়। বর্তমানে ঢাকার নজরুল কলেজ একসময় ছিল মোহছেনিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রামের হাজী মহসিন কলেজও ছিল মোহছেনিয়া মাদরাসা। ভোলার এ রব হাই স্কুলও ছিল এক সময়ের দ্বীনি মাদরাসা। অনুসন্ধান চালানো হলে তথ্য উদ্ঘাটিত হবে যে, এখনও যেসব হাইস্কুলের ছাত্ররা মাথায় টুপি পরিধান করে সেসব প্রতিষ্ঠান এক সময় মাদরাসা ছিল। যেমন চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল, পটিয়া সদরে প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল, ঢাকার মতিঝিল হাইস্কুল ও আরমানিটোলার হাম্মাদিয়া হাইস্কুল। পরিতাপের বিষয় হল, মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির ইতিহাস সামনে থাকা সত্তে¡ও যারা নিজেদেরকে মাদরাসা শিক্ষার হর্তাকর্তা মনে করেন তারা মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার, আধুনিকায়ন, সার্টিফিকেটের মান, মূল্যায়ন প্রভৃতির মাদকতায় বেভোর হয়ে আত্মাহুতি দিতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর জেনারেল শিক্ষা হতে ইসলামী বা ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটনের ব্যাপারেও তারা সম্পূর্ণ উদাসীন।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আলেমদের অনীহা : দেশের একজন প্রথম সারির ইসলামী নেতার কথাই বলি। তিনি আলেম সমাজের কাছেও গভীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একবার একান্ত আলাপচারিতায় স্কুল শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বিদায় করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম, আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করে। স্কুলে মুসলমান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীদের তাদের ধর্মকর্ম সম্পর্কে জানার একমাত্র মাধ্যম মেট্রিক পরীক্ষায় ১০০ নং এর ধর্মশিক্ষার বাধ্যবাধকতা। যেখানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ হচ্ছে সেখানকার কুশিলবরা ক্ষমতাসীনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই ১০০ নং-এর ধর্মশিক্ষার পরীক্ষা তুলে দেয়ার আয়োজন পাকাপোক্ত করেছেন। আপনি একটু প্রতিবাদ জানান তাহলে হয়ত তারা এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে সাহস করবে না। এর জবাবটি তিনি যেভাবে দিয়েছিলেন তাতে আমি যুগপৎ হতাশ ও হতবাক হয়ে যাই। তিনি বলেছিলেন, আসলে হাফেজ্জি হুজুর ঠিক বলেছিলেন। আমিও যেখানে যাই বলে থাকি যে, প্রত্যেক পাড়ায় মহল্লায় নূরানী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার এ উক্তিতে আমার বুঝতে বাকী ছিল না যে, আমাদের আলেম সমাজ বিশেষ করে কওমী ঘরানার সচেতন লোকেরাও জেনারেল শিক্ষার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এবং নিজেদের গন্ডির মধ্যে আত্মভোলা হয়ে আছেন। বস্তুত জেনারেল শিক্ষা থেকে ইসলামকে বিদায় করার যে ষড়যন্ত্র কার্যকরি হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক ও পৌত্তলিক রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার যে তৎপরতা চলছে তার জন্য জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আমাদের ধর্মীয় মহলের উদাসীনতা নিঃসন্দেহে দায়ী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।