পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, গণফোরাম এবং বামপন্থী মিলে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। গত শনিবার গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তারা আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবদলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করার দাবী জানিয়েছেন। রাজনীতিতে এই ঐক্যপ্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন দল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিলেও এর তাৎপর্য্য রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ এ ধরনের ঐক্যপ্রক্রিয়া প্রায় দুই দশক পর দেখা গেল। নব্বই দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ ধরনের ঐক্যপ্রক্রিয়া হয়েছিল। এতে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। তবে এবারের ঐক্যপ্রক্রিয়া আর সে সময়ের ঐক্যপ্রক্রিয়ার মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। এরশাদের শাসনামল ছিল নিখাদ স্বৈরাচারের মতো। এখন গণতন্ত্রের মোড়কে এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র চলছে বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে। দেশে বাকস্বাধীনতা, নামমাত্র গণতন্ত্র, বিরোধী রাজনীতিকে মাঠ থেকে বিতাড়ন, সভা-সমাবেশ করতে না দেয়াসহ সরকারের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে। মাঝে মাঝে বিরোধীদলকে বহু শর্ত জুড়ে দিয়ে সীমাবদ্ধ জায়গায় সভা-সমাবেশ করতে দিয়ে সরকার দেশে গণতন্ত্র আছে বলে দেখানোর চেষ্টা করে, যাকে অনেকে সীমিত বা লোক দেখানো গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্দ্বিধায় একের পর এক জনসভা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ জোরেসোরে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। তবে ক্ষমতাসীনদের কথাবার্তা এবং আচরণে বোঝা যাচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচন কীভাবে করবে এবং জয় লাভ করবে, তা যেন আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছে। সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছে। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এ প্রেক্ষিতে, প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যদলগুলোর ঐক্যপ্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন দল থোড়াই কেয়ার করছে। আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীনরা তাদের জয় সুনিশ্চিত মনে করলেও আগামী দুই মাস রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যপ্রক্রিয়ার অনুষ্ঠান থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ১ অক্টোবর থেকে তারা সভা-সমাবেশ করবে। বিকল্পধারার সভাপতি ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঘোষণা করেছেন, সভা-সমাবেশ করার জন্য প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন নেই, আমরা জনগণের অনুমতি নিয়েই সভা-সমাবেশ করব। যদি তাই হয়, তবে রাজনীতির পরিবেশ কোন দিকে গড়াবে, তা বলা মুশকিল। সরকার নিশ্চিতভাবেই সভা-সমাবেশের অনুমতি দেবে না। কারণ সরকারের মধ্যে প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে যে এ ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে একধরনের নার্ভাসনেস কাজ করছে, তা তাদের বিভিন্ন তির্যক বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর এই নার্ভাসনেস থেকেই সে বিরোধী দলের উপর অতীতের মতোই চড়াও হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইতোমধ্যে ধারাবাহিকভাবে দেশব্যাপী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মামলা এবং কয়েক লাখ নেতা-কর্মীকে আসামী করে গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে। এ অবস্থায় সভা-সমাবেশ এবং আন্দোলন শুরু হলে রাজনৈতিক পরিবেশ যে অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত। অন্যদিকে বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলোর দাবী আদায়ে রাজপথে আন্দোলন ছাড়া বিকল্পও নেই।
দুই.
বহুদিন ধরেই দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি অনুপস্থিত। সুষ্ঠু রাজনীতি বলতে বোঝায়, যে রাজনীতিতে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে সমালোচনা করে এবং জনগণ ও জাতীয় স্বার্থে একমত পোষণ করে। সংসদে কার্যকর বিরোধী দল থাকলে তারা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করবে। জনসাধারণের বিভিন্ন স্বার্থ, সমস্যা ও দাবী-দাওয়া নিয়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং করবে। জনগণও সরকার এবং বিরোধী দলের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলবে। ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কারণে বিরোধী দল একটু ব্যাকফুটে থাকবে, সুযোগ-সুবিধা কম পাবে। ক্ষমতাসীন দল একচেটিয়া দাবড়ে বেড়াবে না। ক্ষমতার একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর অনেকটা এ ধারায়ই আমাদের দেশের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। এ ধারাটা মোটামুটি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ছিল। তারপর থেকেই চিরাচরিত রাজনীতির চেহারা বদলে গেছে। দীর্ঘ দিন ধরে প্রচলিত রাজনীতি অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। সংসদের বাইরের বিরোধী দল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেককে বলতে শোনা যায়, দেশকে বিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্য এবং ধমকের রাজনীতির কারণে বিরোধী দলের রাজনীতি সংকুচিত হয়ে গেছে। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, তাদের রাজনীতি করতে দেয়া হচ্ছে না। সরকার তাদের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ করার বিষয়টি অনুমতিনির্ভর করে ফেলেছে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের এ অভিযোগের ভিত্তিতেই হোক বা ক্ষমতাসীন দলের কঠোরভাবে শাসনের কারণেই হোক, দেশে যে একধরণের রাজনীতিহীন পরিবেশ চলছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করছেন। অবশ্য বিরাজনীতিকরণের এ অভিযোগ ক্ষমতাসীন দল থেকে জোরালোভাবে অস্বীকারও করা হয় না। তার কথাবার্তা ও আচর-আচরণে এ মনোভাবই প্রকাশিত হয় যে, যেটুকু রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাই যথেষ্ট। এর বেশি দরকার নেই। সাধারণ মানুষও সরকারের এ বার্তা বুঝতে পারে। ফলে তারা এখন আর আগের মতো রাজনীতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় না। রাজনীতির প্রতি তাদের একধরণের অনীহা জন্মেছে। এর একটা কারণ হচ্ছে, ভয়। এই ভয়টা যে ক্ষমতাসীন দল ঢুকিয়ে দিয়েছে, তা বহুদিন ধরেই বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলে আসছেন। ক্ষমতাসীন দলের কঠোর শাসন-বারণের কারণে সাহস করে কেউ উচ্চকণ্ঠ হতে চায় না। কারণ একটি বৃহৎ বিরোধী দলকে কীভাবে চিড়েচ্যাপ্টা করে ফেলা যায় এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কীভাবে হেনস্থা ও দৌড়ের উপর রাখা যায়, তাদের সামনে এ দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেউ কিছু বলতে গেলেই দেখা যাবে, তার উপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসছে। এ কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ক্ষমতাসীন দল তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের উন্নতির জন্য যা করার দরকার তার সবই করা হচ্ছে। দেশ তরতর করে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এতো রাজনীতি করার দরকার কি! চুপচাপ বসে থাকো। কোনো দেশে জনসাধারণের সামনে যখন এমন চিত্র তুলে ধরা হয়, তখন কার সাধ্য, সমালোচনার তীর সরকারের দিকে তাক করে? যেখানে বিরোধী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চলে, সেখানে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের আলোচনা করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
তিন.
আমাদের দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, খেয়ে হোক না খেয়ে হোক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করা এবং কথা বলা, চয়ের কাপে ঝড় তোলা। কেউ আলাপ করলে কাজ ফেলে সেখানে কান দেয়া। আলোচনা মনপুত হলে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়া, না হলে তর্কে জড়িয়ে পড়া। তারা ডেমোক্রেসি তত্তে¡র জনক গ্রিক রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ক্লিসথেনিসের নাম বা পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত মনিষীদের দেয়া ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা জানা দূরে থাক, নিজেরাই যে ন্যায়-অন্যায় বা যুক্তি-তর্কের মধ্যে লিপ্ত হয়ে ডেমোক্রেসির মধ্যে থাকে, তারা নিজেরাও তা জানত না। অজান্তেই তারা ডেমোক্রেসির সংজ্ঞার মধ্যে বিচরণ করত। নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে একের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া বা যৌক্তিক মতামত গ্রহণ করা তাদের চিরকালের অভ্যাস। তারপর যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে নিজেদের নীতি-আদর্শ তাদের সামনে তুলে ধরে, যার যার পছন্দ মতো সেসব দলকে সমর্থন করতে শুরু করে। এটা অনেকটা এক সময় আবাহনী-মোহামেডানকে সাপোর্ট করার মতো। যে দিন প্রিয় দলের খেলা থাকত, সেদিন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হওয়ার মতো প্রিয় রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে তারা হাজির হতো। তারপর প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে কষ্ট পাওয়া আর জিতে গেলে আনন্দ পাওয়ার মধ্যেই তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত। হেরে যাওয়া নিয়ে নানা হিসাব মিলানো এবং জিতে যাওয়া নিয়ে আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি আরও বেশি ব্যবধানে কীভাবে জেতা যেত, এ নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্কে লিপ্ত হতো। মূলত এভাবেই আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটা বহু বছর ধরে প্রচলিত ছিল। এখন তাতে যেন ছেদ পড়েছে। রাজনীতি অনেকটা এক হাতে তালি বাজানোর মতো হয়ে পড়েছে। এমন একটা পরিবেশেই দেশকে বিরাজনীতিকরণ করার অভিযোগ উঠেছে। দেশের মানুষ কবে সরকার ও বিরোধী দলের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা দেখেছে, তা মনে করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। শীর্ষ নেতাদের সামনা সামনি দেখা বা তাদের কথা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে অতি সাধারণ মানুষের জনসভায় উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি যেন হারিয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিরোধী দলের কবে বড় জনসভা হয়েছে, তা মনে করতে স্মৃতির অতল গহুরে হাত দিতে হবে। পত্র-পত্রিকায় জনসভার বিশাল ছবি ও প্রতিবেদনের পাশাপাশি আলাদাভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথাও এখন আর চোখে পড়ে না। জনসভা করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। কার জনসভা কত বড় এবং কত মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, এ নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা যায় না। পাল্টাপাল্টি জনসভা করা নিয়ে যে উৎসবমুখর ও সুস্থ্য প্রতিযোগিতার রাজনীতি দেখা যেত, এখন তা বিরল হয়ে উঠেছে। রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ হয়তো অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কোথায় গেল সেই রাজনীতি! আমরা কেন আর আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারি না! তারা যে আর আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারে না, এ বিষয়টি দেশ-বিদেশের সকলেরই জানা। তা নাহলে, এ অভিযোগ উঠতো না, দেশকে বিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্থান করে দেয়া হচ্ছে না। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বিরোধী দলের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ নিয়মিতই হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের এ কথার সাথে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী অনেকে একমত হতে পারছেন না। তারা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, দেশে গণতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক রাজনীতির স্পেস সংকুচিত করা হয়েছে। তাদের এসব কথা ক্ষমতাসীন দল খুব একটা আমলে না নিয়েই তার বোধ-বিবেচনায় শাসন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে গৌণ করে উন্নয়নকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরছে। সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, মানুষের সামনে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে পারলে গণতন্ত্র আছে কি নেই এ নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামাবে না। তবে সরকারের এ নীতির সাথে বেশিরভাগ সচেতন মানুষই দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করেন, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একটি আরেকটির পরিপূরক। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি খুব বেশি দিন চলতে পারে না। একটি সফল ও দক্ষ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সমানতালে এগিয়ে নেয়া। এর যে কোনো একটিকে বাদ দিলে তা তার অদক্ষতা হিসেবেই বিবেচিত হয়।
চার.
বলা বাহুল্য, সীমিত, নিয়ন্ত্রিত বা খর্বাকৃতির গণতন্ত্র স্বৈরশাসন ব্যবস্থা থেকেও ভয়ংকর। স্বৈরশাসন ব্যবস্থা নিয়ে জনসাধারণের সান্ত¦না পাওয়ার জায়গা থাকে। স্বৈরাচার জনগণকে তোয়াক্কা করবে না, এটা তাদের জানা। তবে গণতন্ত্রের লেবাসে শাসন ব্যবস্থায় জনগণের বিপদ সবচেয়ে বেশি। তারা না পারে কিছু বলতে না পারে সইতে। গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র নেই-এমন এক গোলক ধাঁধাঁয় তাদের হতোদ্যম হয়ে পড়া ছাড়া গতি থাকে না। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকামী দেশে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষও স্বৈরশাসন ব্যবস্থা যেমন মানেনি, তেমনি গণতন্ত্রের মোড়কে আবদ্ধ শাসন ব্যবস্থা মানেনি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ আন্দোলনে যে রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিক না কেন, তাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি স্বচ্ছন্দে থাকলেও যারাই গণতন্ত্র ব্যাহত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষের কাছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা উন্নয়নই বড় কথা নয়, তাদের কাছে প্রথম অগ্রাধিকার গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে তাদের মিল রয়েছে। তারা চায়, শাসন এবং উন্নয়ন দুটোই করতে হবে গণতন্ত্রকে ধারণ করে। এর বাইরে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের চালাকিতন্ত্র গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যকে সাময়িকভাবে অনেক শাসক দমিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছে। জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এ নজির স্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যে আপস করে না, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে চায়, তা ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দল নিশ্চয় জানে। কাজেই যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদেরকে বাংলাদেশের মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই দেশ শাসন করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ, এক দলের আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ বা গণতন্ত্রকে বিকৃত করে শাসন করা জনগণ যেমন গ্রহণ করে না, তেমনি তার পরিণতিও সুখকর হয় না। এক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই এবং এর বাইরে চিন্তা করারও সুযোগ নেই। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই গণতন্ত্রকে উন্মুক্ত ও বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। আমরা আশাবাদী, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐক্য হয়েছে তা দেশকে বিরাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করবে এবং সরকারেরও বোধদয় হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।