পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রসূলুল্লাহ (সা.) একবার বলেছিলেন, ‘আনা ইবনুযযাবীহাইন’। অর্থাৎ আমি দুই জবাইকৃতের সন্তান। তিনি ইতিহাসের দুই বিখ্যাত কোরবানীর ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে এ উক্তি করেছিলেন। সীরাত ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে এ উক্তি এবং হুজুর (সা.) এর দাদা মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেবের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। লুপ্ত যমযম প্রাপ্তিতে স্বাপ্নিক ইশারা এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেবের প্রাণপ্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহকে লটারির মাধ্যমে কোরবানী দেওয়ার উদ্যোগ ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা, যা নি¤œরূপ:
হজরত ইসমাঈল (আ.) এর স্মৃতি বিজড়িত যমযম ক‚প, এটি ‘এসাফ’ ও ‘নায়েলা’ নামক দুটি প্রতিমার মাঝে কোরেশদের কোরবানগাহে অবস্থিত। বনি জুরহুম পলায়নকালে ক‚পটি বন্ধ করে দিয়ে যায়। কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর ক‚পটি লুপ্ত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় এর অবস্থান ছিল, তার কোন চিহ্নও থাকে না। আব্দুল মোত্তালেব কাবার তত্ত¡াবধায়ন কালে স্বপ্নযোগে লুপ্ত যমযম ক‚প খনন করার সঠিক স্থান সম্পর্কে ইশারা পান। সে সময় আব্দুল মোত্তালেবের শুধু একজন পুত্র সন্তান ছিল, নাম ছিল হারেস। পুত্রকে নিয়ে তিনি খনন কার্য আরম্ভ করেন। ক‚পের উপরিভাগ দৃষ্টিগোচর হলে তিনি অতিশয় আনন্দে তকবীর বলে উঠেন। কোরেশরা এই অবস্থা অবলোকন করে বলতে থাকে, ‘এটি আমাদের পিতা ইসমাঈল (আ.) এর ক‚প, এর খনন কাজে আমাদেরকেও অংশীদার করতে হবে।’ আব্দুল মোত্তালেব বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং তোমাদের মধ্যে বিশেষভাবে আমাকেই এটি প্রদান করা হয়েছে; সুতরাং তোমাদের আমি এই কাজে অংশীদার করতে পারি না।’ ফলে খনন কাজকে কেন্দ্র করে কোরেশ ও আব্দুল মোত্তালেবের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
বর্ণিত আছে যে, আব্দুল মোত্তালেব যখন পুত্র হারেসকে নিয়ে (স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে) ক‚প খনন করতে যান, তখন কোরেশদের বিরোধিতার দরুণ খনন করতে পারলেন না, এ জন্যে তিনি মানত করেন যে, আল্লাহ যদি আমাকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন এবং তাদেরকে আমি যুবক রূপে দেখতে পাই, তবে তাদের একজনকে কাবা শরীফের কাছে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করব। আল্লাহ তাঁকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন।
আব্দুল মোত্তালেব খনন কাজে কোরেশ দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হন। তিনি এ ব্যাপারে কোরেশদের সাথে বিতর্ক না বাড়িয়ে কোরা বা লটারি করার প্রস্তাব দেন। লটারিতে আব্দুল মোত্তালেবের নাম আসে। যমযম কূপ খনন কার্য সম্পন্ন করার পর একদিন আব্দুল মোত্তালেব কাবা শরীফের কাছে নিদ্রাবস্থায় ছিলেন। এ সময় তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, কেউ তাকে বলছে যে, হে আব্দুল মোত্তালেব, ‘রাব্বুল বায়ত’ অর্থাৎ কাবার প্রতিপালকের কাছে যে মানত করেছ, তা পূরণ কর। নিদ্রাভঙ্গের পর তিনি একটি দুম্বা কোরবানী করে মিসকিনদের খাওয়ান। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নিদ্রা অবস্থায় একই স্বপ্ন দেখেন, হে আব্দুল মোত্তালেব, তা অপেক্ষা বড় বস্তু দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ কর, জাগ্রত হয়ে তিনি একটি গরু কোরবানী করেন এবং দরিদ্র মিসকিনদের খাওয়ান। অতঃপর তৃতীয়বারের স্বপ্নে দেখেন, হে আব্দুল মোত্তালেব, তুমি এটা অপেক্ষা উত্তম বস্তু দ্বারা নৈকট্য লাভ কর। জাগ্রত হয়ে তিনি একটি উট কোরবানী করে ফকির মিসকিনদের খাওয়ান। আবার যখন তিনি সেখানে নিদ্রা যান তখন স্বপ্নে দেখেন, হে আব্দুল মোত্তালেব, তুমি আরও উত্তম বস্তু দ্বারা নৈকট্য লাভ কর। তখন আব্দুল মোত্তালেব জিজ্ঞাসা করেন, এর চেয়ে উত্তম বস্তু আর কি হতে পারে? জবাব আসে, তুমি পুত্র কোরবানী করার জন্য যে মানত করেছিলে তা পূরণ কর। আব্দুল মোত্তালেব বিচলিত হয়ে জাগ্রত হন এবং তাঁর পুত্রদের একত্রিত করে স্বপ্নের কথা জানান। সব ছেলে সন্তুষ্ট চিত্তে জবাব দেয়। সম্মানিত পিতা, আপনি আমাদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছা কোরবানী করুন, আমরা রাজি। যখন লটারি নিক্ষেপ করা হয় তখন সবচেয়ে প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর নাম আসে। আব্দুল মোত্তালেব ছোরা সহকারে আব্দুল্লাহকে নিয়ে খানাই কাবার কাছে আসেন, যেখানে এসাফ ও নায়েলার প্রতিমা রাখা ছিল। আব্দুল মোত্তালেব পুত্র আব্দুল্লাহকে নিয়ে কোরবান গাহে পৌঁছলে কোরেশরা জিজ্ঞাসা করে, আপনি কী করছেন? তিনি আব্দুল্লাহকে কোরবানী করবেন বলে জানালে কোরেশরা নিষেধ করতে থাকে এবং বলে যে, আপনি যদি স্বীয় পুত্রকে কোরবানী করেন তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি তার পুত্রকে এখানে এনে কোরবানী করবে এবং এটি একটি প্রথা হিসেবে চালু হয়ে যাবে। আপনি কোন পুরোহিতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, অবশ্যই কোন উপায় বের হয়ে আসবে। এরপর আব্দুল মোত্তালেব খায়বারে কাতবা না¤œী এক মহিলা পুরোহিতের কাছে যান এবং ঘটনা বর্ণনা করেন। মহিলা জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা একজন লোকের রক্তের বিনিময়ে কত আদায় করেন? জবাবে তিনি বলেন দশটি উট। মহিলা বললেন, আপনি নিজের দেশে গিয়ে দশটি উটের নামে একটি লটারি নিক্ষেপ করুন এবং আব্দুল্লাহর নামে একটি, যদি লটারিতে আব্দুল্লাহর নাম আসে তহলে আরও দশটি উটের নামে লটারি বাড়িয়ে দেবেন। এই নিয়মে উটের নাম না আসা পর্যন্ত দশটি করে উটের নাম বৃদ্ধি করতে থাকুন। আব্দুল মোত্তালেব প্রত্যাবর্তন করে লটারি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং আল্লাহর কাছে এই মর্মে ফরিয়াদ করতে থাকেন, হে আল্লাহ! আমি এদের মধ্যে একজনের কোরবানী মানত করেছিলাম, এখন তাদের প্রতি লটারি নিক্ষেপ করছি। তুমি যাকে ইচ্ছা তার নাম বের করে দাও।
অপর একটি বর্ণনা হতে জানা যায়, লটারিতে প্রথম যখন আব্দুল্লাহর নাম নির্দেশিত হয় তখন আব্দুল মোত্তালেব দেবতার বিরাগভাজন হতে সাহসী হলেন না এবং আব্দুল্লাহকে কোরবানী করতে উদ্যত হলেন। ইত্যবসরে আব্দুল্লার কনিষ্ঠা বোন ওমায়মা এই নিদারুণ সংবাদ শুনে অশ্রæ প্লাবিত হয়ে পিতার নিকট উপস্থিত হলেন এবং এই ভীষণ কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন। আব্দুল মোত্তালেব তাঁর কাতর ক্রন্দন সহ্য করতে না পেরে পুত্রের পরিবর্তে দশটি উট কোরবানী দেওয়ার জন্য পুরোহিতকে পুনরায় লটারি নিক্ষেপ করতে বলেন এবং লটারি আব্দুল্লাহর নাম নির্দেশ করতে থাকে। অবশেষে একশ উটের সময় আব্দুল্লাহর স্থলে উটের নামে লটারি উঠে। আব্দুল মোত্তালেব একশ উট কোরবানী করে প্রাণপ্রতিম পুত্রের প্রাণ রক্ষা করেন।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পূর্ব পুরুষ হজরত ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর পিতা আব্দুল্লাহকে জবাই করার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনার উপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘আনা ইবনুয যাবীহাইন’। অর্থাৎ আমি জবাই করার জন্য উৎসর্গকৃত দুই ব্যক্তির সন্তান। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পিতা হজরত আব্দুল্লাহর প্রাণরক্ষা পাওয়ায় সাধারণভাবে কোরেশদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে আব্দুল মোত্তালেব পরিবারে আনন্দ-উল্লাসের যে ঢেউ খেলছিল তা বর্ণনাতীত। কেননা কোরেশদেরও আশঙ্কা ছিল যে, আব্দুল্লাহ রক্ষা না পেলে, ভবিষ্যতে তাদেরকেও পরিবার প্রতি একটি করে সন্তান কোরবানী করতে হবে এবং আরবে পুত্র কোরবানীর রীতি-সংস্কৃতি চালু হয়ে যাবে। কোরেশদের এ আশঙ্কা ও ভীতি অমূলক ছিল না। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে এই আশঙ্কা মুক্ত করেন এবং গোটা মানব জাতির কল্যাণ সাধন করেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন তারই সন্তান বিশ^নবী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।