পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দেওয়ান পরিবার। এলাকায় একমাত্র ‘জমিদার’ বংশ হিসেবে পরিচিত। এই পরিবারের পূর্ব পুরুষ বৃটিশ আমলে এমএলএ ছিলেন। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দেওয়ান পরিবার কেদারপুর ইউনিয়নসহ নড়িয়া উপজেলায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। মুলফৎগঞ্জ বাজার ও কেদারপুর ইউনিয়নে দেওয়ান পরিবার বাদ দিয়ে চিন্তা করাই ছিল দুস্কর। আজ সেই পরিবারটি ভিটামাটি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে পথে নেমেছে। শতাধিক কোটি টাকার মালিক দেওয়ান পরিবার কয়েক মাসের ব্যবধানে পথে বসেছে। খুঁজছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। অনাহারে কেটেছে তাদের কয়েক দিন।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান পরিবার পদ্মার ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছে। ৪শ’ বছরের পুরাতন মুলফৎগঞ্জ বাজারে স্বনামধন্য দেওয়ান ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, দুটি স্টিল আলমারী কারখানাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগই ছিল দেওয়ানদের। পাশারচর, চরজুজিরা, চরনড়িয়া, কলমিরচরসহ বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বিঘা জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ঘরবাড়ি, বাজার, শপিং মল ও আধুনিক বিপণিবিতানও তৈরি করেছিলেন, সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে নড়িয়া এখন ধনী-গরিব কোন ভেদাভেদ নেই। যাদের একসময় বিলাসবহুল বাড়ি ছিল, তারাও এখন ভূমিহীনদের কাতারে।
দেওয়ান পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান হাজী নূর হোসেন দেওয়ান পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি পরিত্যক্ত দ্বিতল ভবনে। পরিত্যক্ত এ ভবনটি ভেঙে ফেলার জন্য কয়েক মাস আগেই টেন্ডার দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একমাত্র দেওয়ান পরিবার ৩০ হাজার টাকা দরে টেন্ডার দাখিল করে ভবনটি কিনেছিলেন। কিন্তু কে জানতো এই ভবনটিই হচ্ছে তার শেষ আশ্রয়স্থল। দেওয়ান পরিবারের পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনটি ছাড়া (ভেঙে নেয়ার জন্য টেন্ডারে ভবন বিক্রি করা হয়েছে) শেষ সম্বল আর কিছুই নেই। তারপরও পদ্মার পানি এ ভবনটির পিছনে ছুই ছুই অবস্থা। এটিও পদ্মায় বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। পদ্মার ভাঙনের পর দেওয়ান পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ডের ভিতরে পাওয়া গেল দেওয়ান পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য হাজী নূর হোসেন দেওয়ানকে।
চেয়ারে বসে পদ্মার ভাঙ্গনের ভয়াবহতা অপলক দৃষ্টিতে পরখ করছিলেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই বলে ওঠেন অনেক সাংবাদিকের কাছে বলছি, মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে, এখন আর কথা বলতে চাই না। আমারতো সব শেষ হয়ে গছে। কয়েক দিন আগেও শত কোটি টাকার মালিক ছিলাম- বলেন হাজী নূর হোসেন দেওয়ান। দোকান-পাট, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল সবই ছিল আমার, আর এখন আমি নিঃস্ব। পরিবার নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছি। আমার ৩ তলাবিশিষ্ট বসতবাড়ি, ৫তলা ভবনে দেওয়ান ক্লিনিক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া দেওয়ান পরিবারের সব বসতবাড়ি, জমিজমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আজ আমাদের কিছুই নাই। আমরা জমিদার থেকে ‘কাঙাল’ হয়ে গেছি।
তিনি দু’চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার দুই তলা কাঠের একাটি বাড়ি ছিল। বাড়িটির কারুকার্য্য ছিল দেখার মতো। ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়িটি তৈরি করেছিলাম। বাড়িটি আমার খুব শখের ছিল। সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ্য কর্মকর্তা নড়িয়া এলেই বাড়িটির কথা শুনে একনজর দেখে যেতেন। সেই শখের বাড়িটির একটুকরো কাঠও রক্ষা করতে পারিনি পদ্মার করাল গ্রাস থেকে।
তিনি হাঁপ ছেড়ে বলেন, বসতবাড়ি থেকে কিছু আসবাবপত্র রক্ষা করতে পেরেছিলাম, সেগুলো অন্যের দোকানের এক কোণে রেখেছি।
প্রথমে তিন দিন পরিবার নিয়ে না খেয়ে থেকেছি বলেই কিছুক্ষণ থমকে যান হাজী নূর হোসেন দেওয়ান। তখন তার দুই চোখে অশ্রু টলমল করতে দেখা যায়। পরে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করেন। যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়েছি সেটি প্রায় শত কোটি টাকার জমি হবে। এই জমিটিও আমাদের। ১৯৫২ সালে চাচা তৎকালীন সময়ের এমএলএ আবদুল করিম দেওয়ান ওরফে মনাই দেওয়ান ৩১ বেডের মুলফৎগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামে বেসরকারী এ হাসপাতাল তৈরী করেন। পরে সরকার হাসপাতালটি নিয়ে সেটিকে ৫০ বেডে উন্নীত করে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামকরণ করে। এতদিন জমির রেকডিও মালিক দেওয়ান পরিবার থাকলেও এবার মাঠজরিপে সরকারের নামে জমিটি রের্কড করা হয়। তবে সরকার জমির মূল্য দিতে চাইলেও দেওয়ান পরিবার সেই মূল্য নেয়নি। দেওয়ান পরিবারের সদস্য ইমাম হোসেন দেওয়ান কেদারপুর ইউনিয়নের দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া আবুল হোসেন দেওয়ান, মোজাফ্ফর দেওয়ান নিজ নিজ ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তাদেরও ঘরবাড়ি, জমিসহ শত কোটি টাকার সম্পত্তি নদীতে বিলীন হয়েছে।
ক্ষোভের সাথে নুর হোসেন দেওয়ান বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে আসছি। অথচ সরকার পদ্মার ভাঙন রোধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ কোটি টাকার বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই চেষ্টা আরও কিছুিদন আগে করলে হয়তো আমাদের পথে বসতে হতো না। এখন আমাদের দেওয়ান পরিবারের কোন স্মৃতিই রইলো না। দেওয়ান পরিবারের অন্য সদস্যরা কোথায় জানতে চাইলে নুর হোসেন দেওয়ান বলেন, পদ্মায় ভাঙনের পর আশ্রয়ের জন্য যে যেখানে পেরেছে চলে গেছে। ছোট ভাই ইমাম হোসেন দেওয়ান দুই দিন খোঁজ নিয়েছিল, আর কেউ আমার খোঁজ করেনি।
দেওয়ান পরিবারের আরেক সদস্য নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, কেদারপুরের চরজুজিরা গ্রামে তিনি ‘আদর্শ’ বাড়ি তৈরি করেছিলেন। মুলফৎগঞ্জ বাজারে তার বিশাল ব্যবসা ছিল। এর সবই এবার নদীতে চলে গেছে। ফলে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা এখন ভূমিহীনদের কাতারে চলে এসেছি।
এরআগে গত কয়েক বছরে দেওয়ান পরিবারের আরো প্রায় ২০০ একর জমি হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে।
মুলফৎগঞ্জ বাজারে পদ্মার তীরে স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের কাছে দেওয়ান পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে পদ্মা নদীর আরো সামনে এক কিলোমিটার দেখিয়ে বলেন, ওইখানে বাজারটা ছিল। ব্রিটিশ আমলের বাজার ‘মুলফৎগঞ্জ বাজার’। বাজারের সামনে পাকা সড়ক ছিল। সবই এই নদী গিলে ফেলেছে। আর বাজারের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল দেওয়ান পরিবারের। চোখের সামনে জমিদার পরিবারটি ফকির হয়ে গেল। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই তাদের।
প্রসঙ্গতঃ দেওয়ান পরিবারের মতো নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি, বাড়িঘর ও সহায়-সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। খোলা আকাশের নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে আশ্রয়হীন শত শত পরিবারের। কেউ কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে টিনের ছাউনি বা অস্থায়ী ভিত্তিতে ঘর তুলে মাঠের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার কারও ঠাঁই হয়েছে অন্যের বাড়ির উঠানে। নড়িয়া উপজেলার পদ্মা তীর সংলগ্ন ভাঙনকবলিত এলাকায় এখন শুধুই হাহাকার। অনেক বিত্তশালী পরিবার এখন অসহায়। অট্টালিকা, ফসলভরা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু হারিয়ে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনের বাড়িতে। কিন্তু নিজেদের আভিজাত্য ধরে রাখতে গিয়ে তারা যেন মুখও খুলতে পারছেন না। ফলে বেশিরভাগই তাদের থাকতে হচ্ছে অর্ধাহারে অনাহারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।