Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাণিজ্য আর ঋণের মাধ্যমে একুশ শতকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে চীন-৩

টাইমস অব ইন্ডিয়া : মোম্বাসা, কেনিয়া | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

বোডা বোডা বা মোটর সাইকেল ট্যাক্সি চালক সাইমন এজিনা মোম্বাসার এক রেলক্রসিং-থেমে থাকার সময় অতিক্রমরত নাইরোবি অভিমুখী মালবাহী ট্রেনটির কন্টেইনারগুলো গুণছিলেন .... ৮২, ৮৩, ৮৪।
মালামাল ভর্তি কন্টেইনারের সংখ্যা অনেক। মোম্বাসা বন্দর হচ্ছে কেনিয়ার আমদানি লাইফলাইন, সেখানে সকল প্রকার যানবাহনের বিপুল ভিড়। বন্দর থেকে জাহাজের কন্টেইনারগুলো রেলস্টেশনে নিয়ে যেতে সার বেঁধে এগিয়ে চলেছে ট্রাকগুলো। তিন চাকার টুকটুকগুলো গরম দিনে ধুলোভরা, শোরগোল ও আবর্জনা ছড়িয়ে থাকা রাস্তায় অন্যান্য যানবাহনের ভিড়ে বিপজ্জনক ভাবে পথ করে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
কেনিয়ার বৃহত্তম বন্দর মোম্বাসা তার সবচেয়ে প্রাচীন বন্দরও। ২০১১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মোম্বাসা-কেনিয়া ন্যারো গেজ রেলওয়ে যখন ভগ্নদশায় উপনীত হল অন্যদিকে বেইজিং আফ্রিকার বাজারে বিনিয়োগ করতে এল তখন কেনিয়া তাতে সাড়া দিল। ৩৮০ কোটি ডলার ব্যয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে (এসজিআর) নির্মাণের জন্য কেনিয়া চীনের সাথে চুক্তি করে। ১৯৬৩ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মোম্বাসা-নাইরোবি এসজিআরই হচ্ছে দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্প।
কেনিয়া রেলওয়ের এমডি আটানাস মাইনা বলেন, চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পো. পরিচালিত এ প্রকল্পে ৩০ হাজারেরও বেশি কেনীয় সরাসরি চাকুরি পেয়েছে। সাব কন্ট্রাক্টরদের অধীনে কাজ করছে আরো ৮ হাজার লোক।
গত বছরের জুনে এ রেলপথে যাত্রীবহন শুরু হয়। ২৯৩ মাইল দূরত্বের এ রেলপথে প্রায় ১শ’ সেতু ও সেতুসদৃশ স্থাপনা রয়েছে যেগুলো টিসাভো পূর্ব ও টিসাভো পশ্চিম নামের দু’টি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে সিংহ, জেব্রা ও অন্যান্য বন্যপ্রাণি চলাচলের উপযোগী করে রেলপথের নিচ দিয়ে নির্মিত।
জানুয়ারি থেকে এ পথে মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। মালবাহী ট্রাকগুলোর মোম্বাসা থেকে নাইরোবি যেতে লাগে ৮ ঘন্টারও বেশি। সেখানে মালবাহী ট্রেন পৌঁছে ৫ ঘন্টায়। বসন্তকালে প্রতিদিন মোম্বাসা-নাইরোবি রুটে ৫টি মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। এ সংখ্যা কখনো ১২টিতেও পৌঁছে।
আরো বহু অবকাঠামো প্রকল্পের ন্যায় রেল লাইন প্রকল্পেও সমস্যা আছে। অর্থনীতিবিদ ও সরকারের সমালোচক ডেভিড এনডি বলেন, এটা বাণিজ্যিক ভাবে সম্ভাবনাময় নয়। দি স্ট্যান্ডার্ড নামে একটি কেনীয় সংবাদপত্র চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজকে তাদের স্থানীয় কর্মচারীদের সাথে আচরণের জন্য নতুন উপনিবেশবাদী, বর্ণবাদী ও মারাত্মক বৈষম্যকারী বলে অভিযুক্ত করেছে।
পরিবেশ কর্মীরা টিসাভো পার্কের ভিতর দিয়ে এ রেলপথ নেয়ার বিরুদ্ধে বাধা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা রেলপথের পরবর্তী নির্মাণ ঠেকাতে মামলা করেছেন যেটা নাইরোবির প্রান্তে অবস্থিত নাইরোবি ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে যাবে।
পুরনো রেলপথের ভগ্নদশার কারণে রমরমা হয়ে ওঠা ট্রাকে মালামাল পরিবহনের ব্যবসায়ীরা এখন উদ্বিগ্ন। রংগাই ওয়ার্কশপ ও ট্রান্সপোর্ট লিঃ-এর এমডি ভ্যানেসা ইভানস বলেন, এসজিআর দীর্ঘ মেয়াদে কেনিয়ার অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে, কিন্তু মোম্বাসা ও নাইরোবির রেল টার্মিনালগুলোতে সমন্বয়ের দুরবস্থা মালামাল পরিবহনে সমস্যা ও বিলম্ব ঘটাচ্ছে। নতুন রেললাইন আমাদের ব্যবসা প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। গত পাঁচ মাস যাবৎ আমরা খারাপ সময় পাড়ি দিচ্ছি।
প্রতিদিন সতাল ৮টায় যে ট্রেনটি নিয়মিত নাইরোবি ছেড়ে যায় তার নাম মাদারাকা এক্সপ্রেস। সোয়াহিলি ভাষায় মাদারাকা অর্থ ক্ষমতা বা দায়িত্ব। মাদারাকা দিবস কেনিয়ার জাতীয় ছুটি দিবস। পুরনো রেলওয়ে যদি কেনিয়ায় ব্রিটিশ শাসনের নিদর্শন হয় তালে চীনের অর্থে নির্মিত এ রেলওয়েও এ ধরণের সাম্রাজ্যবাদেরই নিদর্শন।
নীল স্যুট পরা একজন চীনা ইনস্ট্রাক্টর নিশ্চিত করেন যে যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার সময় কেনিয়ার জাতীয় পতাকার রঙের ইউনিফফরম পরিহিতা নারী ট্রেন অ্যটেন্ডান্টরা সুন্দর ভাবে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে। এসজিআরের ৩৮০ কোটি ডলারের মধ্যে চীন দেবে ৯০ শতাংশ অর্থ। আর বিশাল চায়নিজ কম্যুনিকেশন কনস্ট্রাকশন্স কোং রেললাইনটি প্রথম দশক চালাবে।
স্টেশন এলাকার চারপাশে বাড়ি, কন্টেইনার ইয়ার্ড ও ওয়ারহাউজ তৈরি হচ্ছে বলে তা কর্মচাঞ্চল্যে পূর্ণ। মোম্বাসা অভিমুখী রাস্তায় মরচে পড়া করোগেটেড লোহার ছাদ ও মাটির দেয়াল ঘেরা বাড়িগুলোর পাশে ইস্পাত ও কাচ স্টেশনগুলো ঝকমক করছে। এই বৈপরীত্য স্থানীয়দের মধ্যে বড় স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছে।
মোম্বাসায় অধ্যয়নরত ২১ বছর বয়স্ক ছাত্র মাইকেল নদুংগু সপ্তাহান্তে বাসে নাইরোবিতে যান। তিনি বলেন, এসজিআর আমার জীবনকে অনেক ভালো করে দিয়েছে। এটি দ্রæততর ও নিরাপদ। মোম্বাসায় যাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে। প্রথম ছয়মাসে তাদের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ। অর্থনীতির জন্য এটা ভালো। ২৬ বছর বয়স্ক ট্যাক্সি চালক স্টিফেন কাজুংগু বলেন, ব্যবসা বেশ ভালো চলছে।
২২ বছর বয়স্ক বোডা বোডা চালক এজিনা বলেন, দেশের এ অংশে এ ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন দেখতে পাবেন না। দূরে অপ¯্রয়িমান মালবাহী ট্রেন লক্ষ্য করে তিনি বলেন, এটা বিস্ময়কর।
পাইরাউস, গ্রীস
২০১৬ সালের বসন্তকাল। ইউরোপীয় সার্বভৌম ঋণ সংকটের শৃঙ্খলে গ্রীস আটকা। প্রতিবেশি ও ঋণদাতারা কৃচ্ছ্রতা কার্যকর করার জন্য গ্রীসকে বলছে। এ অবস্থায় গ্রীস একদা এথেন্সের সাথে দুর্ভেদ্য দেয়াল দ্বারা সংযুক্ত কয়েকতলা সমুদ্র বন্দর পাইরাউসকে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কসকো শিপিং কর্পোরেশনের কাছে বিক্রি করে দেয়।
এ চুক্তি চীনের বৃহত্তম বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শি তার মহাপ্রকল্পের উদ্যোগ শুরুরও আনেক আগে ২০০৯ সালে এ ঘটনা ঘটে। কসকো পাইরাউসের কন্টেইনার ব্যবসার অংশ পরিচালনার চুক্তি করে। চীনের সমুদ্র বাণিজ্য জোরদারে এ ছিল এক বিরাট অর্জন। বিনিয়োগে বেপরোয়া চীনের এভাবেই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ আসে।
কিন্তু চীনের উচ্চ মূল্যের বেল্ট অ্যান্ড রোড জাতীয় বহু বিনিয়োগের মত এটি কোনো উন্নয়নশীল দেশের দূরবর্তী সবুজ মাঠ নির্মাণ প্রকল্প নয়। পাইরাউস বন্দর চুক্তি চীন কর্তৃক ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন বন্দর ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র প্রবেশপথ ধীরে ধীরে তা দখলের পদক্ষেপ। আড়াই হাজার বছর ধরে পাইরাউস ছিল এথেন্সের সমুদ্র বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ কারখানা। ভ‚মধ্য সাগর তীরের এ বন্দর গ্রীসকে নৌপরাশক্তি হতে সাহায্য করেছিল।
হেলেনিক ওয়েল্ডিং এসোসিয়েশনের এম ডি আইওয়ানিস করডাটোস তার অফিস থেকে বন্দরের ২ নং পিয়ারে কসকোর মূল সৈকতে উঁচু করে রাখা কন্টেইনারের দেয়াল দেখতে পান। তিনি বলেন, কসকো যদি আগামীকাল জাদুর মত মিলিয়ে যায় তাহলে বিরাট ক্ষতি হবে। তারা যে চীনা সেটা কোনো বিষয় নয়, কথা হচ্ছে তারা একটি বেসরকারী কোম্পানি যারা এখানে সিরিয়াসলি ব্যবসা করছে।
২০১৬ সালের চুক্তি বলে কসকো পাইরাউস বন্দর কর্তৃপক্ষ (পিপিএ) এসএ-র ৬৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে যার মূল্য ৩৬ কোটি ৮৫ লাখ ইউরো ( ৪২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার)। চীনা নিয়ন্ত্রণে পিপিএ-র প্রথম বছরে নিট আয় ৬৯ শতাংশ বেড়ে হয় ১ কোটি ১৩ লাখ ইউরো। কন্টেইনার টার্মিনালের রাজস্ব বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। কসকো যখন প্রথম পাইরাউসে সম্পৃক্ত হয় , এটি ইউরোপের সপ্তম ব্যস্ততম কন্টেইনার বন্দরে উন্নীত হয়। দশ বছর আগে ইউরোপের শীর্ষ ১৫টি বন্দরের মধ্যে পাইরাউসের নাম ছিল না।
পাইরাউস তার নিজ অধিকারেই ব্যস্ত বন্দর। এখানকার ঘাটগুলোতে সপ্তাহান্তের সমুদ্র ভ্রমণের জন্য এথেন্সের ইয়টগুলো প্রস্তুত। প্যাসেঞ্জার ফেরিগুলো স্থানীয় লোকজন ও পর্যটকদের ইজিয়ান সাগরে ভ্রমণে নিয়ে যেতে শহর কেন্দ্রের কাছে নোঙর করে থাকে। আরো পশ্চিমে মেরামত কাজের ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকরা বোট সারাই কাজ করে।
এখন যদি আপনি সাগর পথে, ট্রেনে বা সড়ক পথে পাইরাউসে এসে পৌঁছেন তাহলে আপনি নির্মাণ কাজের মধ্যে পড়তে বাধ্য হবেন। দেখবেন শহরের এক বিরাট অংশে বুলডোজারগুলো সাবওয়ে স্টেশন ও গণপরিবহন সংযোগ তৈরির কাজ করছে। কসকো পাইরাউসের কেন্দ্রস্থে ফেরি ও ক্রুজ শিপ টার্মিনালগুলো উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলোতে যুক্ত হবে মল ও নতুন হোটেল। এ ছাড়া এলেফসিনা উপসাগরের আশপাশে কসকোর বিনিয়োগ এথেন্সের পশ্চিমে থ্রিয়াসিও সমভ‚মিতে গ্রীসের মরচে পড়া শিল্প-কেন্দ্রভ‚মির পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করতে পারে। এখানে রেল দ্বারা বন্দরের সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনাকৃত একটি লজিস্টিক সেন্টার বলকানের মধ্য দিয়ে উত্তর অভিমুখী পণ্য প্রেরণের সূচক এলাকা হতে পারে।
কিন্তু পাইরাউসের সবাই কসকো’র পিপিএ ক্রয়ের ব্যাপারে করডাটোসের মত উষ্ণ অনুভ‚তি পোষণ করে না। শহর কেন্দ্রের সেরাই সামগ্র বিক্রি করা এক মহিলা দোকান মালিক এভলাম্পিয়া কাভাথা বলেন, আমার যদি টাকা থাকত তাহলে বিদেশীদের হাতে যেতে না দিয়ে আমিই কিনে নিতাম।
কসকো’র উপস্থিতি এক মন্দ সময়ে সরকারের বেপরোয়া পদক্ষেপ। দেশের অন্যান্য অংশের মত পাইরাউসও অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয় যাতে সার্বভৌম ঋণ সংকটের সময় থেকে দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ বিলীন হয়ে যায়। শহরের প্রধান বিপণি এলাকা ছাড়া পাইরাউসের বাকি এলাকার দোকানগুলো গ্রীসের শহরগুলোতে অন্য শহরগুলোর মতই ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে।
পাইরাউস ডক ওয়ার্কার্স শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গিয়ের্গোস গোগোস বলেন, তিনি শ্রমিক সম্পর্ক ও স্থানীয় জনসমাজে চীনের সরকারী মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, আমরা মনে করি এ ধরনের অবকাঠামোকে ছেড়ে দেয়া রাষ্ট্রের ভুল। তিনি বলেন,বন্দর পরিচালনায় চীনাদের নিজস্ব পন্থা রয়েছে। কসকো চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তার রয়েছে চীনা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য।
বিশাল বিস্তৃত বেল্ট অ্যান্ড রোড বরাবর বিভিন্ন স্থানে চীনের বিনিয়োগ থেকে এটাই দেখা যায় যে চীন সেখানেই বিনিয়োগ করে যেখানে আর কেউ করে না। (শেষ)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ