হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মেহেদী হাসান পলাশ : প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ পালিত হল সাড়ম্বরে। গত কয়েক বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এ বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপনে শুরু থেকেই পুলিশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করেছিল, যার সুফলও পাওয়া গেছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এ বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে পেরেছে রাজধানীবাসী। তবে এ বছর রমনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জনসমাগম অন্যান্য বছরের তুলনায় কম ছিল। ফলে সাধারণ মানুষ স্বচ্ছন্দে ঘুরতে পেরেছে। রমনা এলাকায় লোক সমাগম কম হলেও দেশবাসীর নববর্ষ উদযাপনে কমতি ছিল না। তারা বাড়িতে বাড়িতে বা নিজস্ব আঙিনায় নববর্ষ উদযাপন করেছে। গত নববর্ষে শাহবাগ থেকে সমকামীরা রঙধনু রঙের মিছিল করে। রঙধনু রঙের ব্যাখ্যা অনেকেই বুঝতে পারেনি সেসময়। পরবর্তীকালে গণমাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত হয়। এ বছরও সমকামীরা একই চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে অন্যদের হটিয়ে দেয়। সবমিলিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ নববর্ষ উদযাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায় ডিএমপি প্রশংসা পাবার দাবীদার।
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হলেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এদিনটিকে সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। বিজু, বিসু, বৈসু, বিহু, সাংগ্রাই প্রভৃতি নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। এসব উৎসবকে তারা আবার একসাথে বৈসাবি নামে তিনদিনব্যাপী পালন করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সময় নানা নামে নববর্ষ উদযাপিত হয়। ভারতের হরিয়ানা ও পাঞ্জাব প্রদেশেও বৈশাখী’ নামে নববর্ষ উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষের আগের দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল। শিখ সম্প্রদায় বৈশাখী নতুন পোশাক পরিধান করে উৎসবে মাতোয়ারা হয়। অন্যদিকে তামিল নাড়ুর তামিল সম্প্রদায় ‘পাঠান্ডু’ বা ‘ভিরুশা পিরাপ্পু’ নামে তামিল ক্যালেন্ডারের প্রথমদিন ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন করে। তামিল হিন্দুদের বিশ্বাস, তামিল ক্যালেন্ডারের প্রথমদিনে ভগবান ব্রহ্মা সৃষ্টিজগত সৃষ্টি শুরু করেছিলেন। এপ্রিলের মধ্যভাগে আসামে ফসলী উৎসব হিসেবে বোহাগ বিহু উদযাপিত হয় নাচ ও গানের মধ্যদিয়ে। একই ১৪ এপ্রিলে ভারতের মালয়ালম ক্যালেন্ডারের ‘মেদাম’ মাসের প্রথম দিন ‘ভিসু’ উৎসব পালিত হয়। এ উৎসব মূলত পূজানির্ভর। ভারতীয় রাজ্য মণিপুরেও ১৪ এপ্রিল, কখনো ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপিত হয়। এর নাম ‘রঙ্গালি বিহু’। রঙের খেলা এবং নাচ-গানের এই নববর্ষ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়।
বিগত কয়েক বছরের মতো এবছরও কিছু ব্যক্তি বাংলা নববর্ষকে বিজাতীয় ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে বয়কট করার জন্য মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর প্রভাবে এ বছরও সামাজিক গণমাধ্যমে বিজাতীয় সংস্কৃতি, বিদায়াতি সংস্কৃতি, হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বয়কট করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি নববর্ষ হারাম? বিদায়াত? বিজাতীয়? হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি?
বাংলা নববর্ষ চালু হয়েছে মোঘল সম্রাট আকবরের সময়। যেহেতু মুসলিম শাসনামলে চালু তাই এ কথা বলা যায় যে, বাংলা নববর্ষের প্রচলন করেছে মুসলিম শাসকগণ।
বিদায়াতের দুই প্রকার সংজ্ঞা রয়েছে। কারো মতে, কুরআন ও হাদীসে যা হালাল বলা হয়েছে এর বাইরে যা কিছু আছে সব বিদায়াত। এই মত যারা প্রচার করেন তারা নিজেরাও এ মত বেশিরভাগ সময় পালন করতে পারেন না। অন্যপক্ষের মতে, কুরআন ও হাদীসে যা কিছু হারাম বলা হয়েছে তার বাইরে যা আছে সব বৈধ, ইসলামি পরিভাষায় ‘মোবাহ’। বেশিরভাগই দ্বিতীয় পক্ষে।
আমরা জানি, আমাদের মদ খাওয়া, মৃত প্রাণীর গোস্ত খাওয়া হারাম। কিন্তু কেউ যদি জীবন রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে খায়, সেটা জায়েজ। মুরগী, গরু, ছাগলের গোস্ত হালাল। কিন্তু আল্লাহর নামে জবাই না করা হলে তা হারাম। অর্থাৎ হারাম ও হালাল বিচারের ক্ষেত্রে কারণ ও পন্থা বা পদ্ধতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নববর্ষ হারাম না হালাল তা নির্ধারিত হবে নববর্ষ কিভাবে উদযাপন করা হচ্ছে তার বিচারের উপর। যেমন, যে কাজ ৩৬৪ দিন হারাম, তা নববর্ষে করাও হারাম। যে কাজ অন্য যেকোনো সময় করা হালাল, তা নববর্ষে করাও হালাল। প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ আঙ্গিকে নববর্ষ উদযাপন করে। নববর্ষ উদযাপনে পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। এটা কি হারাম? (অবশ্য ক্রোড়পত্রে হারাম কোনো অনুষঙ্গ থাকলে তা এমনিতেই হারাম)। বিভিন্ন কোম্পানি নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ মূল্য ছাড় দেয়। এটা কি হারাম? আবার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নববর্ষ উপলক্ষে যদি ককটেল বা ডিজে পার্টি দেয় তা কি বছরের বাকি দিনগুলোতে হালাল? নববর্ষ উপলক্ষে রমনার বটমূলে দেবদেবীর প্রশস্তিমূলক মাঙ্গলিক গান, বেদ-পুরাণের চরিত্রের অনুকরণে মুখোশ ও সাজসজ্জা পরিধান, উল্কি আঁকা, রমনা এলাকায় নারী-পুরুষের প্রচ- ভিড়ে অবাধ মেলামেশা কি মুসলমানদের জন্য বছরের বাকি ৩৬৪ দিন জায়েজ?
বিজাতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞা নির্ধারণের আগে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংজ্ঞা স্মরণ করা জরুরি। বাংলাদেশে প্রায় ১০ ভাগ অমুসলিম বাস করে যাদের অধিকাংশ হিন্দু। তারাও বাংলাদেশী জাতির অভিন্ন অংশ। বাংলাদেশে বসবাসকারী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। কোনো হিন্দু যদি নববর্ষে দেবদেবীর প্রশস্তিমূলক মাঙ্গলিক গান বা শ্যামা সঙ্গীত গায়, বেদ পুরাণের চরিত্রের অনুকরণে মুখোশ ও সাজসজ্জা পরিধান করে এটাকে কি বিজাতীয় সংস্কৃতি বলা যাবে? পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বাসিন্দারা নববর্ষ উদযাপনে স্থানীয়ভাবে তৈরি মদ (বাংলা মদ) পান করে থাকে। নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করে যা তাদের সংস্কৃতির অংশ। এটাকে কি বিজাতীয় বলা যায়? হোলি খেলা, চৈত্র সংক্রান্তি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব। এটাও বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশী মুসলমানদের সংস্কৃতি নয়। কুরবানী যেমন হিন্দুদের সংস্কৃতি নয়, তেমনি বলি মুসলিমদের সংস্কৃতি নয়। কিন্তু দুটোই আবার একসাথে বাংলাদেশী সংস্কৃতি। প্রশ্ন হচ্ছে মুসলিমরা কেন এটা করবে? এসব তো তাদের জন্য অন্য যেকোনো সময়ই হারাম। তাহলে নববর্ষকে কেন দোষ দেয়া হবে? হিন্দুরা যদি নববর্ষে মাঙ্গলিক বা শ্যামা সঙ্গীত গায়, মুসলিমরা যদি নববর্ষে ইসলাম সম্মত পন্থায় ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করে তা অবৈধ হবে কেন? কিম্বা এমন কোনো সঙ্গীত পরিবেশন করে অথবা এমন কোনো পন্থায় নববর্ষ উদযাপন করে যা ইসলাম সিদ্ধ, তাহলে নববর্ষ উদযাপন হারাম কেন হবে?
আসলে বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতি কি হবে হাজার বছর ধরে এদেশের আলেম সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা নির্ধারণ করেননি। শুধু না জায়েজ, হারাম বলে প্রচার করেছেন, ফতোয়া দিয়েছেন। আর এই সুযোগে একটি গ্রুপ আরব সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলে বাঙালী মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরব সংস্কৃতি ও ইসলামি সংস্কৃতি এক নয়। আরবরা আবহাওয়া ও ভূ-প্রাকৃতিক কারণে উটে চড়ে, রুমাল ও জোব্বা পরিধান করে, মশকে (চামড়ার পাত্রে) পানি খায়। তাই বলে এগুলো ইসলামিক সংস্কৃতির অংশ নয়।
যারা বাংলা নববর্ষ পালনকে না জাযেজ মনে করেন তাদের অনেকে আবার হালাল মনে করে ১ মহররমকে হিজরী নববর্ষ হিসাবে পালন করে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম হিজরী নববর্ষ এখন বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেইতে অত্যন্ত সাড়ম্বরে হিজরী নববর্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে। এসব দেশে নববর্ষ উদযাপনে স্থানীয় সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া, আফ্রিকান মুসলিম দেশসমূহ, পাকিস্তান, ভারত এমনকি বাংলাদেশেও হিজরী নববর্ষ পালিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনসমূহ, ইসলামী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হিজরী নববর্ষ উপলক্ষে আকর্ষণীয় র্যালি বের করে। ডিজিটাল যুগে আবার ১ মহররমে তরুণ-তরুণীরা ফেসবুকের কভার, প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে, সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, হিজরী নববর্ষের সাথে ইসলামের সম্পর্ক কী? কুরআন হাদীসে কি হিজরী নববর্ষের কথা বলা হয়েছে? হিজরী সন তো শুরু হয়েছে রাসূলের (সা.) ওফাতের অনেক বছর পর হযরত ওমর (রা.) শাসনামলে, ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরীর (রা.) প্রস্তাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে। হযরত ওমর (রা.) এটা উদযাপন করেননি। কিন্তু এখন আরবরা হিজরী নববর্ষ সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। হিজরী নববর্ষ হালাল হলে বাংলা নববর্ষ হারাম হবে কেন?
শুধু ইসলাম নয়। অন্যান্য ধর্মেও নববর্ষ রয়েছে। পাশ্চাত্যে যে ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ চালু রয়েছে এর সাথে খ্রিস্টান ধর্মের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। জানুয়ারি মাস ইংরেজি নববর্ষের সূচনা করলেও অতীতে পাশ্চাত্যে নববর্ষ হিসেবে মার্চ মাস প্রাধান্য পেয়েছিল। খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে বসন্তের অবির্ভাব ও শস্য রোপণের সময়কেই নববর্ষ বলে সূচিত হতো। ১১ দিন ধরে এই উৎসব পালিত হতো। সম্রাট জুলিয়াস সিজার জানুয়ারির প্রথম দিনকে উৎসবের দিন বলে ঘোষণা দেন। খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করলে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনকে বছরের প্রারম্ভের দিন বলে গণ্য করত। কিন্তু বিজয়ী যোদ্ধা উইলিয়াম যখন ১০৬৬ সালে ২৫ ডিসেম্বর রাজা হলেন, তখন তিনি যিশুখ্রিস্টের খতনা দেয়ার দিনকে বছর শুরুর দিন হিসেবে জানুয়ারির ১ তারিখকে মনোনীত করেন। কিন্তু বিশ্বজুড়ে খ্রিস্টানরা উইলিয়ামের এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করলে ২৫ ডিসেম্বরকেই নতুন বছরের শুরুর দিন হিসেবে চিহ্নিত করে। পোপ গ্রেগরি অষ্টমের আমলে (১৫০২-১৫৮৫) নতুন বছর হিসেবে জুলিয়াস সিজারের নির্ধারিত ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। উইলিয়ামের মৃত্যুর ৫০০ বছর পরে পোপ গ্রেগরি অষ্টমের সময় প্রাচীন সৌর ক্যালেন্ডার (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার) সংশোধন করে নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়। এই ক্যালেন্ডারের নাম রাখা হয় গ্রেগরি ক্যালেন্ডার। গ্রেগরি ১৫৭৭ সালে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনকেই বর্ষবরণের দিন হিসেবে নির্ধারিত করেন। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে এই ক্যালেন্ডার চালু রয়েছে। হিন্দুদেরও নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে। হিন্দুদের নববর্ষ শুরু হয় ২৪ অক্টোবর। প্রায় একই সময় হিন্দুরা দিওয়ালী উৎসব পালন করে থাকে। মধ্যভারতের উজ্জয়নীতে প্রাচীন ভারতীয় সম্রাট বিক্রমাদিত্য খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সালে চান্দ্র ও সৌর নক্ষত্রিক বছর হিসাব করে এ সালের প্রচলন করেন। এটি ‘বিক্রম সম্বুত’ নামে বহুল প্রচলিত। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে এটি ৫৬.৭ বছর পেছনে। সে হিসাবে এখন ২০৭২ বিক্রম সম্বুত। ইহুদিদের নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে যাকে তারা ‘রোশ হাসানাহ’ হিসাবে উদযাপন করে। ইহুদী মতে, আল্লাহ এদিন আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। ‘অন্য মান্দি’ নামের ইহুদিদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার ৫৭৭৬ বছর আগে ব্যবিলনীয় সভ্যতার প্রভাব থেকে শুরু হয়। গৌতমবুদ্ধের মৃত্যুর বছর খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ সালের ১১ মার্চ থেকে বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার গণনা করা হয়। সেসময় থেকে বৌদ্ধযুগ গণনা করা হয়। সে হিসাবে এটি ২৫৫৯ বৌদ্ধ সাল। থাইল্যান্ডে নববর্ষের নাম ‘সংক্রান’। এই উৎসব এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত বৌদ্ধ নববর্ষ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। ১৮৮৮ সালে রাজা চুলালংকরন এই প্রথা চালু করেন। জরাথ্রুস্তের সময় থেকে পালিত নওরোজ উৎসব ইসলামিক রিপাবলিক অভ ইরানেও অত্যন্ত সাড়ম্বরে পালিত হয়। অবশ্য পালনের ধরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এ থেকে অগ্নি উপাসনা ও পৌত্তলিকতার অনুষঙ্গগুলো বাদ দেয়া হয়েছে।
আমরা বাঙালী মুসলমানেরা অপসংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে শুধু চিৎকার করেছি, কিন্তু সংস্কৃতি কি তা নির্ধারণ করিনি। ফলে আমাদের তরুণরা না বুঝে, না জেনে, অসতর্ক ও অসচেতনভাবে অপসংস্কৃতির খপ্পরে পড়েছে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, বক্তৃতা করে, ফতোয়া দিয়ে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু সংস্কৃতির জোরালো চর্চাই কেবল পারে অপসংস্কৃতির কবল থেকে তরুণ সমাজকে দূরে রাখতে। যেমন, রমনার অশ্বত্থমূলে ছায়ানট অনুষ্ঠান করে। কোনো সংগঠন যদি উল্টোদিকে শতায়ু অঙ্গনে লাঠি খেলা, কুস্তি, ঘুড়ি ওড়ানো প্রভৃতি খেলার মতো অনুষ্ঠান পরিচালনা করে, ছায়ানটের গান শোনার জন্য কতোজন থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তবে এ কথা সত্য যে, একটি দেশের জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণে সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম, অভ্যাস, উৎসব, আচার ও সংস্কৃতির প্রাধান্য লাভ করে। বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগেরও বেশি মানুষ মুসলিম। কাজেই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণে ইসলামী বিশ্বাস, মূল্যবোধ, উৎসব ও সংস্কৃতি প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যুগযুগ ধরে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির নামে, প্রগতিশীল সংস্কৃতির নামে বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতিতে পৌরাণিক ও পৌত্তলিক সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার, অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা চলেছে এবং এ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংঘাত, অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব। মুসলিম দেশে অমুসলিমদের নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্বিঘেœ পালনের সর্বোচ্চ নিশ্চিয়তা ইসলাম নিজেই নিশ্চিত করেছে।
রমনার অশ্বত্থমূল কেন্দ্রীক বাংলা নববর্ষ উদযাপনের শুরু বিগত শতাব্দির ষাটের দশকে। একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছায়ানট এই উৎসবের প্রচলন করে। নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা আশির দশকে এবং পান্তা-ইলিশ আরো পরের সংযুক্তি। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের পর যুক্ত হয়েছিল ভুভুজেলা। মিডিয়ার কল্যাণে রিও ডি জেনিরোর সাম্বা উৎসব থেকে গত কয়েক বছরে এতে যুক্ত হয়েছে মেয়েদের মাথায় ফুলের রিং। চারুকলার ছাত্ররা এক দশকের মতো হবে নববর্ষে মুখে-বুকে উল্কি আঁকা প্রচলন করেছে। এ বছর পুলিশ ভুভুজেলা নিষিদ্ধ করেছে। পান্তা-ইলিশ বিরোধী যে মনোভাব এ বছর তৈরি হয়েছে তাতে হয়তো অচিরেই এ প্রচলনটিও টিকবে না। গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়েই বহতা নদীর মতো সংস্কৃতি এগিয়ে যায়। মুসলমানদের জন্য উল্কি আঁকা, চন্দন তিলক, সিঁদুর পরা নিষিদ্ধ বলে অমুসলিমদের জন্যও তা নিষিদ্ধ নয়। বহু জাতির দেশ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে যত্রতত্র মদের দোকান থাকলেও মুসলমানদের সেখানে গমন বৈধ নয়। মুসলিমদের সেখানে দেখলে পুলিশ আটক করে।
জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ইয়ুথ ইজ ফুল অভ জয়, ফুল অভ প্লেজার। তারুণ্য মানেই উৎসব। ইসলাম ধর্ম উৎসবমুখর ধর্ম। হিন্দুদের বারো মাসে তের পার্বন বা উৎসব। কিন্তু মুসলমানদের প্রতি সপ্তাহেই ঈদ বা উৎসব। অর্থাৎ বছরে ৫২টি ঈদ (বড় ঈদ বা উৎসবগুলোর কথা বাদই দিলাম)। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এই সাপ্তাহিক ঈদ উদযাপনের কোনো পন্থা ও সংস্কৃতি চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরানে শুক্রবারগুলো অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। পহেলা বৈশাখে আমরা অনেক হেজাবধারী মেয়েকে দেখি রমনার ভিড়ে সপরিবারে বেড়াতে। ইসলাম সিদ্ধ পন্থায় নববর্ষ উদযাপনের প্রচলন থাকলে তারা অপসংস্কৃতির ভিড়ে আসতেন বলে মনে হয় না। কাজেই মুসলিম তরুণ সমাজকে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সুষ্ঠু সংস্কৃতি ও নির্মল বিনোদনের রূপরেখা তৈরি করে তার জোরালো চর্চা করতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায় কিভাবে ইসলাম সম্মতভাবে নববর্ষ উদযাপন করবে তার রূপরেখা মুসলিম ধর্মীয় স্কলার ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বের করতে হবে। যুগের চাহিদা পূরণের উপযোগী নববর্ষের আনন্দ, বিনোদন ও উৎসব উপভোগের ইসলাম সিদ্ধ পন্থা বের করা গেলে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের সহজেই অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
email:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।