পশ্চিম তীরে সহিংসতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের
মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হওয়ার পর সউদী আরবে পরিবর্তনের গতি ও মাত্রা লক্ষ্যণীয়ভাবে দ্রæততর হয়েছে। উচ্চপদে নিজের অধিষ্ঠানকে বৈধতা দিতে, নিজের স্বৈরতান্ত্রিক উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ করতে এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে যুবরাজ মোহাম্মদ নিজে দেশের আধুনিকায়নের অগ্রদূত হিসেবে উপস্থাপন ও অধিষ্ঠিত করেছেন।
যুবরাজের বেশ কিছু বক্তৃতায় ও উদ্যোগে ইসলামের মধ্যপন্থার আহŸান জানানো, নারীদের গাড়ি চালনার অনুমোদন দান, সিনেমা হলগুলো আবার খোলার মত বিষয়গুলোকে সউদী শাহী পরিবার ও ওয়াহাবি আলেম সমাজের মধ্যকার ঐতিহাসিক চুক্তি ভঙ্গের ইচ্ছা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সউদী আরবে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন একজন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী। তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অনুসরণ এবং কুরআন ও হাদিসের আক্ষরিক বাস্তবায়ন মতবাদের প্রবক্তা। তিনি ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরে যাওয়ার ঘোর সমালোচক ছিলেন। তার মতে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শের অনুসারী নয় তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। তাদেরকে ইসলামে ফিরিয়ে আনার জন্য জিহাদ হচ্ছে একমাত্র পন্থা। ওয়াহাব ও তার অনুসারীদের সাথে চুক্তি ইবনে সউদকে তার সম্প্রসারণবাদী নীতি এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটি টেকসই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতা দেয়। সউদী শাহীতন্ত্র রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রকে নিজেদের একচেটিয়া করে, ওয়াহাবি আলেমরা ধর্মীয়, আইনি ও সামাজিক বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়।
শাহজাদা মোহাম্মদ ওয়াহাবি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান না বলেই মনে হয়, কারণ আলেমরা নিজেদের ক্রিয়াশীল হিসেবে প্রমাণ করেছেন এবং ক্ষমতার রূপান্তর ও খেয়াল-খুশি মেনে নেয়ার ব্যাপক সক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে তাদের প্রান্তিকীকরণের চেষ্টা হয়েছিল।
আধুনিক সউদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ ১৯০২ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শাসনকালে ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে হাতে নেন, পশ্চিমা অংশীদারদের সাথে কাজ করেন ও মুসলিম বিশে^র নিকট থেকে বৃহত্তর স্বীকৃতি পান। তিনি ওয়াহাবিবাদকে দুর্বল ও মধ্যপন্থী করতে ইসলামী সংস্কারবাদ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
অ-ওয়াহাবিদের প্রতি অধিকতর সহনশীলতা প্রদর্শন, অ-মুসলিমদের সউদী ভ‚খÐে অবস্থান অনুমোদন এবং আধুনিক শিক্ষা ও প্রশাসনকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে ওয়াহাবি আলেমরা মতাদর্শগত ছাড় প্রদান করে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন ও এমনকি আরো শক্তিশালী হয়েছেন।
তেল প্রাপ্তির পরবর্তী সময়ে সউদ ইবনে আবদুল আজিজ ও তৎকালীন বাদশাহ ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজের শাসনকালে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে সউদী আরবের অতিদ্রæত আধুনিকায়ন ঘটে। ক্রমবর্ধমান ও নানা ধরনের জনসংখ্যার প্রত্যাশা মিটাতে, বৈধতার নতুন উৎস সৃষ্টি করতে এবং নিখিল-আরব শাসকদের আধিপত্যবাদী দাবি ভÐুল করে দেশকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শাহী পরিবারের প্রবীণরা বেশি প্রাচীন ও ব্যক্তিক্ষমতামুখী ছিলেন।
আলেম সমাজ রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন ও সহায়ক পরিবর্তনকে হুমকি হিসেবে দেখলেও তারা সউদী বালিকাদের স্কুলে ভর্তি বা টেলিভিশন ও সিনেমা চালুর ক্ষেত্রে আপত্তি করেননি। বরং আলেমরা ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে নিখিল আরববাদের সাথে সউদী কর্তৃপক্ষের বিরোধ এবং তেল থেকে বিপুল অর্থপ্রাপ্তির সুযোগকে গ্র্যান্ড মুফতির অফিস, ফতোয়া আমলাতন্ত্র, ধর্মীয় স্কুল এবং মদিনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় ও রিয়াদে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিকায়নের কাজে ব্যবহার করেন।
আলেমরা ইসলামী আদালত, মিডিয়া সংস্থা ও মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের মত বিশ^ ইসলামী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তেলসম্পদ-উদ্ভ‚ত আধুনিকতা সউদী আরবে তাদের প্রভাব জিইয়ে রাখতে ও তাদের বিশ^দৃষ্টিভঙ্গি রফতানি করতে আলেম সমাজেকে সাহায্য করে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব, মক্কায় হারাম শরীফের উপর হামলা এবং ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলা ওয়াহাবিদের জন্য অনুক‚ল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মক্কায় হামলার পর শিয়া বিপ্লবী চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ ও কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজ বিশ^াসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারে সউদী শাহীতন্ত্র শরীয়া কঠোরভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে ইসলামের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করে। শারীরিক দÐ আরোপ, প্রকাশ্য স্থানে নারী-পুরুষের একত্র উপস্থিতি নিষিদ্ধ, সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ, ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আফগানিস্তানে জিহাদি গ্রæপগুলো ও বিশে^র অন্যান্য স্থানে সুন্নী ইসলামী আন্দোলনে আর্থিক ও মতাদর্শগত সমর্থন প্রদানের পদক্ষেপ নেয়া হয়।
এর বিনিময়ে আলেমরা অভ্যন্তরীণ শত্রæ এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, সাদ্দাম হোসেন ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মত বিদেশী শত্রæদের বিরুদ্ধে সউদী শাহী পরিবারকে সমর্থন প্রদান করেন। স¥রণ করা যেতে পারে যে আলেমরা সউদী আরবে আমেরিকান সৈন্যদের উপস্থিতির বৈধতা দিয়ে ১৯৯০ সালে এক অত্যন্ত অজনপ্রিয় ফতোয়া প্রদান করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা সউদী আরবকে এক বেকায়দা অবস্থায় ফেলে দেয়, কারণ ওসামা বিন লাদেন ও ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগই ছিল সউদী নাগরিক। সউদী আরব জিহাদি আন্দোলন থেকে নিজেকে পৃথক করে নিতে বাধ্য হয়। অন্যান্য আরো যে সব ব্যবস্থা গৃহীত হয় সেগুলোর মধ্যে ছিল ওয়াহাবিদের সমালোচনা করার অনুমোদন, ধর্মীয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুরু এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা হ্রাস।
আলেমরা শাহীতন্ত্রের সাহায্যে এগিয়ে আসেন, পাশাপাশি ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে জিহাদবাদ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে, এ ব্যাপারে সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশ করে ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোতে বক্তব্য রেখে তাদের নিজেদের স্বার্থও সংরক্ষণ করেন। তারপরও কিছু পর্যবেক্ষক ওয়াহাবি-উত্তর সউদী আরব সম্পর্কে কথা বলেন। কিন্তু চাপ কমে আসার সাথে সাথে আলেম সমাজ ও শাহীতন্ত্র শুরুর সময়কার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
২০১১ সালে আরব গণঅভ্যুত্থানের পর বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ গণঅভ্যুত্থানের ফলে সউদী আরবের প্রতি সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করতে সমর্থন দেয়ার জন্য আলেম সমাজকে অনুরোধ করেন। আলেমরা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তাকে সাহায্য করেন, কিন্তু বিনিময়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাজেট বৃদ্ধি, প্রকাশ্য স্থানে শারিয়া ভঙ্গের ঘটনার জন্য বড় রকম শাস্তির ব্যবস্থা, শিয়া বিরোধী আলোচনা জোরদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মত দমনের ব্যবস্থা আদায় করেন।
২০১৫ সালে বাদশাহ সালমানের সিংহাসন আরোহণ শাহজাদা মোহাম্মদের উত্থানের পথ খুলে দেয়। উগ্রবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে যুবরাজের প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি ও মধ্যপন্থা ইসলামের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রæতিকে ওয়াহাবিবাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার বারংবার ইচ্ছা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, যুবরাজ মোহাম্মদ মুসলিম ব্রাদারহুড ও জিহাদিদের নিন্দা এবং ওয়াহাবিবাদের দোষস্খালন করেন।
এর প্রেক্ষিতে আলেম সমাজ যুবরাজ মোহাম্মদের প্রতি অবিচ্ছিন্ন সমর্থন প্রদান করেছে এবং ফতোয়া জারির মাধ্যমে তার সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করেছে। যেমন নারীদের গাড়ি চালনার অনুমতি প্রদান। ক্ষমতার ভারসাম্য যখন আর পথ খোলা রাখেনি তখন আলেমরা অপ্রধান বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন এবং এভাবে তাদের কর্তৃত্ব ধরে রেেেখছেন।
ওয়াহাবিবাদ মধ্য মেয়াদে সউদী রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ হিসেবে রয়েছে বলে মনে হয়। আলেম সমাজ তাদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যাপক বস্তুগত ও প্রতীকী অর্থে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সে সব হচ্ছেÑ স্কুল, বিশ^বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়া গ্রæপসমূহ। তারা সচেতন যে সউদের সন্তানগণ ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের উত্তরসুরিদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ উভয়ের ধ্বংস ডেকে আনবে।
শাহী পরিবার ও আলেম সমাজের মধ্যকার ঐতিহাসিক চুক্তি কখনোই গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। অন্তর্বর্তী সময়ে বা সংকট কালে পরিবর্তিত ক্ষমতার সম্পর্ক ভালো করে প্রদর্শন ও কার্যকর ভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অংশীদারদের সক্ষম করতে এ চুক্তির পুনর্ব্যাখ্যা বা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
সউদী শাহীতন্ত্র ও ওয়াহাবি আলেম সমাজের মধ্যকার চুক্তি ছিন্ন করতে হলে একটি বিকল্প সামাজিক প্রকল্প, দেশের অভিজাত সমাজ ও জনগণের অবিচ্ছিন্ন সমর্থন, একটি সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং একটি অনুক‚ল প্রেক্ষাপট দরকার। এ মুহূর্তে যুবরাজ মোহাম্মদের ব্যক্তিগত প্রভাব থাকলেও এ সব সম্পদ তার নেই।
*নিবন্ধকার নাবিল মুলাঁ প্যারিসের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ-এর সিনিয়র গবেষক ও সউদী ইতিহাসবিদ। তিনি ‘দি ক্লারিকস অব ইসলাম : রিলিজিয়াস অথোরিটি অ্যান্ড পলিটিক্যাল পাওয়ার ইন সউদী আরাবিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থের রচয়িতা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।