পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হিন্দুত্ববাদী বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে ভারতের আসামসহ উত্তরের রাজ্যগুলোর বাঙ্গালী মুসলমানদের বেকায়দায় ফেলতে আসামে তথাকথিত ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনস বা এনআরসি প্রণয়ন করা হয়েছে। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীনতার ৭ দশক পর ৪০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্ব তালিকার বাইরে রেখে এ অঞ্চলে একটি বড় ধরণের মানবিক সংকট ও সমস্যা তৈরী করা হচ্ছে বলে ভারতের গণতন্ত্রমনা রাজনীতিক ও মুক্তবুদ্ধির অ্যাকাডেমিসিয়ানরা মনে করছেন। বিজেপি ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে শক্তিশালী ও দিল্লীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও রাজনৈতিক সংকট ক্রমে জটিল আকার ধারণ করে চলেছে। আসামের এনআরসি তারই চুড়ান্ত বহি:প্রকাশ রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। দিল্লী ও আসামের বিজেপি সরকারের এ ধরণের ভেদবুদ্ধি সরাসরি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করছে। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরাসহ ভারতের অন্যান্য অংশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ভারতীয় নেতারা তথাকথিত অভিবাসি বাংলাভাষী মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশকে জড়িয়ে নানা ধরনের উস্কানীমূলক কথাবার্তা বলছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতা তোগাড়িয়ার বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশের ভ‚মি দখল করে সেখানে তথাকথিত অবৈধ অভিবাসিদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আসামের এনআরসি তালিকা থেকে বাদ দেয়া ৪০লাখ বাঙ্গালীকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসি বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের মধ্য দিয়েই শত শত বছরে ভারত বর্তমান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। নানা ভাষা ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক লোকাচারে বৈচিত্র্যময় ভারতের এই বাস্তবতাকে কোন একক ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিচারে মূল্যায়ণ করা বড় ধরনের আত্মাঘাতী কাজ। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা এহেন আত্মঘাতী তৎপরতাই শুধু চালাচ্ছেন না, তারা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও অনবরত উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে চলেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আসামের নাগরিকত্ব তালিকাকে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবেনা বলে দাবী করেছেন। অথচ বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিং বুধবার বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের থাকতে দেয়া হবে না। এর একদিন আগে বিজেপির সর্বভারতীয় প্রধান অমিত শাহ আসামের এনআরসি নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে তালিকা থেকে বাদ পড়া লোকদের বাংলাদেশী দাবী করে তাদের আসাম থেকে বের করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তেলেঙ্গানা বিধানসভার বিজেপির বিধায়ক টি রাজা সিং লোহ মানবিক মূল্যবোধ ও ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের গুলি করে মারতে হবে। এরা সবাই ভারতের জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আসামে বিতর্কিত নাগরিকত্বপুঞ্জি প্রকাশ এবং মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তোগাড়িয়া, অমিত শাহ, রাহুল সিংয়ের মত ব্যক্তিরা যখন অনরবরত বাংলাদেশ বিরোধি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে তখন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে যথেষ্ট প্রতিবাদি ভ‚মিকায় দেখা গেলেও বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিরবতা বিষ্ময়কর। ৪০ লক্ষাধিক ভারতীয় নাগরিককে শ্রেফ ধর্ম ও ভাষার নিরীখে নাগরিকত্ব হরণ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকির পরও বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের এই নিরবতা মেনে নেয়া যায়না। আসামের এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জটিলতা বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সংকট যথাযথ প্রক্রিয়ায় দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান করা যায়নি। এর ফলে ১০ লাখের বেশী রোহিঙ্গা শরনার্থীর বোঝা চেপেছে বাংলাদেশের উপর। একইভাবে যদি আসামের নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া বাঙ্গালী মুসলমান ও হিন্দুদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ভারতের বিজেপি নেতাদের বাংলাদেশ ও মুসলমান বিরোধী মনোভাব এবং আসামের নাগরিকত্ব জটিলতার জের অন্যান্য রাজ্যেও পড়তে শুরু করেছে। মেঘালয়ের যুগসঙ্খ পত্রিকার রিপোর্ট অবলম্বনে ঢাকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য মেঘালয়ে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমানরাও এখন জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমানদের বাংলাদেশী আখ্যায়িত করে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি অব্যাহত রেখেছে বিজেপি নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিজেপি মুসলমান বিদ্বেষী ভ‚মিকা এবং আসামের ৪০ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব বাতিলের অপপ্রয়াস ভারতকে রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন। রাজ্যসভায় আসামের এনআরসি সংক্রান্ত আলোচনায় বিজেপি ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও মোর্চাকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ এনআরসিকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। মমতা ব্যানার্জি এই তালিকাকে বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি আসামের এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকরা বাংলাদেশ থেকে যায়নি বলেও দাবী করেছেন। ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে কর্মসংস্থান ও বসবাসের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথাও সেখানকার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আসাম থেকে সৃষ্ট নাগরিকত্ব সমস্যাকে ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা সংকটের মতই একটি মানবিক সংকটের মুখোমুখি হওয়ার আগেই এ বিষয়ে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক পক্ষকে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রæতি দিলেও মূল সমস্যা সমাধানে তাদের তেমন কোন ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছে না। আসামে এনআরসি তালিকা একটি কৃত্রিম রাজনৈতিক সংকট। বিশ্ব্ মানবাধিকারের ত‚র্যবাদক হিসেবে দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও ওআইসির মত সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল ও নাগরিক সমাজের নিরবতাও দুর্ভাগ্যজনক ৪০ লাখ মুসলমানকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভারতে নাগরিকত্বহীন করে দেয়ার পরও ইসলামী সংস্থা ও মুসলমান দেশগুলোর কোন ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছে না। ভারতের বিজেপি নেতাদের মধ্যে এ সংকটে বাংলাদেশকে জড়ানোর দূরভিসন্ধিও স্পষ্ট। সরকারকে এ বিষয়ে এক্ষুনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বক্তব্য ও অবস্থান তুলে ধরতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।