ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মুসলিম ঈদোৎসবগুলির মধ্যে ঈদুল ফেতর ও ঈদুল আজহা- এই দুই ঈদকে প্রধান উৎসব বলে খোদ
নবী করিম (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। যে-ই তাঁর সংস্পর্শে গিয়েছে তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়েছে এবং তাঁর মহৎ চরিত্রের প্রশংসা করেছে। শিশুদের প্রতি ছিল নবী করিম (সা.) এর অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালবাসা।
প্রিয়নবী (সা.) শিশুদের খুব আদর-স্নেহ করতেন। অন্যদের তাদের প্রতি কোমল আচরণের নির্দেশ দিতেন। তাদের সাথে দয়া ও সহানুভূতির আচরণের উপদেশ দিতেন। যারা শিশুদের সাথে দয়ার আচরণ করে না তাদের ভর্ৎসনা করতেন। তিনি বলেছেন, ‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং আমাদের বড়দের অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা নবী করিম (সা.) তাঁর নাতি হাসান (রা.)কে চুমু খেলেন। আকরা ইবনে হাবিস (রা.) পাশে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, আমার দশটা সন্তান। একজনকেও আমি কখনো চুমু দিইনি। নবী করিম (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয় যে দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না।’
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক বেদুইন সাহাবী নবী করিম (সা.) এর নিকট এসেছে। (নবী করিম (সা.) এক শিশুকে চুমু দিলে সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শিশুদের চুমু খান? উত্তরে নবীজী বললেন, হাঁ। সে বলল, আমরা তো শিশুদের চুমু দিই না। একথা শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তোমার দিল থেকে রহম ছিনিয়ে নিলে আমার কী করার আছে!’
কিছু সাহাবী নবী করিম (সা.) এর সাথে দাওয়াত খেতে বের হলেন। হঠাৎ দেখা গেল হুসাইন রাস্তায় খেলা করছে! নবী করিম (সা.) সবার সামনে এগিয়ে গেলেন এবং তাকে কোলে নেওয়ার জন্য উভয় হাত তার দিকে প্রসারিত করলেন। এ দেখে হুসাইন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করল। তখন নবীজি তাকে (ধরার জন্য এটাসেটা বলে) হাসাচ্ছিলেন। অবশেষে তাকে ধরে ফেললেন। এরপর তিনি এক হাত তার থুতনির নিচে রাখলেন, আরেক হাত মাথার পিছনে রাখলেন। তারপর তার মাথাকে নিচু করে তার মুখে মুখ রেখে চুমু খেলেন এবং বললেন, হুসাইন আমার হতে, আমি হুসাইন হতে। (অর্থাৎ আমাকে যে ভালবাসে সে হুসাইনকেও ভালবাসবে; হুসাইনকে ভালবাসা মানে আমাকে ভালবাসা) যে হুসাইনকে মহব্বত করে আল্লাহ তাকে মহব্বত করুন। হুসাইন আমার (প্রধান) দৌহিত্র। (তার মাধ্যমেই আমার বংশের বড় অংশের বিস্তৃতি ঘটবে)।
জাফর (রা.) মূতার যুদ্ধে শহীদ হলে তার শোকাহত পরিবারের খোঁজ-খবর ও সান্ত¦না দানের জন্য নবী করিম (সা.) জাফর (রা.) এর বাড়িতে যান। তার পরিবারের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সন্তানদের আদর করেন, স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। জাফর (রা.) এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রা.) বড় হয়ে সে মধুর স্মৃতি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘রাসূলে করিম (সা.) এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন এবং আমাদের জন্য দোয়া করলেন এই বলে, হে আল্লাহ! আপনি নিজেই জাফরের সন্তানদের অভিভাবক হয়ে যান।
আব্দুল্লাহ ইবনে সা’লাবা (রা.) হিজরতের চার বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। মুসআব ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, মক্কা বিজয়ের বছর আব্দুল্লাহ ইবনে সা’লাবাকে নবী করিম (সা.) এর নিকট আনা হলো। তিনি তার চেহারায় হাত বুলিয়ে দেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করেন।
জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, আমি রাসূলে করিম (সা.) এর সাথে ফজরের নামায পড়লাম। নামাযের পর তিনি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। আমিও তার সাথে বের হলাম। কয়েকজন শিশু তাঁর সামনে এসেছে। তিনি একজন একজন করে প্রত্যেকের গণ্ডদ্বয়ে কোমল স্পর্শ দিলেন। আমার গালেও পবিত্র হাতের শীতল স্পর্শ দান করলেন। তাঁর হাত থেকে তখন এমন শীতলতা ও সুঘ্রাণ পেয়েছি, (মনে হলো) যেন এইমাত্র তাঁর হাত তুলে এনেছেন আতরওয়ালার পাত্র থেকে।
আনাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) আনসারদের যিয়ারতে যেতেন। আনসারী শিশুরা নবীজীর চতুর্দিকে ভিড় করত। তিনি শিশুদের সালাম দিতেন, মাথায় হাত বুলাতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন।
শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে করিম (সা.) হাসান বা হুসাইনকে কোলে নিয়ে মাগরিব বা ইশার নামাযের উদ্দেশে বের হলেন। তাকে পাশে রেখে তিনি সামনে অগ্রসর হলেন এবং তাকবীর বলে নামায শুরু করলেন। নামাযের মাঝখানে একটি সিজদা খুব লম্বা করলেন। আমি মাথা উঠালাম। দেখি, তিনি সিজদায়, আর শিশুটি তার পিঠে! আমি আবার সিজদায় চলে গেলাম। নামায শেষ হলে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নামাযের মধ্যে একটি সিজদা অনেক দীর্ঘ করলেন! আমাদের তো আশঙ্কা হচ্ছিল, কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না তো! বা ভাবছিলাম, আপনার প্রতি কোনো ওহী নাযিল হলো! নবী করিম (সা.) বললেন, এগুলোর কোনোটিই ঘটেনি; বরং আমার এই ছেলে (নাতি) আমার উপর সওয়ার হয়েছে। আমার পছন্দ হলো নাÑ তার (শিশুমনের) ইচ্ছেটুকু পূরণ হওয়ার আগে তাকে সরিয়ে দিই।
আবু কাতাদা (রা.) বলেন, একদিন আমরা মসজিদে বসা। নবীজী তাঁর কন্যা যয়নব (রা.) এর মেয়ে উমামাকে কাঁধে করে আমাদের সামনে এলেন। এরপর নামাযের ইমামতি শুরু করলেন। উমামা তখনও নবীজীর কাঁধে। রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখেন। সিজদা থেকে উঠে আবার উঠিয়ে নেন। পুরো নামায তিনি এভাবেই আদায় করলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করনে, একবার দেখলাম, নবী করিম (সা.) হুসানইকে কাঁধে উঠিয়ে রেখেছেন আর তার লালা গড়িয়ে পড়ছে নবীজীর গতরে।
নবী করিম (সা.) শিশুদের আনন্দদানের জন্য নিজের সাথে বাহনে চড়াতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এক সফরে নবী করিম (সা.) মক্কায় আগমন করলে আব্দুল মুত্তালিব গোত্রের শিশুরা এগিয়ে এল নবীজীকে এস্তেকবাল-স্বাগত জানানোর জন্য। তখন তিনি আব্বাসের দুই ছেলে- কুসাম ও ফযলকে তাঁর সাথে বাহনে উঠিয়ে নিলেন। একজনকে বসালেন তাঁর সামনে, অন্যজনকে পেছনে।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, (নবী করিম (সা.) এক সফর থেকে ফিরে এলে) আমরা তিন শিশু; আমি, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস নবীজীকে স্বাগত জানানোর জন্য আসি। তখন তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে তাঁর সাথে বাহনে উঠিয়ে নেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৮২। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারীম (সা.) কোনো সফর থেকে ফিরে এলে তাঁর পরিবারের শিশুদেরকে এস্তেকবালের জন্য বের করা হতো। একদিন তিনি এক সফর থেকে এলে আমাকে তাঁর নিকট আনা হয়। তিনি আমাকে বাহনে উঠিয়ে তাঁর সামনে বসান। এরপর হাসান বা হুসাইনকে আনা হলে তিনি তাকে তাঁর পেছনে বসান। আমরা মদীনায় প্রবেশ করি এক বাহনে তিনজন আরোহণ করে।
সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) এবং হাসান ও হুসাইন নবীজীর শাহবা (ধূসর) খচ্চরে আরোহণ করলে আমি খচ্চরটি টেনে টেনে নবীজীর হুজরা পর্যন্ত তাঁদের নিয়ে যাই। তাঁদের একজন নবী করিম (সা.) এর সামনে, আরেকজন তাঁর পিছনে।
আনাস (রা.) নবীজীর খেদমত করতেন। তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল। নবীজী রসিকতা করে তাঁকে দুই কানওয়ালা বলে ডাকতেন। উম্মে সুলাইম (রা.) এর এক সন্তানের নাম ছিল আবু উমাইর। ছোট্ট শিশু। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। সে এটা দিয়ে খেলা করত। আনাস (রা.) বলেন, উম্মে সুলাইম (রা.) এর এক ছোট্ট ছেলে ছিল। নাম আবু উমাইর। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। নবী করিম (সা.) যখনই উম্মে সুলাইম (রা.) এর ঘরে আসতেন আবু উমাইরের সাথে হাসি-ঠাট্টা করতেন। একদিন তার কাছে এসে দেখেন, তার মন খারাপ। বললেন, কী হলো আবু উমাইরের, মন খারাপ কেন? লোকেরা বলল, সে যে নুগাইর পাখিটা দিয়ে খেলা করত সেটা মারা গেছে। এরপর থেকে যখনই নবী করিম (সা.) তাকে দেখতেন, বলতেন, আবু উমাইর! তোমার নুগাইরটার কী হলো! (দেখছি না যে!)
আবু হুরায়রা রা. বলেন, একদিন নবী করিম (সা.) বনী কায়নুকার বাজারে গেলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ফাতেমা (রা.) এর ঘরের আঙিনায় গিয়ে হাসানকে লক্ষ্য করে তিনবার ডাক দিলেন, আমার নানু কোথায়! হাসান (রা.) দৌড়ে এলেন। নবীজী তাকে দেখে আপন হস্তদ্বয় প্রসারিত করে দেন। হাসানও তার হাত বাড়িয়ে দেন। নবীজী তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমি তাকে মহব্বত করি। তুমি তাকে মহব্বত কর এবং যে তাকে মহব্বত করে তাকেও মহব্বত কর। একদিন মাহমুদ ইবনে রবী (রা.)কে রাসূলে কারীম (সা.) এর কাছে আনা হলো। রাসূলে কারীম (সা.) রসিকতা করে বালতি থেকে মুখে একটু পানি নিয়ে তার চেহারায় ছিটিয়ে দেন। তখন মাহমুদ (রা.) এর বয়স ছিল পাঁচ বছর। পরবর্তীতে তিনি নিজেই নিজের সে স্মৃতি বর্ণনা করেন।
সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি দশ (বা নয়) বছর নবী করিম (সা.) এর খেদমত করেছি, আল্লাহর কসম! কোনো দিন আমাকে ‘উফ’ বলেননি। আমি (অযাচিত) কোনো কিছু করে ফেললে বলেননি, এটা কেন করলে? তেমনি কোনো কাজ না করলে বলেননি, এটা কেন করলে না?
শিশুদের মন চঞ্চল। তারা খেলাধুলা করতে ভালবাসে। তাদেরকে খেলাধুলা করে আনন্দ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নবী করিম (সা.) এর আদর্শ। আয়েশা (রা.) এর যখন বিবাহ হয় তিনি ছোট ছিলেন। ফলে তিনি বান্ধবীদের সাথে খেলতেন। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.) এর ঘরে পুতুল দিয়ে খেলা করতাম। আমার (মত ছোট ছোট) কয়েকজন বান্ধবী আমার সাথে খেলত। নবীজী ঘরে এলে তারা লজ্জায় লুকিয়ে যেত। তখন তিনি একজন একজন করে তাদের আমার কাছে পাঠাতেন। তারা আবার আমার সাথে খেলতে শুরু করত।
শিশুর আকল-বুদ্ধি কম। সে বিরক্তিকর কিছু করলে তার জন্য দোয়া করা, যাতে তার মধ্যে সুন্দর বোধ আসে। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া কবুল হয়। পিতা-মাতা আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে, তাঁর দরবারে কান্নাকাটি করে সন্তানদের জন্য উত্তম আখলাকের জন্য দোয়া করলে সন্তান ও পিতা-মাতা সকলের কল্যাণ।
লেখক: সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।