Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এই নির্বিচার গণহত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

রোহিঙ্গাদের চিরতরে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইন জনপদে নজিরবিহীন গণহত্যা ও গণনির্যাতন চালিয়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম গণহত্যার শিকার হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। ধর্ষণের শিকার হয়েছে হাজার হাজার নারী। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি। এক কথায় নিধন ও নির্যাতনের এমন কোন পন্থা নেই, যা মিয়ানমার বাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা প্রয়োগ করেনি। গণমাধ্যমগুলোতে নির্যাতনের বিবরণ ও চিত্র দেখে আমরা নির্বাক! কোনো মানুষ কেমন করে আরেকজন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে, নদীতে ভাসিয়ে, গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করতে পারে, জীবন্ত কবর দিতে পারে আমরা ভেবে পাই না। কোনো সভ্যসমাজ, সভ্যজাতি কি এতো বর্বর হতে পারে?
বর্বর জাহিলিয়্যাতের যুগের কথা আমরা বই-পুস্তকে পড়েছি। তখন আপন বাবা তার মেয়েকে জীবন্ত কবর দিতো, নারীরা অহরহ ধর্ষিতা হতো, তখনকার সময়ে ইনসায়িাত বলতে কিছুই ছিল না, ছিল না নিরাপত্তা বলতে কিছুই। সর্বত্রই ছিল খুন, গুম, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি। জাহিলিয়্যাতের উগ্র, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের বর্বর কাহিনী আমরা দেখিনি, ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। রাখাইনের সাম্প্রতিক নৃশংসতায় আমরা যেন সেই যুগের বাস্তব রূপ দেখেছি, এমনকি রাখাইনের এই বর্বরতা জাহিলিয়্যাতকেও হার মানিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা এতটাই বর্বর ছিল যে, তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিধনযজ্ঞের কারণে রোহিঙ্গারা ভিতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য বন-জঙ্গল, নদী ও সাগর উপকূলে পালিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারেনি। নিরুপায় হয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের বসতভিটা ও জন্মস্থানের মায়া ত্যাগ করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্কটের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে মানবিকতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংঘটনগুলোসহ জনসাধারণ রোহিঙ্গাদের সেবায় এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আয়তনে ছোট্ট একটি দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। বিপুল জনসংখ্যার ছোট্ট দেশে আকস্মিকভাবে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০/১২ লাখ মানুষের ভরণ-পোষণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একদিকে তাদের ভরণ-পোষণ আর অপর দিকে তাদের আদি নিবাসে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি অনেক সংকট, ঝড়-ঝঞ্জা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
নির্যাতনের এক বছর হয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে বিশ্ব নেতৃত্ব কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে, এমন কোনো নিউজ এখনো পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু মাতামাতি করলেও রোহিঙ্গা নির্যাতনে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে বিচারের কাটগড়ায় দাঁড় করানোর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো একাধিকবার রোহিঙ্গা নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞের সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। এসব প্রতিবেদনে মিয়নমারের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইনে স্মরণকালের নজীরবিহীন গণহত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘রোহিঙ্গা সংকট: বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক বিশেষ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত এক গবেষণার ভিত্তিতে প্রকাশিত ‘ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা: দ্য আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স (জোরপূর্বক বস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা: অব্যক্ত অভিজ্ঞতা) বইয়ে ভয়াবহ এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮ হাজার রোহিঙ্গা হত্যা এবং ২৪ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আগুনে ছুড়ে নির্যাতন করা হয়েছে ১৭,৭১৮ জনকে, গণপিটুনিতে আহত হয়েছে ১,১৪,৮৭২ জন, গুলিতে আহত হয়েছে ৪১,১৯২ জন, গ্রেফতার হয়েছে ৫৫,৭১৮ জন, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ১,১৫,০২৬টি এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়া ছাড়াও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ১,১৩,২৮২টি ঘর-বাড়ি।
বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ রাখাইনে সামরিক বাহিনীর তান্ডবলীলায় ধ্বংসস্তূপ আর বিরানভূমিতে পরিণত রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর, আবাসস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে এসেছেন। আশ্রয় শিবিরে তাদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র দেখে চোখের পানি ফেলেছেন অনেকে। তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং মিয়নমারের সামরিক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার বিচার চেয়েছেন আন্তর্জাতিক মোড়লদের কাছে। কিন্তু বিচার করবে কে? নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষগুলো তো মুসলমান। যে জনপদে নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে, যে জনপদ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে, সেটাতো মুসলিম জনপদ। যারা আহত-নিহত-ধর্ষিত হয়েছে, তারাতো মুসলিম যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, নর-নরী, শিশু-বৃদ্ধরা। আর যারা বিচার করবে তারা তো সভ্যরূপী মুসলিম বিদ্বেষী চক্র। তারা চায় না মুসলমানরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক। মুসলমানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তাইতো আমরা দেখি বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর প্রতি তাদের রক্তচক্ষু। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো আজ তাদের চক্রান্তে জর্জরিত। ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে ধ্বংস করে দিতে চায়। ফিলিস্তিনি নিরীহ মুসলমানদের উপর ইসরাইলী ইহুদী ও তাদের দোসররা নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। মুসলমানদের দ্বিতীয় ক্বিবলা আল-আক্বসা বার বার তাদের হামলার শিকার হচ্ছে। মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আল-আক্বসা। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মির, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক, ইয়েমেন, মিয়নমার এবং ভারতের আসাম রাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা ইসলাম বিদ্বেষীদের রোষানলের শিকার। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মুসলমানরা নির্যাতিত-নিপীড়িত। আর মুসলিম বিশ্বের নেতারা? মুসলিম নেতারা আরাম-আয়েশ-ভোগবিলাস আর আত্মকলহে লিপ্ত।
আজ মুসলমানরা ভুলে গেছে তাদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস। যখন দুনিয়ার নেতৃত্বের বাগডোর সেই সমস্ত ব্যক্তির হাতে ছিল, যারা ঈমান-আক্বিদা, আমল-আখলাক, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং উন্নত চরিত্রের দিক থেকে ছিলেন মডেল। তাঁরা ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.) এর আদর্শে আদর্শবান। তাঁদের জীবননীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির মূল উপাদান ছিল হাদিস ও আল-কোরআন। তাঁরা আধ্যাত্মিকতা, সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্বের গুণে শাসন করেছিলেন আধা জাহান। তাঁরা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে উড়িয়েছিলেন ইসলামের বিজয় নিশান। আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে মুসলমানরা তাদের সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম সালাতানাতের ধজাধারীদের অনেকেই নিজেদেরকে জনগণের প্রতিনিধির বদলে শাসক মনে করেন। তারা সেবানীতির বিপরীতে শোষণনীতি আর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের নেশায় মত্ত। সেই সব গুণ তাদের মধ্যে অনুপস্থিত, যা আধা জাহান শাসনকারী মহৎ ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল। বর্তমান ঘুনেধরা অধিপতিদের জীবন আরাম-আয়েশ, ভোগবিলাস, সমৃদ্ধি ও আনন্দ উপভোগে আত্মহারা। ভোগবিলাসের মোহে তাদের থেকে হারিয়ে গেছে মানবিকতা, সাহসিকতা ও আত্মমর্যাদা। নেই তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য। এসব কারণেই যে সকল মুসলিম নেতা মানবতার মিশন নিয়ে দুনিয়াব্যাপী কাজ করছেন তাঁরা তাদের যোগ্য সহযোগী পাচ্ছেন না। অপর দিকে ইসলাম বিদ্বেষীরা ঐক্যবদ্ধ। তাদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে তারা মুসলমানদের উপর একের পর এক অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে পৃথিবী থেকে মুসলিম নিধনের মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতরা সংখ্যালঘুতার কারণে কখনো পরাজিত হবে না বরং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ বিদায় হজের ভাষণে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন এই দুইটি জিনিস নিজেদের জীবন চলার পথ ও পাথেয় হিসেবে অনুসরণ করবে ততদিন তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। আর এই দুইটি জিনিস হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ’।
আজকের সমাজ যদি পরিপূর্ণভাবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হতো, রাষ্ট্রনায়করা যদি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন, তাহলে সমাজে বিরাজ করতো শান্তি আর শান্তি। বিশ্বের আনাচে-কানাচে মুসলমানদের মার খেতে হতো না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। পরিণত হতে হতো না একের পর এক মুসলিম জনপদ বিরাণভুমি ও ধ্বংসস্তূপে। বহিরাগত হতে হতো না রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস থেকে। রাখাইন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির আসামসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের নির্যাতিত নিষ্পেষিত হতে হতো না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাঝে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সক্রিয় থাকলে ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলমানদের জুলুম-নির্যাতন-নির্বাসন ও অনিষ্ঠ সাধনের সাহস করতে পারতো না।
মুসলিম নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হোক। নববলে বলিয়ান হয়ে উঠুক মুসলিম জাতি। দুনিয়াব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হোক শান্তি আর নিরাপত্তা। মজলুম জনতা মুক্তি পাক, জালিম নিপাত যাক। অবসান হোক জুলুম নির্যাতনের। ফিলিস্তিন, রাখাইন, সিরিয়া, কাশ্মির, আসামসহ বিশ্বের মুসলমানদের উপর সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার বিচার হোক।
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, ইসলাম পুর, সিলেট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন