Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বালআম ইবনে বাউরার করুণ পরিণতির কাহিনী

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

আল্লাহ তাআলা কোরআনের ৭ নং সূরা আ’রাফে বলেছেন, ‘তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও, যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন। অতঃপর সে উহাকে বর্জন করে, পরে শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি ইচ্ছা করলে এ দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম, কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তার অবস্থা কুকুরের ন্যায়, উহার ওপর তুমি বোঝা চাপালে সে হাঁপাতে থাকে এবং তুমি বোঝা না চাপালেও হাঁপায়। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবস্থাও এই রূপ, তুমি বৃত্তান্ত বিবৃত কর যাতে তারা চিন্তা করে’ (আয়াত: ১৭৫-১৭৬)।
হজরত মূসা (আ.) এর সময় অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর বহু ঘটনা ঘটেছে এবং খোদাদ্রোহী নাফরমানদের ওপর নানা প্রকারের আজাব-অভিশাপ এসেছে। কোনো কোনো লোককে আল্লাহ তাআলা অসীম মর্যাদার অধিকারী করে ‘মোস্তাজাবুত দাওয়াত’ (যার যে কোনো দোয়া আল্লাহ কবুল করতেন) করেছিলেন। এমনি আল্লাহর এক মকবুল (প্রিয়) বান্দাকে তার নাফরমানীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে দুনিয়াতে তিনি নিকৃষ্টতম এবং ঘৃণিত শাস্তি প্রদান করেন। বর্ণিত আয়াতদ্বয়ে সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। অবশ্য এদুটি আয়াতের ‘শানে নুজুল’ সম্পর্কে মতভেদ পরিলক্ষিত হয় এবং কোরআনের ভাষ্যকারগণ এ সম্বন্ধে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মত বা ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যথা: ১. হজরত ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ এবং মোজাহেদ বলেন যে, হজরত মূসা (আ.) ইসরাইলী বংশীয়গণের সাথে ‘মাওয়াব’ প্রান্তরে উপস্থিত হলে, ‘মাওয়াব’ অঞ্চলের অধিপতি ‘শফুর’ ভীত হয়ে তাদেরকে অভিশাপ প্রদানের জন্য ‘বালআম ইবনে বাউরা’ নামক এক সিদ্ধ পুরুষকে আহ্বান করেন। ‘বালআম ইবনে বাউরা’ তার আহ্বানে যাত্রা করলে তার গাধী (গর্দভ) পথের মধ্যে পড়ে যায়। বালআম তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে ইসরাইলী বংশীয়দেরকে অভিশাপ প্রদানের জন্য একটি পর্বতের ওপর আরোহণ করে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে ইহুদীদের প্রতি অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ বের হয়ে পড়ে এবং উক্ত দুষ্কার্যের জন্য তার সমস্ত অভিশাপ বিনষ্ট হয়ে যায়। ২. আরেকটি মত হচ্ছে এই যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, সাঈদ ও জায়দ প্রমুখ বলেন যে, উম্মিয়া ইবনে আবি সালত নামক এক ব্যক্তির হজরত রসূলুল্লাহ (সা.) এর সত্যতা অস্বীকার ও তার বিরুদ্বাচরণের প্রতি লক্ষ্য করেই এই আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ হয়েছে। (হাক্কানী) ৩. পক্ষান্তরে কাতাদা, আকরামা এবং আবু মুসলিম বলেন যে, আয়াতদ্বয়ের লক্ষ্য সাধারণ। যারা জেনে শুনে আত্মাহঙ্কার ও প্রবৃত্তির বশে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদেরকেই সতর্ক করা হয়েছে।
বিভিন্ন তফসীর ও অন্যান্য গ্রন্থে বালআম ইবনে বাউরা’র ঘটনাটি আয়াতের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারই বিবরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। এখানে তা সংক্ষেপে বর্ণিত হল: আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, ‘আপনার কওমকে এই কাহিনী পাঠ করে শুনান’। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম সম্বন্ধে মতভেদের বিষয়টি বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, বালআম ইবনে বাউরা। মোজাহেদ বলেন, বালআম (আইনের পর আলিফ) ইবনে বায়ের। ইবনে মাসউদ বলেন, বালআম ইবনে আবের (প্রথমে আলিফ), ইবনে আব্বাসের বরাতে আতিয়া বলেন যে, লোকটি ছিল বনি ইসরাইল বংশীয়। অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, লোকটি কেনআন বংশীয় জাব্বারীন (অধিপত্যবাদীদের) শহরের অধিবাসী ছিল। মোকাতেল বলেন, লোকটি ‘বালকা’ শহরের অধিবাসী ছিল।
সীরাত ও ইতিহাস রচয়িতাগণ ইবনে আব্বাস, মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক এবং সুদ্দী প্রমুখের বরাতে ঘটনার প্রদত্ত বিবরণই অধিক প্রচলিত। এ বর্ণনার আলোকে ঘটনাটি বিভিন্ন তফসীর গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। বর্ণিত আয়াত ‘বালআম ইবনে বাউরা’ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে বলে যারা মত প্রকাশ করেছেন তারা বালআম এর কেচ্ছাটি প্রসঙ্গে বলেন, বালআম ছিল একজন বিজ্ঞ আলেম, সিদ্ধ পুরুষ এবং সাধক। সে আল্লাহর নিদর্শনাবলী ত্যাগ করে শয়তান ও এক নারীর প্ররোচনা ও অর্থের লোভে হজরত মূসা (আ.) এর মোকাবিলায় নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন ও অসৎ উদ্দেশ্যাবলী চরিতার্থ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। অবশেষে মূসা (আ.) এর কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। বরং নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে এবং মরদুদ ও চির অভিশপ্ত হয়। আল্লাহর নিদর্শনাবলীর যে জ্ঞান তাকে দেওয়া হয়েছিল, আল্লাহ চাইলে তা দ্বারা তাকে বহু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করতেন। আর তা তখনই সম্ভব হতো, যদি সে প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী চলত এবং আল্লাহপ্রদত্ত নিদর্শনাবলীর অনুসরণ করতে সক্ষম হতো। কিন্তু এমনটি হয়নি, কেননা সে আসমানী অবদান ও নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পার্থিব ভোগ বিলাসিতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সে রিফুর তাড়নায় আকৃষ্ট হয়ে শয়তানের অনুসরণ করতে থাকে এবং পথভ্রষ্ট বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়ে পড়ে। তখন তার অবস্থা ছিল কুকুরের ন্যায়, যার জিভ বাইরের দিকে ঝুলছে এবং সে সার্বক্ষণিক হাঁপাচ্ছে। যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে আয়াতের মাধ্যমে।
ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, হজরত মূসা (আ.) যখন ‘জাব্বারীন’ (আধিপত্যবাদী) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সিরিয়ার ভ‚খন্ডে গিয়ে উপনীত হন, তখন ‘বালআম ইবনে বাউরা’র সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে তার কাছে অনুরোধ করতে লাগল যে, হজরত মূসা (আ.) সিরিয়ার কেনআন অঞ্চলে আগমন করেন তখন বালআম সম্প্রদায় তার কাছে এসে বলল, ‘মূসা (আ.) কঠোর ব্যক্তি এবং তার সাথে রয়েছে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী। আমাদের শহর হতে তিনি আমাদেরকে বহিষ্কার করবেন এবং আমাদেরকে হত্যা করবেন। তাছাড়া তিনি আমাদের দেশ হতে আমাদেরকে বিতাড়িত করবেন এবং আমাদের স্থলে বনি ইসরাইলকে এ ভূখন্ডে পুনর্বাসিত করবেন। সুতরাং, আপনার নিকট যেহেতু ‘ইসমে আজম’ আছে তাই আপনার দোয়া কবুল হবে। তাই আপনি বের হন এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করুন যাতে আল্লাহ তাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেন।’ বালআম বলল; ‘ওয়াই লাকুম! নবী উল্লাহে ওয়া মাহু মালায়িকাতুহু ওয়াল মোমেনুন, ফাকাইফা আদউ আলাইহিম... জাহাবাত দুনিয়ায়ি ওয়া আখেরাতি।’ অর্থাৎ- ধিক তোমাদের! তিনি আল্লাহর নবী এবং তার সঙ্গে রয়েছেন ফেরেশতাগণ ও মোমেনগণ। সুতরাং, কীভাবে আমি তাদের জন্য বদদোয়া করব এবং আমি আল্লাহর পক্ষ হতে যদি এটা করি তা হলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হয়ে যাবে। (খাজেন)
‘বালআম ইবনে বাউরা’র এ অস্বীকৃতির কথা শুনে তার সম্প্রদায় তাৎক্ষণিকভাবে ফিরে গেলেও আবার তার কাছে এসে অনুনয়-বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতে লাগল যে, তিনি যেন বদদোয়া করেন। তাদের বার বার অনুরোধে বালআম বলল, ‘আমি প্রথমে আমার প্রতিপালকের নির্দেশ জেনে নিতে চাই।’ তার নিয়মই ছিল যে, যখনই কোন বিষয়ে প্রার্থনা করত, তখন তার পূর্বে আল্লাহর ইচ্ছা জেনে নিত এবং স্বপ্নে সেটার জবাব পেয়ে যেত। সুতরাং, এবারও সে এই জবাবও পেয়েছিল যে, সে যেন হজরত মূসা (আ.) ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে বদদোয়া বা প্রার্থনা না করে।
অতঃপর বালআম তার সম্প্রদায়কে জানিয়ে দিল, ‘আমি আমার প্রতিপালকের নিকট অনুমতি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার প্রতিপালক তাদের বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।’ তখন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে উপঢৌকন (ঘুষ) ও নজরানা পেশ করে এবং সেগুলো সে গ্রহণ করে। আর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের অনুরোধ অব্যাহত রাখে। অতঃপর ‘বালআম ইবনে বাউরা’ দ্বিতীয়বার আল্লাহ তাআলার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে। এবার কিন্তু কোন জবাব পাওয়া গেল না। তখন সম্প্রদায়কে সে বলল, ‘এবার তো কোন জবাবই পেলাম না।’ তখন সম্প্রদায়ের লোকেরা বলতে লাগল, ‘যদি তা আল্লাহর নিকট মঞ্জুর না হতো, তবে প্রথম বারের মতো এবারও তিনি আপনাকে নিষেধ করে দিতেন।’ তখন সম্প্রদায়ের অনুরোধের মাত্রা পূর্বের চেয়ে আরও অধিক হলো।
এর পরের কাহিনীর সাথে জড়িত রয়েছে ‘বালআম ইবনে বাউরা’র খোদাদ্রোহীতা ও দুনিয়াতে তার করুণ পরিণতির ঘটনা। কুকুরের ন্যায় জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে নিকৃষ্ট ও অপমানজনকভাবে তার জীবনের অবসান ঘটে।
কথিত আছে যে, বালআমের সম্প্রদায় কর্তৃক প্রদত্ত উৎকোচ, নজরানা গ্রহণ করার পর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে আরও পীড়াপীড়ি করতে লাগল হজরত মূসা (আ.) এর বিরুদ্ধে বদদোয়া করার জন্য। তাদের খোশামদ ও পীড়াপীড়িতে অভিভূত হয়ে সে বদদোয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। এ সম্পর্কে তফসিরী ভাষ্য হচ্ছে, ‘ফারাকিবা আতানান লাহু, মোতাওয়াজ্জিহান ইলা জাবালিন ইয়াত্তালিউহু আলা আসকারি বনি ইসরাইল, ইউকালু লিজালিকাল জাবালি জাবালু হিসান।’ অর্থাৎ বালআম তার গাধীর ওপর সোয়ার হয়ে হেসান নামক পর্বতের দিকে যাত্রা করে যেখান থেকে বনি ইসরাইল বাহিনীকে দেখা যেত। কিছু দূর যেতে না যেতেই গাধী হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। বালআম অবতরণ করে তাকে প্রহার করতে থাকে। মার খেয়ে গাধী আবার উঠে দাঁড়ায়। বালআম আরোহণ করে কিছু দূর যাওয়ার পর গাধী আবার পড়ে যায়। বালআম তাকে আবারও প্রহার করে। মার খেয়ে গাধী ফের কিছু দূর চলতে থাকে, বালআম আবার তার ওপর আরোহণ করে। এরূপ অবস্থা কয়েক বার চলতে থাকে এবং তার গাধীও মার খেতে থাকে। শেষ বারের মতো যখন গাধী পড়ে যায় এবং বালআম যখন তাকে মারতে উদ্যত হয়, তখন আল্লাহর নির্দেশে গাধীর মুখে বুলি ফুটে উঠে এবং সে বলে, ‘হে বালআম! তুমি দেখতে পাচ্ছ না যে, ফেরেশতারা আমার সামনে রয়েছেন, আমি যখন চলতে থাকি তখন তারা আমার মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। তুমি কি আল্লাহ তাআলার নবী ও মোমেনগণের বিরুদ্ধে বদদোয়া নিয়ে যাচ্ছ?’ এ সতর্ক বাণী বালআমের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করল না। আল্লাহ তাআলা তখন রাস্তা খুলে দেন এবং গাধী চলতে থাকে, এমনকি হেসান পর্বত দেখা দেয়। বলা হয়, পর্বতে পৌঁছে বালআম ‘ইসমে আজম’ এর মাধ্যমে দোয়া আরম্ভ করে এবং তার দোয়া কবুল হয় এবং হজরত মূসা (আ.) তার সৈন্যবাহিনী সহ ‘তিহ’ ময়দানে গিয়ে ফেঁসে যান।
অপরদিকে হজরত মূসা (আ.) আল্লাহ তাআলার দরবারে আরজ করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার কি পাপ হয়ে গেল, যে তুমি আমাকে এই ময়দানে নিক্ষেপ করলে?’ জবাবে আসে যে, ‘বালআম ইবনে বাউরা’র বদদোয়ার কারণে এরূপ ঘটেছে। মূসা (আ.) আরজ করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! যখন তুমি বালআমের বদদোয়া কবুল করেছ তখন তাঁর বিরুদ্ধে আমার বদদোয়াও কবুল কর।’ সুতরাং, তিনি এই বলে দোয়া করলেন, ‘হে আমার প্রভু! তুমি বালআম হতে তোমার ইসমে আজম প্রত্যাহার করে লও।’ অতঃপর হজরত মূসা (আ.) এর দোয়া কবুল হয় এবং বালআম হতে ‘মারফতে এলাহী’ ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং তা কবুতরের আকারে তার বক্ষ হতে বের হয়ে উড়ে চলে যায়।
আল্লামা দামিরী বলেন, এ বক্তব্য মোকাতেলের। কিন্তু হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও সুদ্দী বলেন, আল্লাহ তাআলা তার জবান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল যে, আপনি কি করছেন যে হজরত মূসা (আ.) এর স্থলে বদদোয়া করার পরিবর্তে আমাদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করছেন। বালআম জবাবে বলে, ‘এটি আমার ক্ষমতাবহিভর্‚ত, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ হতে ঘটেছে।’
হজরত মূসা (আ.) এর বদ দোয়ায় বালআম ‘ইসমে আজম’ ভুলে যায় এবং তার জবান তার বক্ষে লটকে পড়ে। অতএব, সে নিজের এই অবস্থা দেখে বলতে লাগল যে, আমার দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে এখন আমিও তাদের বিরুদ্ধে ধোকা ও প্রতারণার মাধ্যমে কাজ করব। সে তার সম্প্রদায়কে নির্দেশ দেয় যে, ‘তোমরা নিজের নারীদেরকে খুব সাজিয়ে সুসজ্জিত করে, বনি ইসরাইলের সৈন্যবাহিনীর নিকট প্রেরণ কর এবং তার পূর্বেই তাদেরকে কিছু মালমাত্তা দিয়ে দাও এবং তাদেরকে বলে দাও যে, তোমরা সৈন্যবাহিনীর সাথেই অবস্থান করবে এবং ইসরাইলী বাহিনীর যে কোন সেনা তাদের সাথে কুকর্মে লিপ্ত হতে চায় তাকে বাধা দিতে পারবে না। সেনাদের এক ব্যক্তিও যদি কোন নারীর সাথে ‘যেনা’য় (ব্যাভিচারে) লিপ্ত হয়, তাহলে অন্যরাও তা দেখে এ জঘণ্য পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে।’
অতএব নারীরা যখন বনি ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে পৌঁছে, তখন কেনআন গোত্রের এক মহিলাও তাদের মধ্যে ছিল। তার নাম ‘কাস্তি বিনতে সূর’। সে বনি ইসরাইলের এক বিরাট ধনী ব্যক্তির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এ ইসরাইলী ব্যক্তির নাম ‘জুমরী ইবনে শালুম’ এবং সে ছিল শামাউন ইবনে ইয়াকুবের বংশধর। লোকটি মহিলাকে দেখা মাত্র তার সামনে দাঁড়িয়ে তার গতিরোধ করে এবং তার রূপগুণে মুগ্ধ হয়ে তার হাত ধরে ফেলে এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে হজরত মূসা (আ.) এর নিকট উপস্থিত হয় এবং বলতে লাগল, ‘আপনি অবশ্যই বলবেন যে, এই মহিলা আমার জন্য হারাম (অবৈধ)।’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই এ তোমার জন্য হারাম এবং এর সঙ্গে তুমি কিছুতেই মিলতে পার না।’ সে বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি আপনার কথা কিছুতেই মানবো না।’ একথা বলেই সে মহিলাকে নিয়ে একটি গম্বুজে চলে যায় এবং সেখানে তার সাথে অবৈধকর্মে লিপ্ত হয়। এ পাপের পরিণতিতে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের ওপর ‘তাউন’ অর্থাৎ মহামারির আজাব রূপে নাজেল করেন।
হজরত মূসা (আ.) এর একজন নির্বাহী কর্মকর্তার নাম ফাখখাছ ইবনে আইজার ইবনে হারুন এ ঘটনার সময় অন্য স্থানে অবস্থান করছিলেন। দৈহিক দিক থেকে তিনি ছিলেন খুবই শক্তিশালী। তিনি প্রত্যাবর্তনের পর ‘তাউন’ মহামারি ও তার কারণ সম্পর্কে অবগত হন এবং তৎক্ষণাত সেই গম্বুজে চলে যান যেখানে জমরী ইবনে শালুম ও ঐ মহিলা পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তিনি উভয়কে উলঙ্গ অবস্থায় হাতে নাতে ধরে ফেলেন। অতঃপর তার বাণে তাদেরকে বিদ্ধ করেন এবং বগল দাবা করে বাইরে নিয়ে আসেন। তাদেরকে আসমানের দিকে উঁচু করে ধরে আল্লাহর দরবারে এই বলে আরজ করতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই রূপ পাপ করে তাকে আমরা এমনি শাস্তি প্রদান করে থাকি।’ অতঃপর তাদেরকে হত্যা করেন এবং দোয়া করার পর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইল হতে ‘তাউন’ উঠিয়ে নেন। বলা হয়, এ অপকর্মের সময় হতে ফাখখাছের দোয়া কবুল হওয়ার সময় পর্যন্ত (কারো কারো মতে এক ঘণ্টার মধ্যে) সত্তর হাজর লোক ‘তাউন’ মহামারিতে মারা যায়।
খোদাপ্রাপ্ত মানুষ কীভাবে খোদাদ্রোহী হয় এবং বিখ্যাত কীভাবে কুখ্যাত হয় তার অপূর্ব দৃষ্টান্ত ‘বালআম ইবনে বাউরা’। খোদার নৈকট্যলাভকারী প্রিয় বান্দা ‘ইসমে আজম’ এর অধিকারী হয়ে তা নবীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে নিজের খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ ক্ষমতার দাপট প্রদর্শন করতে গিয়ে ‘ইসমে আজম’ সহ সকল শক্তি-ক্ষমতা ও মর্যাদা সে হারিয়ে বসে এবং কুকুরের ন্যায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিভ বার করে মৃত্যুর আগে সে যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল তা তার দ্বীন দুনিয়া ধ্বংসের কারণ হওয়া ছাড়াও ডেকে আনা খোদায়ী আজাব ‘তাউন’ মহামারির শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল সত্তর হাজার বনি ইসরাইল। বালআমের নসিব হয়েছিল কুত্তা মরার মতো ঘৃণিত লাঞ্ছণার মৃত্যু। খোদার নবী-রসূলগণের শানে যারা গোস্তাখী করে, যারা তাদের অবমাননা করে, ‘বালআম কাহিনী’তে তাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা।



 

Show all comments
  • আমিন ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৮:৫৯ এএম says : 0
    Nice
    Total Reply(0) Reply
  • shahidullah ৭ মার্চ, ২০২২, ১:৪৮ পিএম says : 0
    শিক্ষনীয়
    Total Reply(0) Reply
  • shahidullah ৭ মার্চ, ২০২২, ১:৫০ পিএম says : 0
    শিক্ষনীয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন