Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সর্বগ্রাসী পদ্মায় সর্বস্বান্ত

সেলিম আহমেদ, নড়িয়া (শরীয়তপুর) থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:৪২ এএম

আমার সব ছিল। কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু সর্বনাশা পদ্মা নদী আমাকে সর্বশান্ত করে দিয়ে গেছে। এখন মানুষের কাছে হাত পেতে খেতে হচ্ছে। পদ্মার পাড়ে বসে বুক চাপড়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বৃদ্ধ এসকান্দার শিকদার কথাগুলো বলছিলেন। তিনি পদ্মার তীর থেকে ওই দূরে হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, ওইখানে আমার বাড়ি ছিল। গোয়ালে গরু, গোলাভরা ধান ছিল। অথচ ওই জায়গাটিতে এখন পদ্মার প্রবল স্রোত। অথৈই পানি। যা কিনা শুধুই স্মৃতি। নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবেনা যে, কয়েক মাস আগে এই জায়গাগোলোতে লোকে লোকারন্য ছিল। আর আজ সেখানে শুধুই হাহাকার। নেই বাড়িঘর, সব বিলীন হয়ে গেছে পদ্মার গর্ভে।
কেদারপুর ইউনিয়নের সাহেবের চর গ্রামের ৭৬ বছর বয়সী এসকান্দার শিকদার বলেন, ৩ছেলে ২মেয়ের সংসার। মেয়ে দুটি বিয়ে দিয়েছেন। ১১একর ২০শতাংশ জমি ছিল তার। সেখানে ধনিয়া, মরিচ, কালিজিরা, সরিষা ও ধান চাষাবাদ করতেন। তার গোয়ালে ছিল ৫টা গরু। বাড়িতে ৫টা বড় টিনের ঘর। কিন্তু পদ্মার ভাঙ্গনে আজ নিঃস্ব তিনি। ঘরের মালামালও তিনি সরিয়ে নিতে পারেননি। পৌর এলাকার বিপ্লব চৌকিদারের বাড়িতেই হয়েছে তার বর্তমান আশ্রয়। এই বয়সে মানুষের কাছে হাত পেতে খেতে লজ্জা করে বলেই- দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
শুধু এসকান্দার শিকদারই নয়, তার মতো অনেকেই আজ নি:স্ব হয়েছে পদ্মার ভাঙ্গনে।
সরেজমিনে শরীয়তপুরের ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনও থেমে নেই পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গন। প্রতিদিন নতুন নতুন বাড়ি-ঘর, গাছপালা, ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল, বাজারঘাট, মন্দির, সড়ক বিলীন হচ্ছে নদী গর্ভে। এতে বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে। ভাঙ্গনকবলিত এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটাচ্ছে তারা। বাঁশতলা এলাকায় দেখা গেছে, যাদের বাড়ি-ঘর ভাঙ্গনের মুখে তারা ইটের দেয়ালগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে। যারা রাজমিস্ত্রীরীর কাজ করে তারা সেগুলো কিনে ইট খুলে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে।
পদ্মার ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ একাধিক পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, গত তিন মাস যাবত শরীয়তপুরের নড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গন চলছে। পদ্মার ভয়াল স্রোতের টানে প্রতিদিন নতুন নতুন বাড়ি-ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাঙ্গনের শুরুতেই সরকার ব্যবস্থা নিলে হয়তো এতো এতো বাড়িঘর বিলীন হতো না। আমাদেরকেও আজ রাস্তায়, খোলা আকাশের নীচে থাকতে হতো না।
স্থানীয়রা জানায়, গত তিন মাসে নড়িয়া উপজেলা ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্তত ৭ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে ম‚লফৎগঞ্জ বাজারের প্রায় শতাধিক দোকান পাট। তবে বাজারটির সামনের কয়েকশ’ দোকান পাট, পাকা সড়ক আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া নড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের এক অংশ, মসজিদ নদী গর্ভে।
তবে গত রবিবার দুপুরে দেখা গেছে মূলফৎগঞ্জ বাজারে ভাঙ্গন ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বালুর বস্তা ফেলে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
মূলফৎগঞ্জ বাজারে পদ্মার তীরে স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ জয়নাল আবেদীন রিক্সা ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছেন। ভাঙ্গরে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে পদ্মা নদীর আরো সামনে এক কিলোমিটার দেখিয়ে বলেন ওই খানে বাজারটা ছিল। বৃটিশ আমলের বাজার ‘মূলফৎগঞ্জ বাজার’। বাজারের সামনে পাকা সড়ক ছিল। সবই এই নদী গিলে ফেলেছে। ভাঙ্গন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফালানো দেখে তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, আর কটা দিন আগে ফেললে হয়তো এতোটা ক্ষতির সম্মূখীন হতে হতো না মানুষের। তিনি বলেন, এ ভাঙ্গনের কবলে সে ও তার পরিবারের অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই পেটের তাগিতে ডাব বিক্রি করে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে।
এদিকে নড়িয়ার গাজী কালুর আস্তানা, যেখানে বছরে একবার ওরস হয়। সেই আস্তানাটিও টেকেনি। তিন তলা সুরম্য আস্তানাটির অতিথিশালা পুরোটাই নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়েগেছে। সাধুরবাজার এলাকায় কয়েকটি বাড়ি-ঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি, বাড়িঘর ও সহায়-সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। খোলা আকাশের নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে আশ্রয়হীন শত শত পরিবারের। কেউ কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে টিনের ছাউনি বা অস্থায়ী ভিত্তিতে ঘর তুলে মাঠের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার কারও ঠাই হয়েছে অন্যের বাড়ির উঠানে।
নড়িয়া উপজেলার পদ্মাতীর সংলগ্ন ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ধরে হাঁটলে দেখা মেলে শুধুই মানুষের হাহাকার। অনেক বিত্তশালী পরিবার এখন অসহায়। অট্টালিকা, ফসলভরা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু হারিয়ে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনের বাড়িতে। কিন্তু নিজেদের আভিজাত্য ধরে রাখতে গিয়ে তারা যেন মুখও খুলতে পারছেন না। ফলে বেশিরভাগই তাদের থাকতে হচ্ছে অর্ধাহারে অনাহারে।
নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জের দেওয়ান পরিবারটি এলাকায় ‘জমিদার’ পরিবার হিসেবে পরিচিত। বহু বছর আগে থেকেই বিত্ত-সম্পদে তাদের নাম-যশ রয়েছে। পদ্মার ভাঙ্গনে পুরো পরিবারটি এখন নিঃস্ব। এ পরিবারের শত কোটি টাকার সম্পত্তি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
দেওয়ান পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান হাজী নূর হোসেন দেওয়ান বলেন, কয়েক দিন আগেও শত কোটি টাকার মালিক ছিলাম। দোকান-পাট, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল সবই ছিল আর এখন নি:স্ব। পরিবার নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছি।
নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান বলেছেন, কেদারপুরের চরজুজিরা গ্রামে তিনি ‘আদর্শ’ বাড়ি তৈরি করেছিলেন। মূলফৎগঞ্জ বাজারে তার বিশাল ব্যবসা ছিল। এর সবই এবার নদীতে চলে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পদ্মার তীর রক্ষায় হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প পাস হয়েছিল সময়মতো তার কাজ শুরু হলে নড়িয়ার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতো না।
নড়িয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাঁশতলা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মৃত জলিলের স্ত্রী মায়া। তিনি জানান, পৌরসভার এক নং ওয়ার্ডের চড় নড়িয়া এলাকায় ১২শতাংশ জমির উপর তার বাড়ি ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর ওই বাড়িতেই বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। হঠাৎ রোজার ঈদের কয়েকদির আগে পদ্মার ঢেউ কেড়ে নেয় তার বসতভিটাসহ ঘরের সমস্ত মালামাল। কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, পরে কোন উপায় না পেয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও অটো চালক ছেলের উপার্জনের টাকায় কোন রকম দু’মুঠ খেয়ে বেঁচে আছি।
পূর্ব নড়িয়া এলাকার বৃদ্ধ আব্দুল কাদের ফকির বলেন, নদীর ভাঙ্গনের তীব্রতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের মাদবরকান্দি, ঈশ্বরকাঠি, কেদারপুর ইউনিয়নের পাঁচগাঁও, উত্তর কেদারপুর, মূলফৎগঞ্জ, চরজুজিরা ও নড়িয়া পৌসভার ১, ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ও বাড়িঘর সহায়সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার কেউ কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে টিনের ছাউনি বা অস্থায়ী ভিত্তিতে ঘর তুলে মাঠের মধ্যে বসবাস করছেন।
আশ্রয়হীন রাজিয়া বেগম বলেন, সর্বনাশা পদ্মা নদী আমার ১২ শতাংশ জমির উপর বাড়িটি গ্রাস করে নিয়েছে। আমরা এখন হায়দার চৌকিদারের বাগানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের দেখার কেউ নেই, কেউ আমাদের খোঁজ-খবরও নেয় না। আমরা মরে গেছি না বেঁচে আছি তাও কেউ খবর নেয় না।
তবে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের দাবী, তারা ১০ কেজি করে চাউল এক কেজি করে ডাউল, তৈল সাহায্য পেয়েছেন। তবে এ সাহায্য কারা দিয়েছে তা তারা বলতে পারেননি।
জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর কালু বেপারী স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. সুরুজ মিয়া বলেন, আমাদের বিদ্যালয়টি আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। কোথায়ও জায়গা না পেয়ে পাশের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও মাঠে পাঠদান কার্যক্রম চালাচ্ছি।
আশ্রয়হীন এলাকায় ঘুরে আরো দেখা গেছে, সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্যানিটেশন ও শিশু খাদ্যের সমস্যা রয়েছে প্রকট। জরুরি ভিত্তিতে ওই সকল এলাকায় স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শিশুদের জন্য খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে সচেতন মহল মনে করছেন।
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুনীর আহম্মেদ বলেন, সরকারী এ হাসপাতালটিও ঝুকির মধ্যে রয়েছে। হাসপাতালের নতুন ভবনটির অধিকাংশ পদ্মায় চলে গেছে। হাসপাতালের আরো কয়েটি ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে। এখন সীমিত পরিসরে জরুরি ও বহিঃবিভাগের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। আতঙ্কে রোগীরাও আসছে না।
বাঁশতলা এলাকার পান্না বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে একটি ঘর বানিয়ে ছিলাম। আজ পদ্মা আমার সেই ঘরখানা কেড়ে নিয়েছে। সাথে আমার স্বপ্নও।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীর নড়িয়া-জাজিরার বেশ কিছু অংশে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গন রোধে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। শীঘ্রই ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাঙ্গন রোধ করার মতো কোনো অবস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেই। তবে স্থানীয় মানুষের দূরবস্থার কথা বিবেচনা করে কিছু স্থানে বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমীন বলেন, ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রীর জন্য দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। ত্রাণ সামগ্রী আসা মাত্রই ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণ করা হবে।



 

Show all comments
  • আবু নোমান ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৫:০০ এএম says : 0
    পদ্মার ভাঙ্গনে আজ অনেকেই নিঃস্ব
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পদ্মা

১১ জানুয়ারি, ২০২৩
৩১ অক্টোবর, ২০২২
৪ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ