Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আসামে নাগরিকত্ব তালিকা প্রসঙ্গে

| প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকত্বের তালিকা তৈরী করতে গিয়ে ৪০ লাখের বেশী মানুষকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। তালিকার বাইরে থাকাদের মধ্যে বেশীর ভাগই বাংলাভাষি মুসলমান ও হিন্দু বলে জানা গেছে। আসামে হিন্দুত্ববাদি বিজেপি’র রাজনৈতিক সমর্থনবৃদ্ধি ও ২০১৬ সালে সরকার গঠনের পরই সেখানে আসামী-বাঙ্গালী বিরোধ উস্কে দেয়ার পাশাপাশি বাংলাভাষি মুসলমানদের বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে পুশইন করার দুরভিসন্ধি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আসামে ৪০ লক্ষাধিক মানুষকে নাগরিকত্বের তালিকার বাইরে রেখে উদ্বাস্তু ও নিজদেশে পরবাসি করে ফেলার অমানবিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশসহ ভারতের বাইরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। গত সোমবার আসামে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন ফর সিটিজেনশিপ)-এর চুড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিককে এ তালিকার বাইরে রাখার প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হিসেবে উঠে এসেছে। তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বিজেপি সরকারের এ ধরনের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেও সবচে বেশী ক্ষতির আশঙ্কায় থাকার পরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে দিল্লীর তরফ থেকে ঢাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি বলেই ঢাকা কোন প্রতিক্রিয়া দেয়নি বলে প্রকাশিত একটি খবরে জানা গেছে। তবে পররাষ্ট্রনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে বৈঠক, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে।
মোঘল ও বৃটিশ শাসনামলে একই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় থাকা বাংলাদেশ, আসাম ও পশ্চিম বঙ্গের সাংস্কৃতিক ও ডেমোগ্রাফিক মেলবন্ধন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালী-অসমীয়া ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষাভাষি মানুষের সমন্বয়ে শত শত বছরে গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ভারতীয় সাংস্কৃতির বৈচিত্র্যের অন্যতম অংশ। ভারতের প্রতিটি অংশেই ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির এমন বিভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মাল্টিকালচারালিজমের অভিযোজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং শান্তি ও সহাবস্থানের পথ কাজে লাগিয়েই যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সংহত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। একদেশদর্শী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারনে শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ ও সম্ভাবনা বিনষ্ট হতে পারে। চল্লিশ লক্ষাধিক মানুষকে নাগরিকত্ব তালিকার বাইরে রেখে আসামের বিজেপি সরকার আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল অবস্থা তৈরী করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের সংকট আসাম ও দিল্লীর ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক- সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতা থেকে সৃষ্ট। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, আসামের জনসংখ্যা ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯জনের মধ্যে চুড়ান্ত খসড়া তালিকা থেকে ৪০লাখ মানুষকে তালিকার বাইরে রাখা হলেও বাদ পড়াদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে মূল তালিকায়ও বহু মানুষের নাম বাদ দেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। আগস্টের ৭ তারিখ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আসামের নাগরিকত্ব তালিকায় বাদ পড়া নাগরিকরা আবেদন করতে পারবেন বলে জানা যায়। ছয় দশকের বেশী সময় পরে প্রস্তুতকৃত গণশুমারির নাগরিক তালিকা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাভাষি হিন্দু-মুসলমানদের বাদ দেয়ার এই হীন প্রয়াসের নিন্দা জানাই। এ ধরনের তৎপরতা মানবতা, সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে অভিন্ন মানচিত্রের অংশ। একইভাবে আরাকানের মুসলমানরাও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। রোহিঙ্গারা যেমন শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাস করে সেখানকার আদিবাসি হিসেবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে ঠিক একইভাবে অসমীয়দের বাইরে আসামের বাংলা ভাষাভাষি মুসলমান ও হিন্দুরাও সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠার সব ধরনের যোগ্যতা ও মানদন্ড অর্জন করেছে। যে সব ভারতীয় রাজনীতিক ভারতে মুসলমানদের অবস্থানকে কটাক্ষ করছেন, যারা আসামের বাংলা ভাষি মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন তারা রোহিঙ্গা সংকটের মত উপমহাদেশে আরেকটি সংকটের জন্ম দিতে চাইছেন। স্মর্তব্য যে, পাঁচশ বছরের বেশী সময় ধরে আরাকানে বসবাস করা সত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হয়েছিল বৃটিশ আমলের একটি আদমশুমারির তালিকা থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাম বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধদের সমর্থন পেতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বৃটিশদের মুসলিম বিদ্বেষী নীতিকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব তালিকার বাইরে রাখার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমান পরিনতি লাভ করেছে। ভারতের বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে এখন আসামে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত জটিলতা সৃষ্টি হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়,মিজোরামসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লাখ লাখ বাংলাভাষি হিন্দু-মুসলমানের বসবাস। এখন নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকদের বাংলাদেশি বলে দাবী করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তা বাংলাদেশে বড় ধরনের ডেমোগ্রাফিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এ ধরনের যে কোন চেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে এখনই শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আসামের কট্টর অসমীয় এবং হিন্দুত্ববাদিরা যেন এনআরসি তালিকা ধরে বাংলাদেশে পুশইন করতে না পারে সে বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নাগরিকত্ব

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন