Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সৎলোকের পরিচয়

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

এক

সততা মানব চরিত্রের একটি মহৎ গুণ। সততা মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সততা মনুষ্যত্ব্যের বিকাশ ঘটায়। সততাই মানব জীবনে সফলতা ও আনন্দ বয়ে আনে। সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। সততা মানব চরিত্রের মুকুট স্বরূপ। সৎলোক কখনও মিথ্যা কথা বলেনা, কারো সম্পদ লুট করেনা, তার দ্বারা ঘুষ গ্রহণ ও মানুষের সাথে প্রতারণা করা সম্ভব হয়না। প্রত্যেক সমাজেই সততার জয় জয়কার। সততার সামাজিক মূল্য অপরিসীম। এই সততার মাধ্যমেই সমাজে সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সততার অভাবে সমাজ দুর্নীতিগ্রস্থ হয়। বিশ্বের দরবারে দেশ ও জাতি হয় কলংকিত। বিশ্বে আজ অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে সৎলোকের অভাব। সৎলোকের অভাবে জাতিতে জাতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই আছে। ফলে বিশ্বের প্রতিটি কণায় কণায় অশান্তির অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। সততার পুরস্কার চিরন্তন। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সততার জন্যই ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ করেছিলেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) সততার জন্য লাভ করেন ‘সিদ্দীক’ উপাধি। সৎলোকের সাথে থাকা মানেই স্বর্গে থাকা। জনৈক কবি বলেন ‘‘সহবতে সালেহ তোরা সালেহ কুনদ/সহবতে তালেহ তোরা তালেহ কুনদ অর্থাৎ সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
সৎ লোকের সঙ্গী হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ লোকের সঙ্গী হয়ে যাও’’ (সূরা তওবাঃ আয়াত-১১৯)। আল্লাহপাক সৎলোকের সঙ্গী হওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। সৎ লোক কারা? সৎলোকের পরিচয় কি? সততার স্বরূপ কি? এসব প্রশ্নের জবাব আমরা কোরআন হাদীস পর্যালোচনা করলেই পেয়ে যাব। নবম হিজরীতে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে অনেক মুনাফিক মিথ্যা ওজর পেশ করে শরীক হয় নাই। মুনাফিকরাতো ইসলামের চরম শত্রæ। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কাব ইবনে মালিক (রাঃ), মুররা ইবনে রবি (রাঃ) ও হেলাল ইবনে উমাইয়া (রাঃ) এই তিনজন জিহাদের প্রবল আকাংখা থাকা সত্তে¡ও বিশেষ অসুবিধার কারণে তাবুক যুদ্ধে শরীক হতে পারেন নি। অথচ এসব সাহাবী ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে আসক্ত। তাবুক যুদ্ধে শরীক না হওয়ার কারনে উক্ত তিন সাহাবীকে এক ঘরে করে রাখা হয়েছিল। উক্ত তিন সাহাবীই ছিলেন সৎ ও মহৎ। আর সৎ থাকলে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতেই হয়। বিনম্র চিত্তে তিন সাহাবী আল্লাহর দরবারে তওবা করতে থাকলেন। ৫০ দিন এইভাবে এক ঘরে থাকার পর আল্লাহপাক তাদের তওবা কবুল করলেন। আল্লাহপাক পরিচয় করিয়ে দিলেন উক্ত তিন সাহাবীই সৎ। বিশেষ অসুবিধার কারণে তারা তাবুক যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। আল্লাহপাক নির্দেশ দিলেন- ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎলোকের সঙ্গী হয়ে যাও।’’ (সূরা তওবাঃ আয়াত-১১৯) তাবুক যুদ্ধের উক্ত ঘটনার দ্বারা প্রমাণ হল যে- সৎ থাকলে কষ্ট সহ্য করতে হয়।
সৎ লোকের সুনাম ও সুখ্যাতি চিরদিন অব্যয় অক্ষয় হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আসহাবে কাহাফের ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। মূর্তিপূজক বাদশা দাকিয়ানুসের আমলে ৭জন যুবক তাদের ঈমান ও সততা রক্ষার জন্য তাদের দেশ ত্যাগ করেন। একটি কুকুরও তাঁদের সঙ্গী হয়ে যায়। ৭জন যুবকের নাম মাকসেলাইনিয়া, মারনুশ, মাসলিনিয়া, ইয়ামলিখা, কাফশাততাইয়ুশ, দাবারনুশ ও শাযনুশ। আর কুকুরটির নাম কিতমীর। তারা একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয় এবং কুকুরটি গুহার দ্বারে পাহারাদার হিসাবে কাজ করে। ঐ গুহার মধ্যে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। এক ঘুমে ৩০৯ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তাদের একজন ‘আফমুস’ নামক শহরে খাদ্য দ্রব্য আনতে যায়। দোকানদারকে সে একটি দিরহাম দিলে দোকানদার বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি কোথা থেকে এসেছ এবং এ দিরহামটি কোথায় পেয়েছ? এতে অনেক লোক একত্রিত হল। দিরহামটি তৎকালীন বাদশার কাছে নেয়া হল। তৎকালীন মুসলিম বাদশা দেখলেন দিরহামটি ৩০৯ বছর আগের। এতে প্রমাণ হল আসহাবে কাহাফের উক্ত ৭ যুবক ও কুকুরটি ৩০৯ বছর একাধারে ঘুমিয়েছিলেন। দাকিয়ানুশ-বাদশার অত্যাচার থেকে মুক্তি ও সততা রক্ষার জন্য উক্ত যুবকরা দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তাদের সততার ঘটনাকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহপাক তা কোরআনে উল্লেখ করেছেন। উক্ত ৭জন সৎ ও মহৎ যুবকের সঙ্গী হওয়ায় আল্লাহপাক সেই কুকুরটিকেও জান্নাত দান করবেন।
সৎ লোকের পরিচয় ও সততার স্বরূপ সম্পর্কে অগণিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃত কথা বলতে গেলে আমি বলবো- প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে যারা আল্লাহকে ভয় করে সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকেন তারাই সৎলোক। সৎলোকের পরিচয় সম্পর্কে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন- বনি ইসরাঈলের তিনজন লোক পথ চলছেন এমন সময় প্রবল ঝড়-তুফান আসলে তারা একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ একটি পাথর এসে তখন গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। উক্ত তিন ব্যক্তি মহাপবিপদে পড়লেন। এমন সময় তাদের একজন বললেন- আমাদের জীবনে যদি কেউ কোন সৎকাজ করে থাকি তবে সেই সৎকাজের ওছিলা নিয়ে দোয়া করি। হয়ত মহান আল্লাহপাক এই সৎকাজের ওছিলায় আমাদেরকে এই মহাবিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তখন তাদের একজন দোয়া করলো হে আল্লাহ! আমার মাতা-পিতা অতি বৃদ্ধ ছিলেন। আমি ছাগল দোহন করে প্রথমেই আমার মাতা-পিতাকে পান করাতাম। একদিন ছাগল চরানো থেকে আসতে দেরী হলে দেখলাম আমার মাতা-পিতা ঘুমিয়ে গেছেন। আমি তাদেরকে জাগালাম না। আমি ছাগল দোহন করে দুধের গøাস হাতে নিয়ে তাদের শিয়রে ভোর পর্যন্ত দাড়িয়ে রইলাম। আমার সন্তানরা তখন ক্ষুধার তাড়নায় সারারাত কাঁদছিলেন। ভোরে আমার মাতা-পিতা জাগ্রত হলে প্রথমেই আমার মাতা-পিতাকে দুধপান করালাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এই সৎ কাজটি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি এর ওছিলায় আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা কর। এ দোয়ার ফলে পাথর একটু সরে গেল। তাদের দ্বিতীয়জন দোয়া করলো- ‘‘হে আল্লাহ! আমার এক পরমা সুন্দরী চাচাত বোন ছিল। তাকে আমি অত্যন্ত ভালবাসতাম। আমার যৌন চরিতার্থ পূরণ করার জন্য একশত দিনার দিয়ে তাকে বাধ্য করলাম। আমি যখন যৌন চরিতার্থ পূরণ করতে উদ্যত হলাম তখনই আমার চাচাত বোন বললো হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় করো, তুমি আমার সতীত্ব নষ্ট করোনা। তখনই আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় আসলো। আমি আল্লাহকে ভয় করে এই অপকর্ম ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এই সৎকাজটি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি এর ওছিলায় আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা কর। এ দোয়ার ফলে পাথরটি গুহার মুখ থেকে দুই-তৃতীয়াংশ সরে গেল। তাদের তৃতীয় ব্যক্তি দোয়া করলো- হে আল্লাহ! আমি ‘এক ফরক’ বা অতি সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে একজন মজুর নিয়োগ করলাম। ঐ মজুর বা শ্রমিক তার মজুরী না নিয়ে চলে গেল। আমি তার সেই মজুরী দিয়ে প্রথমে ছাগল, পরে গরু কিনলাম। এভাবে গরু ও ছাগলের এক বিরাট পাল হয়ে গেল। হঠাৎ ঐ মজুর এসে তাঁর পাওনা দাবী করলো। আমি বললাম- ঐ ছাগল ও গরুর পাল নিয়ে যাও। সে বললো আমার সাথে ঠাট্টা করোনা, আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার পাওনা দাও। আমি বললাম তোমার সেই মজুরী দিয়ে আমি বিভিন্নভাবে গরু-ছাগল কিনে গরু-ছাগলের বিরাট পালে পরিণত করেছি। সন্তুষ্ট চিত্তে তা নিয়ে যাও। একথা শুনে ঐ শ্রমিক ব্যক্তি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে গরুও ছাগলের পাল নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! যদি আমি ঐ সৎকাজটি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, এর ওছিলায় আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা কর। এ দোয়ার ফলে পাথরটি গুহার মুখ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে গেল। (বুখারী- মুসলিম)। উক্ত হাদীস দ্বারা একথাই প্রমাণিত- উক্ত তিন ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেই সৎকাজ করেছেন এবং অসৎকাজ বর্জন করেছেন। আর যারা একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে সকল অন্যায় কাজ ছেড়ে দেয় তারাই সৎলোক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রিয়নবী

২৯ জুন, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ