হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গত শনিবার ফুটবল বিশ্বকাপ বাংলাদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের লাগাম ছাড়া মাতামাতির ওপর আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। স্ট্যাটাস দেওয়ার পর একটি আশঙ্কা ছিল যে, বিশ^কাপ ফুটবল নিয়ে যে ক্রেজ বা উন্মাদনা শুরু হয়েছে তার পটভূমিতে আমার স্ট্যাটাস দেখে বিশ^কাপপ্রেমীরা আমাকে গালাগালি করে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন। কিন্তু না, দেখলাম এদেশে এখনো কোটি কোটি সেনসিবল্ মানুষ রয়েছেন। আমি দেখে আনন্দিত হলাম যে, তারা বরং এই ক্রেজের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আমি প্রথমে সংক্ষেপে আমার স্ট্যাটাসটি নিচে তুলে ধরছি। তারপর দু চারটি কমেন্ট দেব। আমার স্ট্যাটাস ছিল নি¤œরূপ:
আমি সাধারণত খেলা নিয়ে লিখি না। কিন্তু আমি ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলা নিয়মিত দেখি। ২০১৫ সালে আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তখন সেখানে ক্রিকেটের বিশ^কাপ খেলা চলছিল। যেহেতু ঐ সময় আমি অস্ট্রেলিয়াতে ছিলাম তাই আমার বিশ^কাপের দুই চারটি ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এবার ২০১৮ সালের মস্কো বিশ^কাপের রাত ৮টা এবং ১২টার খেলা নিয়মিত এবং প্রতিদিন দেখেছি। দেশবাসীও দেখেছেন। কিন্তু এই খেলা নিয়ে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখেছি সেটি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি তো নাকি তাদের জমি জমা বিক্রি করে কয়েক কিলোমিটারের জার্মান পতাকা বানিয়েছিলেন। আর এক ব্যক্তি তার বহুতল ভবনটিকে ব্রাজিলের জার্সি এবং পতাকার রঙ্গে রাঙিয়েছেন। এটি সিম্পলি একটি ক্রেজ। কয়েকটি সরকারি, আধাসরকারি এবং বেসরকারি অফিসে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে ব্যাংকও ছিল। দেখলাম প্রায় সর্বত্র দুইটি দেশের বিশাল পতাকা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। একটি ব্রাজিল, আর একটি আর্জেন্টিনা। একটি অফিসে আমি একটু উষ্মা প্রকাশ করেই বলেছিলাম, আপনারা যতই উন্মাদনা দেখান না কেন, এই দুই পতাকার একটি দেশও সেমি ফাইনালে যেতে পারবে না। এখন পাঠক ভাইয়েরা দেখুন, আর্জেন্টিনা তো কোয়ার্টার ফাইনালেও যেতে পারেনি। ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালেই আউট। ৪ বারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিও কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারেনি।
১৯৩০ সাল থেকে ফুটবল বিশ^কাপ শুরু হয়েছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০টি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালে যেটা হচ্ছে সেটি ২১ নম্বর টুর্নামেন্ট। এই ২০টি টুর্নামেন্টে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৫ বার। জার্মানি হয়েছে ৪ বার। আর্জেন্টিনা নিয়ে বাংলাদেশে প্রচন্ড উন্মাদনা রয়েছে। অথচ আর্জেন্টিনা শিরোপা পেয়েছে মাত্র ২ বার। এমনকি ইটালিও আর্জেন্টিনার মাথার ওপর আছে। ইটালি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৪ বার। উরুগুয়ে হয়েছে ২ বার। ফ্রান্স, স্পেন এবং ইংল্যান্ড প্রত্যেকে হয়েছে একবার করে।
টাইম লাইনে এক বন্ধু লিখেছেন, হারলেও ব্রাজিল, জিতলেও ব্রাজিল। কেন এই যুক্তিহীন উন্মাদনা? নরনারীর প্রেমে যেমন থাকে ওহভধঃঁধঃরড়হ বা মোহ, ফুটবলেও দেখছি তেমনি রয়েছে মোহ। আমি খেলা দেখি নিরাবেগ মন নিয়ে। ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনার খেলা দেখেছি ৫৫ ইঞ্চি টেলিভিশনে। দর্শক ছিলেন ২২ জন। খেলার ৭ মিনিটের মাথায় আমি বলেছিলাম আর্জেন্টিনা হারবে। বাকি ১৯ জন আমার কথাকে পাত্তাই দেয়নি। অবশ্য এরা সকলেই ছিল আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। খেলা শেষে আর্জেন্টিনা যখন নকড-আউট হলো তখন ওরা সকলেই আমায় ছেঁকে ধরেছিল, আপনি কীভাবে বুঝেছিলেন যে আর্জেন্টিনা হারবে? আমার উত্তর ছিল, যে মেসির জন্য তোমরা পাগল সেই মেসিযাদু শেষ। গত রাত্রে যখন বেলজিয়াম এবং ব্রাজিলের খেলা দেখছিলাম তখন আমার সঙ্গে ছিলেন আমার সহধর্মীনি। খেলার ১০ মিনিটের মাথায় তিনি বললেন, আজ ব্রাজিল হারবে। আমি বললাম, কীভাবে তুমি বুঝলে? তিনি বললেন, যে নেইমারকে নিয়ে এত মাতামাতি সেই নেইমার তো আউটস্ট্যান্ডিং কিছুই দেখাতে পারছেন না। হলোও তাই । নেইমারযাদু শেষ। ব্রাজিল এক গোলে হেরে গেলো এবং টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিল।
আমার পোস্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, জাতি হিসাবে অনেক বিষয়েই আমরা হুজুগে চলি। আমরা যেন আর হুজুগে না চলি। অনেকে বলেন, হুজুগে বাঙ্গালি। আমি সেটা বলি না। দেখুন, বাংলাদেশ যখন ক্রিকেটে ভালো খেলে তখন ক্রিকেটারদের ফুলাতে ফুলাতে এমন জায়গায় আমরা নিয়ে যাই যেখানে তারা বার্স্ট করে। ওপরে তুলতে তুলতে আমরা শুধু মাথায় তুলি না, একেবারে আসমানে তুলি। অথচ সেই বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সেদিন তো হোয়াইট ওয়াশডও হয়ে গেল। আর এই তো সেদিন ৪৩ রানে অল আউট।
সুতরাং আমরা যেন সব কিছুতেই পরিমিতির মধ্যে থাকি। আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও যেন সীমা ছাড়িয়ে না যাই।
দুই
এই স্ট্যাটাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর যে আশঙ্কাটি করেছিলাম সেটি আর ঘটলো না। লাইক বা শেয়ার করার কথা বাদই দিলাম। কয়েক জন বন্ধু যে কমেন্ট করেছেন তার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করছি। পড়লে বুঝবেন যে বাংলাদেশ থেকে মানুষের পরিমিতবোধ এবং মাত্রাজ্ঞান এখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, বন্ধুদের কমেন্ট আমি অবিকল উদ্ধৃত করেছি। কোথাও কোনো কারেকশন করিনি।
লন্ডনে বাস করেন একজন বাংলাদেশি। নাম মুজিব কয়রু। তিনি লিখছেন, ‘আমি ( ১৪.৬.১৮) লন্ডন শহরে পেশাগত কারণে প্রায় আশি মাইল গাড়ি ড্রাইব করেছি। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কোন জড়তা আলোচনা বা উম্মাদনা চোখে পড়েনি। মাত্র দুটি জায়গায় ইংল্যান্ডের পতাকা উড়তে দেখেছি। একটি ঘরের বেলকনিতে অন্যটি একটি গাড়িতে। অন্য কোন দেশের পতাকা দৃষ্টিগোচর হয়নি। (আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে)। আমাদের দেশে ফুটবল উম্মাদনা সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে! এর জন্য দায়ী মূলত এক শ্রেণীর সাংবাদিক, সেলিব্রিটি এবং রাজনীতিকরা। আম জনতাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। সস্তা জনপ্রিয়তা আর মিডিয়ার বাড়তি কাটতির আশায় সাংবাদিকের কমন প্রশ্ন আপনে কোন দলের সমর্থক? আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল? এভাবেই উম্মাদনা নামক ভাইরাসটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছ। অথচ এই দুই দেশের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নাই বললেই চলে।
ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এতে কোন সন্দেহ নেই। আমিও ফুটবল খেলা উপভোগ করি। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বকাপ জ্বরে ভোগছে এই সময়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডও একটি শক্তিশালী দল। যে দেশ একবার বিশ্বকাপ জিতেছে সেমিফাইনালে খেলেছে এবং সেই দল বিশ্বকাপে থাকার পরও সেদেশ এবং ইউরোপের মানুষের মাঝে উন্মাদনা মূলত খেলার মাঠে, পাবে, রেস্টুরেন্টে, ঘরে। নেই মিছিল, পতাকা উড়ানোর প্রতিযোগিতা, হানাহানি, পছন্দের দলের পতাকা উড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎপিষ্ট হয় প্রাণহানি!
বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা থাকতেই পারে। সেটি উৎসব মুখর হলেই বোধ হয় ভালো। কিন্তু সেই উন্মাদনা যদি হিংসাত্মক উন্মত্ততায় রূপ নেয়, ভয়ংকর। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ২১১টি দলের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৪তম। কিন্তু বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে গোটা বাংলাদেশ। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশের শহরগুলো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় সয়লাব হয়ে গেছে। এ নিয়ে বিশ্বের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। সংবাদ সংস্থা এএফপি বলেছে, লিওনেল মেসি ও নেইমারের দুই দল সমর্থক। দুই দলের সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এক বাবা ও ছেলে। এতে কি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে?
আনোয়ারুল হক আনোয়ার নামে আর এক বন্ধু লিখেছেন, আমরা হুজুগের মাঝে আছি। বিদেশে বৃষ্টি হলে আমরা বাংলাদেশে ছাতা ধরি। মার্কিন নির্বাচনে তাদের চাইতে আমাদের প্রচারণা বেশি, ভারতীয় নতুন ছবি মুক্তি পেলে আমাদের মিডিয়াগুলোতে তোলপাড় শুরু হয়। ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি। অথচ নিজেদের খবর নাই। একটি দলকে সমর্থন করা ভালো। কিন্তু জমি বিক্রি করে, ভূরি ভোজ দিয়ে, দুই তিন কিলোমিটার পতাকা তৈরি করে, হোন্ডা মহড়া দিয়ে কিংবা আত্মহত্যা করে। ভাবতে অবাক লাগে।
এম আলী রেজা লিখেছেন, লেখাটিতে হুজুগে বাঙ্গালীর পরিচয় ও সংস্কৃতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সব দেশ থেকে আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষে আর হুজুগে সুপার পাওয়ার। এই চলমান সংস্কৃতির লাগাম টেনে না ধরা হলে বিশ্বে আমরা সুপারই থাকব। প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জিহাদ। কি বলেন!
তিন
এই যে এতো ক্রেজ, এই যে এত মাতামাতি, তার এন্ড রেজাল্ট কি? ৩২টি দেশ নিয়ে খেলা শুরু হয়েছিল। গত শনিবার রাতে এসে সেটি ৪টি দলে সীমাবদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ সেমি ফাইনালে এসেছে। সেমি ফাইনালে খেলবে ৪টি দল। এরা হলো ফ্রান্স ও বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়া ও ইংল্যান্ড। ১০ জুলাই রাত ১২টায় ফ্রান্স ও বেলজিয়াম এবং ১১ জুলাই রাত ১২টায় ক্রোয়েশিয়া ও ইংল্যান্ড। যারা কয়েকটি দলকে নিয়ে মাতামাতি করলেন তাদের দলগুলি কোথায় গেল? কোথায় গেল আর্জেন্টিনা? কোথায় গেল ব্রাজিল? কোথায় গেল জার্মানি? কোথায় গেল উরুগুয়ে? আর্জেন্টিনা তো কোয়ার্টার ফাইনালেই আসতে পারেনি। ব্রাজিলও কোয়ার্টার ফাইনালে আসতে পারতো না, যদি না তার সাথে শেষ ১৬ তে সার্বিয়ার সাথে খেলা হতো। আমরা কিন্তু কোনো দলের জয়ে অতিরিক্ত উল্লাস দেখাবো না, আবার কোনো দল হারলে আমাদের মাথায় আকাশও ভেঙে পড়বে না। তাই বলে কোনো না কোনো দলের প্রতি ব্যক্তিগত লাইকিংস থাকতেই পারে। আমারও রয়েছে। সেটা টেলিভিশনের সামনে খেলা দেখার সময় প্রকাশ করেছি। আমার পছন্দের দল জিতলে উল্লাসে চিৎকার করেছি, হারলে মন খারাপ করেছি। তাই বলে সেই দলের পক্ষে বা বিপক্ষে পাড়ায় পাড়ায় গ্রæপ করা, পতাকা বানানো, মধ্য রাত্রিতে শ্লোগানের নামে গগনবিদারী চিৎকার করে নগরবাসীর ঘুম ভেঙে দেওয়া- এসব করতে যাইনি।
ছোটকালে স্কুলের পাঠ্য বইয়ে পড়েছি কংগ্রেস নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের একটি উক্তি। আমাদের সময় এই উক্তিটি সকলের মুখে মুখে ছিল। সেটি হলো, What Bengalis think today the whole of India thinks tomorrow. অর্থাৎ বাঙ্গালীরা আজ যা ভাবে, সারা ভারত আগামীকাল তাই ভাবে। অনেক দিন আগে, অন্তত অর্ধ শতাব্দীরও বেশি আগে অনেকেই এই কথাটি বিশ^াস করতেন। অর্ধশত বছর পরে সেই কথাটি কেউ আর সঠিক বলে মনে করেন না। বাঙ্গালীদের বিশেষ করে সমগ্র বাংলার পূর্বাঞ্চলের মানুষদের সাথে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি বিশেষণ, যেমন আবেগপূর্ণ, হুজুগে এবং অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ। এক সময় মনে করা হতো তাদের হৃদয় কুসুম-কোমল। আজ সেটিকে ভাবা হয় সুষ্ঠং, কাষ্ঠং, ভয়ঙ্কর।
আমরা কি আগের জামানায় ফিরে যেতে পারি না, যখন চিৎকার করে বলা হতো, ‘দাও ফিরে সেই অরণ্য/ লও হে নগর’।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।