Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষা-বন্দনা

বা সা র তা সা উ ফ | প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

‘এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘন-ঘোর বরিষায়...।’
এমন দিনে আসলে কী বলা যায়? কবিগুরু বলে যান নি। তবে এমন ঘন ঘোর বরিষায় কী হয়ে যায় মনের অবস্থা- তা ¯পষ্ট বোঝা যায় তাঁর এই কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে কয়েকটি রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার ঔপন্যাসিক, গীতিকার। আমরা তাঁকে বিশ^কবি বা কবিগুরু বলতেই বেশি পছন্দ করি। প্রাকৃতিক সকল বিষয়েই কবিতা, গান এবং গল্প লিখেছেন। বাংলা ছয়টি ঋতুর বর্ণনা তাঁর লেখায় আমরা পেয়েছি। তবে তাঁর বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ যে সময়কে নিয়ে রচিত তাঁকে সেই বর্ষার কবি বললেও অতুক্তি হবে না। বর্ষা বিষয়ক এত কবিতা ও গান তিনি লিখেছেন এবং সেগুলি এতটাই উৎকৃষ্ট যে, বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির কবিতা কিংবা গানে এমনটি পাওয়া যায় না। আনন্দ-উচ্ছ¡াসে, নিসর্গরস উপভোগে, প্রেমের করুণ আর্তিতে, দূর অতীতের স্বপ্নকল্পনায়, অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বিচিত্রভাবে বর্ষা, মেঘ, বৃষ্টি তাঁর কবিতায়, সঙ্গীতে উৎকলিত হয়েছে। তিনি বাল্যবয়সেই ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ দিয়ে শুরু করেছেন বর্ষা-বন্দনা। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপর, বর্ষার দিনে, মেঘদূত, বর্ষাযাপন, বর্ষামঙ্গল, আষাঢ়, আষাঢ়-সন্ধ্যা, আবির্ভাব, বর্ষার রূপ ইত্যাদি কবিতা তাঁকে বর্ষার কবিরূপে সংস্থাপিত করেছে। তিনি ‘যায় দিন, শ্রাবণ দিন যায়’ বলে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ উন্মাতাল হয়ে প্রেয়সিকে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ দান করে আনমনে কিছু বলতে গিয়ে অকস্মাৎ থেমেছেন। আর থেমে গিয়ে হাজার বছর ধরে প্রেমিক হৃদয় আবেগাপ্লুত একটি স্বর গেঁেথে দিয়েছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়...।’ আসলে কী বলা যায়? বলা যায় না কিছুই। শুধু অনুভূতিগুলো মনের দরোজায় কড়া নেড়ে পাখা মেলে উড়ে যেতে চায় নিঃসীম আকাশের ওপারে। কিন্তু সেখানে কি আর যাওয়া যায়? অগত্যা ‘কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা...!’
শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, বর্ষাকাল নিয়ে আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক কাব্য ও গীত রচনা করেছেন। বজ্রের হৃৎকাঁপুনি আর ঝরো ঝরো বারিধারায় কাব্যচিত্তে আবেগ ও প্রকৃতির প্রেমে বিগলিত হয়ে মহাকবি কালিদাসও লিখেছেন বিখ্যাত ‘মেঘদূত’ ও ‘ঋতুসংহার।’ কবি জয়দেব লিখেছেন, ‘গীত-গোবিন্দ।’ এরপর ‘মেঘদূত’ ও ‘ঋতুসংহার’ ও ‘গীত-গোবিন্দ’র প্রভাবে বাংলার কবিগণ বর্ষার ছন্দময় কাব্য ও গীত রচনা করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
বিদ্যাপতি বিরহ-মিলন-অভিসারের বর্ণনায় প্রাচীন পদাবলি কাব্য-গীতে লিখেছেন-
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহভাদর
শূন্য মন্দিওে মোর!
ঝম্পি ঘন গবজন্তি সন্ততি
ভূবন ভরি বরিখÐিয়া
কান্ত পাহুন কামদারুণ
সখন খর কর হন্তিয়া’
ঘনঘোর এক অন্ধকার বর্ষার রাতে চন্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণ অভিসারে এসেছেন। তাই চন্ডিদাস লিখেছেন-
‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া তিতিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে...!’
বৃষ্টির ঝরো ঝরো ধারা, মেঘের ডমরুনিনাদ, বজ্রপাত, বিজলি আর বর্ষার রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে কবি অক্ষয় কুমার বড়াল লিখেছেন- ‘নীল মেঘ নিরূপম
চেয়ে আছে স্বপ্নসম
চপল চেতনাসম
কভূ শিহরায়...!’
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক অনেক কবিই বর্ষার প্রসঙ্গ নিয়ে গান ও কবিতা লিখেছেন। কবি করুণানিধান বন্দোপাধ্যায়ের বর্ষার বর্ণনা এমন- ‘গ্রামে ঢোকে জল গাঙে নামে ঢল
আকাশের কোলে কোমল কাজল
এসেছে বরষা- বড় চঞ্চল...!’
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের ‘শ্রাবণ’ নামের সনেটে পড়েছি-
‘মূর্তিমতী বর্ষা তুই! রিমঝিম করি
পড়ে জল, হে কণক, হে চিরদুঃখিনী,
কত মেঘ আছে তোর প্রাণের ভিতরি?
কত গরজন আছে, কত বা অশনি?’
মোহিতলাল মজুমদারের ‘শ্রাবণ-শর্বরী’ সনেটে কালিদাস এবং বৈষ্ণব পদ কর্তাদের প্রতিধ্বনি, কিছু আবেগের উত্তাপ প্রাণের উষ্ণতা পাওয়া যায়-
‘কত আঁখিজল অশ্রæজলে বরিয়াছে শ্রাবণ শর্বরী
প্রিয়হারা বিরহী সে, বারিধারা হৃদয়বিধুর।
কত রাধা বায়ুরবে শুনিয়াছে শ্যামের বাঁশরী,
নিশীথের নীলাঞ্জনে আঁকিয়াছে বদনবঁধুর।’
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলার কাব্যগীতে বর্ষার আবাহনী কাজী নজরুলের মতো আর কেউ লেখেননি।
বর্ষা নজরুলের কাছে বিচিত্রভাবে ধরা দিয়েছে। কখনো কাজলবরণ এক পল্লীমেয়ে- যে বৃষ্টিধারায় নেয়ে বেড়ায়। কখনো গোমতি নদীর চরে খেলতে আসা মেঘপরি। এছাড়া প্রাচীন কবিদের বর্ণনায় বর্ষাকে ঝরঝর বৃষ্টির ধারাপাত, চঞ্চল ঘোরকৃষ্ণ মেঘের ডমরুনিনাদ, ভেক, ময়ূর, ডাহুক, বকুল-কদম-মালতী-কেতকী-কাঁঠালিচাঁপা, জাতি-যথী,মল্লিকা-কামিনী-করবী ফুলের নব তৃণদল, নবীনধান্য, পূবালী বায়, বেণু বন, জাম্বু বন, নীল অঞ্জন, কাত কপোত, ঝিল্লিরব ও কাজরী নামে পাই। তবে আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে মদুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, মোজাম্মেল হক, কায়েকোবাদ, মীর মশাররফ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী কাব্যে বর্ষার চিত্র তেমন পাওয়া যায় না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষা-বন্দনা

১০ আগস্ট, ২০১৮
আরও পড়ুন