পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অতি উৎসাহী পুলিশ কর্তৃক দেশব্যাপী প্রতিটি থানায় একই ধারা অর্থাৎ ১৯৭৪ সনের ১৫(৩) এবং বিস্ফোরক উপাদানাবলী (সংশোধন) আইন-২০০২ এর ৩ক ধারায় সিরিজ মামলা রুজু করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আত্মঘাতী কার্য করা সহ দেশের সম্পদের ক্ষতি করার জন্য গোপন বৈঠকের অভিযোগসহ পুলিশ কাল্পনিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে বিএনপি (নেতা, কর্মী, সমর্থক) পুলিশের উপর ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত। বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ একটি নির্যাতনমূলক আইন যা পরিবর্তনের জন্য জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দলের ম্যানিফেস্টোতে থাকলেও সরকার গঠনের পর কেউ আর তা পরিবর্তন করেনি। আইনটি কালো আইন হিসেবে বিবেচিত। এ জন্য আইনটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করার জন্য উচ্চ আদালতের অবজারভেশন রয়েছে। কিন্তু সরকার ব্যবহার করে মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করার জন্য। এ ছাড়াও বিরোধী দলকে নিপীড়ন করার জন্য সময়ে সময়ে অবিবেচকের মতো এটা ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি ১/১১ অসংবিধানিক সরকারও আইনটি প্রয়োগের মাধ্যমে ডিটেনশন প্রদান করেছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকসমূহে গত ৮ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ:
‘আমরা কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করি না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার নিয়ে বিএনপি’র অভিযোগ মিথ্যা। বিএনপি’র যেসব ব্যক্তি গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিডিওচিত্র রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ ছাত্র যুব ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা কে কোথায় কী করছেন তার প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। আমাদের কাছে ভিডিওফুটেজ রয়েছে। গ্রেফতার নিয়ে বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, তা মিথ্যা। এসবে কান দিয়ে জনগণের সময় নষ্ট করার দরকার নেই। তারা যদি কোনটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারব কী অভিযোগে ধরা হয়েছে। নিরপরাধ কাউকে তো গ্রেফতার করা হচ্ছে না। পারলে প্রমাণ করেন যে বিএনপি নেতাকর্মীরা অপরাধী নন।’
ব্রিটেনে একটি প্রবাদ আছে, King can not do Wrong. বাংলাদেশের প্রশ্নেও যদি তাই হয় তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোন বক্তব্য নাই। যদি তা না হয় তবে মন্ত্রীকে তার বক্তব্য ঈমানি দায়িত্বের সাথে খতিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ করবো। ‘আমরা কাউকে বিনা অপরাদে গ্রেফতার করি না’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই চ্যালেঞ্জিং বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা বাহুল্য যে, দেশব্যাপী সম্প্রতি কাল্পনিক অভিযোগে নাশকতার পরিকল্পনার মিথ্যা ও ভৌতিক অভিযোগে যে সিরিজ মোকদ্দমা পুলিশ করছে তা কি সবই সত্য? যদি তাই হয় তবে বিদেশে থাকা বা হজ্বে থাকা ব্যক্তিবর্গকে বিএনপি করার কারণে আসামী করা হচ্ছে কেন? কেনইবা ৭০ বছরের বিএনপি নেতাকর্মী এবং মৃত ব্যক্তিরা এই আক্রোশ থেকে বাদ যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ মর্মে কি ব্যাখ্যা দেবেন?
বালু, সিমেন্ট, ইট, কনক্রিটের উন্নয়নের চেয়ে দলমত নির্বিশেষে জনগণের সার্বিক নিরাপত্তাসহ সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়ন করাই একটি কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান কাজ। নিরাপত্তার পরিবর্তে যদি উন্নয়ন দেখানো হয় তবে তা হবে কান্নারত শিশু বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর কল্পকাহিনী শোনানোর মতো ব্যাপার। পুলিশের আই.জি (মহাপরিদর্শক) একই দিনে বলেছেন যে, কোন নাশকতা ‘বরদাস্ত’ করা হবে না। এ ধরনের বরদাস্তের হুমকি পাকিস্তানী পুলিশের নিকট থেকেই শুনেছি। কিন্তু পুলিশ মিথ্যা, ভৌতিক ও কাল্পনিক যে মামলা রুজু করে জনগণকে বিভিন্ন পন্থায় হয়রানি করে এই অনাচার জনগণ বরদাস্ত করবে কীভাবে? পুলিশের দায়েরকৃত সিরিজ ভৌতিক মামলা এবং আই.জির কায়দায় এমন ধমক সময়ে সময়ে অনেকেই দিয়েছেন যা জনতার কাছে কোনো কালেই পাত্তা পায়নি। কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন যে, ‘মুজে আদমী নেহি, মাট্টী চাহিয়ে’ অর্থাৎ ‘আমি মানুষ চাই না, শুধু মাটি চাই।’ অনেক শক্তিধর জেনারেল টিক্কাকে কিন্তু অপমান-অপদস্থ হয়ে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছে।
মানুষ যখন খেই হারিয়ে ফেলে তখনই মিথ্যার আশ্রয় নেয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ৪ চার মাস পূর্বেই এতো শক্তিধর সরকারের খেই হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়, তবে একটি হরিলুটের নির্বাচন (২০১৪ সালের মতো) করার জন্য সরকার যতই ফন্দিফিকির করুক না কেন ততই দেশের রাজনীতিতে বিরোধীদের ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বিএনপি’তে দল উপদলের যে বিভক্তি ছিল তারাও কাল্পনিক ভুতুড়ে মামলার কষাঘাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ পাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের দ্বিতীয় বাসস্থান এখন আদালত প্রাঙ্গন এবং কারাগার। ফলে বিএনপি নেতাকর্মীর আতঙ্কে ফেলে দেশকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি মুক্ত করতে গিয়ে পুলিশ দিয়ে মিথ্যার পর মিথ্যা দিয়ে সরকার প্রশাসন ও বিচার বিভাগের যে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে। এটা সরকারকে বিনা ভোটে পুনঃ নির্বাচিত করতে কতটুকু সহায়তা করবে?
সকল ক্ষেত্রে সরকার বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলি বিপর্যস্থ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্রীড়াঙ্গন বাদ যায়নি। শুধুমাত্র আওয়ামী ঘরনার ক্রীড়া সংগঠন আবহনী চক্রের দুইজন কর্মকর্তার জেদের কারণে বার বার জাতীয় দলে সোহেলকে গোলকিপার হিসাবে মনোনীত করে তিন বারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ধস নেমেছে। শেখ হাসিনা সরকার দেশকে পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। সরকারের পক্ষের লোক যারা তাদের জন্যই রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা উম্মুক্ত রয়েছে, বাকীদের জন্য সবই বৈরী। রাষ্ট্রীয় আমলা যারা দেশের জনগণের অর্থে লালিত পালিত, জনগণের করের কোটি কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন, স্ত্রী পরিজন নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করেন, তাদের সকলের দায়িত্ব দেশের সকল জনগোষ্ঠিকে সমভাবে সেবা দেয়া। কিন্তু সেই রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত আমলারা শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। তারা কথায় কথায় হুমকি দেন। কাল্পনিক ঘটনাকে যেখানে নাশকতার পরিকল্পনা বলেন, সেখানে লগীবৈঠার তান্ডব, পথচারীকে দিগম্বর করা, বিএনপি আমলে গান পাউডার দিয়ে শাহবাগে বিআরটিসি ডবল ডেকার বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যাসহ ৫৪টি বিআরটিসি’র বাস পুড়িয়ে দেয়ার নিন্দনীয় ঘটনা সম্পর্কে বর্তমানে অতি উৎসাহী রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অভিমত কী? এ বিষয়ে তো তাদের বক্তব্য নাই। সকল প্রকার নাশকতা ও রাজনীতির নামে অগ্নিসংযোগকে ঘৃণা ও প্রতিবাদ করছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্তারা সব বিষয়ে একতরফা তথা সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে এতো নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করে কেন? এর মূল কারণ কাকে ডিঙ্গিয়ে কে প্রমোশন ও সুবিধামত পোস্টিং নেবে এ প্রতিযোগিতায় জনগণের নাভিশ্বাস, তাদের উপর জনগণের আস্থা যাই থাকুক না কেন? তাই পুনরায় বলছি, হায়রে অসহায় জনগণ, হায়রে অসহায় গণতন্ত্র! কতদিন আর মিথ্যার জালে আবদ্ধ হয়ে অত্যাচারে-নিপীড়নে অতীষ্ট হতে হবে জনগণকে?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।