Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্য

| প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ৭.৮৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে দাবী করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির(একনেক) সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির সর্বশেষ হিসাব তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বিগত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭.৬৫ শতাংশ। অর্থবছর শেষে সামগ্রিক হিসাব অন্তে দেখা যাচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে বেশী। গত অর্থবছরে মোট দেশজ আয় ছিল ২২ লাখ ৫০৪ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। রেকর্ড প্রবৃদ্ধির হাত ধরে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে । আর মাথাপিছু আয় ১৭৫১ ডলার বা ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৯ টাকা। এ হিসাবে দেশের প্রত্যেক মানুষের মাথাপিছু গড় মাসিক আয় ১১ হাজার ৯৮২ টাকা। কৃষিখাতের অভাবনীয় সাফল্যের পাশাপাশি শিল্পখাতের অবদান জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও সেবাখাত ও বেসরকারী বিনিয়োগের নাজুক অবস্থার কথাও স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা দেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের কথা শুনছি। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজিত থাকা এবং হাওরাঞ্চলে অকালবন্যায় ফসলের কিছু ক্ষতি হলেও সারাদেশে কৃষি ও শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা অব্যাহত থাকায় এ উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নিরসন না হলেও রেমিটেন্স প্রবাহে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। আশাতীত জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ক্ষমতাসীন মহল গৌরব ও আত্মতুষ্টি বোধ করতেই পারেন। এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আশান্বিত হতে পারেন। তবে বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে, এই আলোচনা বেশ কয়েক বছর ধরে জোরালো হচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক জরিপ রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে ধনীদের আরো ধনী হওয়ার প্রবণতা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েল্থ-এক্স এর ‘ওয়ার্ল্ড আল্টা ওয়েল্থ রিপোর্ট-২০১৮’ অনুসারে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ভিয়েতনাম, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, হংকং ও পাকিস্তানের মত দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ শীর্ষস্থান লাভ করেছে। রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ১৭.৩ ভাগ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির আকার ও প্রবৃদ্ধি বাড়লে তার সুফল দেশের দরিদ্র মানুষও পেতে পারে, এটাই বাস্তবতা। তবে ধনী-গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী অবস্থাকেই নির্দেশ করে।
দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানে মন্দা অব্যাহত থাকলেও উন্নয়নের রূপকল্প এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানগত বাস্তবতার মধ্যে এক ধরনের বৈপরীত্য স্পষ্ট। শরীরের একটি অংশ ফুলে-ফেপে ওঠাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায়না, তেমনি দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের অতি ধনী হয়ে ওঠার মধ্যে দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার প্রতিফলন ঘটে না। বিবিএস এর রেকর্ড জিডিপি প্রবৃদ্ধি রিপোর্টে দারিদ্রের যে হারের কথা বলা হয়েছে, তাতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। বোরো ও আমনে বাম্পার ফলনের পরও গত বছর হঠাৎ করে চালের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্রের স্তরে নেমে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যে কৃষকরা অর্থবিনিয়োগ ও পরিশ্রম করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করে তুলেছে সেই কৃষকরাই উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে নি:স্ব ও হতাশ হয়ে পড়ছে। অথচ মধ্যস্বত্বভোগিদের সিন্ডিকেটেড কারসাজিতে চালের মূল্য বেড়ে দরিদ্র মানুষকে দুর্ভোগে ফেলছে। অর্থাৎ দেশজ উৎপাদনে কৃষির অবদান কৃষক বা দরিদ্র মানুষের ভাগ্যন্নোয়নে তেমন কোন কাজে আসছে না। মাঝখানের মুনাফাবাজ সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়ে সম্পদ বাড়াচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। তারা এখন অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। একদিকে ধনীর সম্পদ বাড়ছে অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, পুষ্টিহীনতা বাড়ছে। বিনিয়োগ নেই, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, দেশি-বিদেশি কর্মসংস্থানে মন্দা চলছে। দেশের ব্যাংকগুলো লুন্ঠনের শিকার হয়েছে। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এসব বড় বড় লুন্ঠন ও দুর্নীতির সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা জড়িত। এদেরই সম্পদ বেড়ে বিশ্বরেকর্ড তৈরী হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের আশু ও কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র কিছু মেগা প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিসংখ্যানের হিসাব দিয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই কেবল বৈষম্যমুক্ত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনৈতি


আরও
আরও পড়ুন