শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
তোমরা কি রঘুদার নাম শুনেছো?
সকলে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম বাবার মুখের দিকে! কারও মুখে টু শব্দ পর্যন্ত নেই, সকলের মনেই প্রশ্ন- কে ওই রঘুদা?
টপ্ করে ফারুক বলে ওঠল, জ্বি আব্বা, আমি শুনেছি। আমাদের গ্রামে রঘু নামে একজন গ্রাম্য ডাক্তার আছে। এলাকায় ওর খুব সুনাম, সে ইনজেকশন দিলেই রোগী মরে; মাঝেসাঝে মরা রোগীকেও ইনজেকশন দিয়ে বাঁচাতে চায়! সরবে হেসে ওঠল সকলে, বাবার মুখেও হাসির ঝলক, এই রঘু সেই রঘু না;
আজ তোমাদের এমন এক গল্প শোনাব যা কোনোদিন কোনো লেখক লিখেও নি, কিংবা কেউ শুনেও নি।
ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে কত যে গল্প শুনেছি হিসাবে নেই। বাবা প্রায়ই গর্ব করে বলতেন যে, তাঁর কাছে সাত বস্তা গল্প আছে। এখনও এক বস্তা ফুরায়নি। জানি না, বাকিগুলো আদৌ শোনা হবে কি না? শ্রাবণের মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠেছে। উঠোনের কোণে কদমতলে বিছানা পেতে বসে পরিবারের সকলে চন্দ্রালোকে কাত হয়ে বাবার মুখের গল্প শুনছি। গল্প বলায় বাবা স্কুলে যেমন ছিলেন পারদর্শী তেমনি পরিবারেও।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সকল ভাই-বোনদের সমাগম। কোরিয়া থেকে দেশে এসেছে ছোটভাই নেয়ামত, তার সাথে ভগ্নিপতি ফারুক এবং অলিও এসে উপস্থিত হয়েছে।
বাবা একটা সিগারেটে আগুন ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে তাহমিনা বলল, সিগারেটের অভ্যাসটা বাবার আজও গেল না। কবে যে তিঁনি সিগারেট বন্ধ করবেন কে জানে!
বাবার পাশে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন মা হাতপাখায় ব্যজন করছেন। সিগারেটের ধূয়া ত্যাগ করে বাবা বললেন, শোন এবার-
রঘুদার সাথে যখন আমার শেষ দেখা হয় তখন মেঘাচ্ছন্ন দুপর! সিলেট থেকে বাড়ি ফেরার পথে কুমিল্লাগামী ট্রেন না পেয়ে ঢাকাগামী ট্রেনে চড়ে আখাউড়া নামলাম; ওখান থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনে চড়ে কুমিল্লায় নেমে বাড়ি যাব।
ট্রেন থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজেই চায়ের দোকানে প্রবেশ করলাম। চায়ের অর্ডার দিয়ে টুলে বসার পরই টেবিলের অপর প্রান্তে বসে চা পানরত জনৈক ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি পড়ল। ওকে দেখেই খুব পরিচিত মনে হলো। আগেও যেন কতোবার লোকটিকে দেখেছি! হঠাৎ মনে হলো- লোকটিকে দেখতে বাল্যকালে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু রঘুনাথের মতো মনে হচ্ছে। লোকটিও বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখের চা গিলে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি রঘু না?
চায়ের কাপটি টেবিলের ওপর রেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসে তিনি বললেন, জ্বি হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকেও কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে!
আমি বিস্ময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমাকে চিনতে পারছ না রঘুদা! আমি মাজু মিয়া।
তিনিও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চাহনিতে তাকিয়ে বললেন, মাজু মিয়া! জয়পুরের মাজু মিয়া?
হ্যাঁ রঘুদা! এত সহজেই তুমি ভুলে গেলা?
কেমনে চিনব, বল? কত বছর পর তোমার সাথে আমার দেখা, বস.. বস।
বলো রঘুদা, তোমার কী খবর? কোথায় আছো? কী করছো? সেই যে বাড়ি ছেড়েছো, আর দেখাই গেল না তোমাকে।
রঘুুদার জীবনটা ছিল রহস্যময়। আমি যেবার হাই স্কুলে ভর্তি হলাম, রঘুদা দশম শ্রেণিতে পড়ে। মেধাবী ছিলেন তিনি, কোনো পাঠ একবার পড়লে দ্বিতীয়বার পড়তে হতো না। এমনকি ওর হাতের লেখা ছিল এতটাই চমৎকার যে, বিভিন্ন ফ্রন্টের টাইপের লেখাও হার মানত।
স্কুলের অফিসিয়াল বিভিন্ন চিঠি-পত্রাদিও কেরানী স্যার রঘুদাকে দিয়ে লেখাতেন। এজন্য ডিডি অফিস থেকে বহুবার প্রশংসাপত্রও পেয়েছিল রঘুদা। সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো- ওর সুদর্শন লেখায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছিল অর্চনা নামের একই শ্রেণিতে পড়–য়া এক বালিকা। রঘুদাকে কতটুকু ভালোবেসেছে অর্চনা, কিন্তু এর চেয়ে বেশি ভালোবাসত রঘুদার হাতের লেখা। সারারাত জেগে মনের মাধূরী দিয়ে অর্চনাকে চিঠি লিখত রঘুদা। স্কুলেই গিয়েই সেই চিঠি অর্চনার হাতে তুলে দিত। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় ওদের প্রেম বেশিদিন টিকে নি।
মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল যেদিন ঘোষিত হলো, সেদিন বিকেলে নদীর পাড়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে ওর পাশে গিয়ে বলেছিলাম, কী রঘুদা, তোমার পরীক্ষার খবর কী?
আনমনে বসে চুপ মেরে তাকিয়ে ছিল রঘুদা। আবার একই প্রশ্ন করলে তিনি অলক্ষ্যে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমার রেজাল্ট ভালো হয় নি।
বলরামপুরের অর্চনা মেট্রিক পাশ করার পর রঘুদার জন্য আর অপেক্ষা না করে বিয়ে করে স্বামীর হাত ধরে চলে গেল।
এরপর থেকে প্রতিবছরই রঘুদা মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ঠিকই কিন্তু পাশ করতে পারে না।
আমি যেবার মেট্রিক পরীক্ষা দিলাম, সেবারও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল রঘুদা। প্রথমবার ফেল করার পর থেকেই আমার মনে কৌতূহল ছিল যে, ভালো ছাত্র হওয়া স্বত্তে¡ও রঘুদা বারবার কেন ফেল করে? পরীক্ষার সময় আমি লেখা শেষ করে রঘুদার পাশে গিয়ে বলেছিলাম, কী রঘুদা, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? সব প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো লিখতে পারছো তো?
খাতাটি উল্টিয়ে আমাকে দেখিয়ে রঘুদা বলল, প্রশ্নপত্রের এমন কোনো প্রশ্ন নেই যার উত্তর আমার জানা নেই; কিন্তু একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তর শেষ করে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি শুরু করলাম।
বলো কি? পরীক্ষার সময় তো শেষ হয়ে গেল। আমি তো সবই লিখে ফেলেছি। বাকি প্রশ্নের উত্তর তুমি লিখবে কখন?
কী আর করব ভাই। তাড়াতাড়ি আমি লিখতে পারি না, আমার লেখার সুন্দর বটে! কিন্তু গতি কম।
খাতাটি উল্টিয়ে দেখলাম- ঠিকই! একটি প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরের কেবল আরম্ভ। গুটি গুটি লেখাগুলো বেশ সুন্দর বটে! যেন মুক্তার দানা বসিয়ে রেখেছে। যত ভালো ও সুন্দর লেখাই হোক-না কেন, মাত্র দুটি প্রশ্নের উত্তরের যদি শতভাগ নম্বরও দেয়া হয়, পাশ নাম্বারের কাছেও যাওয়া যাবে না।
মেট্রিক পাশ করা রঘুদার কপালে আর হলো না। রঘুদার ছোট ভাই-বোনেরা মেট্রিক পাশ করে বি.এ, এম.এ পড়ছে। পূজার ছুটিতে রঘুদার ভাই-বোনেরা বাড়িতে এল। এতবার পরীক্ষা দিয়েও মেট্রিক পাশ করতে না-পারায় বিভিন্নভাবে অপমান ও অপদস্ত করতে থাকল পরিবারের সকলে মিলে।
একদিকে নিজের অকৃতকার্যতার জ্বালা, অন্যদিকে চারদিকের মানুষের বিচিত্র তিরস্কার সহ্য করতে না পেরে, একদিন বাড়ি ছেড়ে অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেলেন রঘুদা।
বহু সুলকসন্ধ্যানের পরও খোঁজে পাওয়া যায় নি রঘুদাকে। অবশেষে সকলেই ধারণা করে নিয়েছে- রঘুদা হয়তো ভারতে চলে গেছে।
বাড়ি ছেড়ে বেরুবার পর কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাবার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা থেকে ট্রেনে চড়ে আখাউড়া গিয়ে নেমেছিল রঘুদা।
কিন্তু ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ জানে না। আখাউড়া স্টেশনে নেমে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আনমনে কত কী ভাবছে রঘুদা। কোনো এক অপরিচিত ষাটোর্ধ ব্যক্তির ডাকে ভাবনার চমক ভাঙে রঘুদার-
দাদাকে দেখে তো উচ্চ শিক্ষিতই মনে হয়! দয়াকরে এই কাগজে আমার ঠিকানাটা ও মোবাইল নম্বরটা লিখে দিবেন কি?
ঠিকানা লিখতে উচ্চ শিক্ষিত হওয়া লাগে না, বলো তোমার নাম-ঠিাকানা কী? (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।