পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মার্কিন লেখক জর্জ অরওয়েল যখন এনিমেল ফার্ম উপন্যাস লেখেন তখন পশ্চিমা বিশ্ব সবেমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নয়া বিশ্বব্যবস্থায় পর্দাপণ করার প্রস্ততি নিচ্ছিল। সে সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে তুলে ধরাই ছিল এমিমেল ফার্মের মূল উপজীব্য। রূপকাশ্রিত চরিত্র চিত্রণে এই উপন্যাসে যে রাজনৈতিক সমাজবাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছিল তার সাথে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এবং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর সাজুয্য, মিল-অমিল নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর খোদ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি সমাজবাস্তবতার সাথে এনিমেল ফার্মের চিত্রকল্প অনেকটাই মিলে গেছে। অত:পর গত এক দশকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা কোটি কোটি মানুষের জন্য অভাবনীয়ভাবে কার্যত ইতর প্রানীর বদ্ধ খাঁচায় পরিনত হয়েছে। গত দুই দশক ধরে বিশ্বে যে সব যুদ্ধ উন্মাদনা চলছে তা পেছনে নিপীড়িত জনগোষ্ঠির প্রতিবার প্রতিরোধ সংগ্রামের কোন সংশ্রব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং ভ’-রাজনৈতিক কারণে ভাগ্যবিড়ম্বিত ও পশ্চাতপদ জনগোষ্ঠিকে চিরতরে অধিকার বঞ্চিত রেখে তাদের পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতাকে চিরস্থায়ী করাই যেন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিদের পরিচালিত সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষত: তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেররিজমের’ হাত ধরে সূচিত মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদি যুদ্ধের সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও মানবিক বিপর্যয়ের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা যেন অন্ধকার যুগের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ৫ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে দিক-বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতা, জনসংখ্যাধিক্য, ক্ষুধা-দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষে যখন এত বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়, তখন যাদের দ্বারা আক্রান্ত সেই পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের দোসর ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পঙ্গপালের মত ছুটে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ বনি আদম। যতই দিন যাচ্ছে মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থা ক্রমেই জটিলতর হচ্ছে। জায়নবাদের ক্রীড়নক পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনে এই মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। দেড় দশকের বেশী সময় ধরে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ ও নানা ছুতোঁয় প্রক্সি ওয়ারের খপ্পরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রকে ইতিমধ্যেই নন ফাংশনাল বা অকার্যকর করে তোলা হয়েছে। অন্তত ১০টি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়াও এক সময় জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিল মানুষ। সভ্যতা ক্রমন্নোতির সাথে সাথে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের মৌলিক চাহিদা, জীবন যাপনের সংবেদনশীল ধারনা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু একোবিংশ শতকে এসে সভ্যতা ও বিশ্বব্যবস্থা যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করেছে। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে জায়নবাদি ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিদের যে অমানবিক তৎপরতা চলছে তা আমাদেরকে আদিম বর্বর যুগের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
আদিম যুগেও কোন প্রজন্মের মানব শিশুকে এমন বর্বরতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিনা কোন ইতিহাসেই তার কোন নজির খুঁজে পাওয়া যায়না। একদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে, আইএস-আলকায়েদার মত সন্ত্রাসী গ্রæপ সৃষ্টি করে এবং এসব গ্রæপ দমনের নামে, আঞ্চলিক আধিপত্যের উস্কানী দিয়ে, ধর্মীয় ও জাতিগত মতভেদ উস্কে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অনৈক্য, অস্থিতিশীলতা ও হানাহানি সৃষ্টি করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিকে ফোঁকলা ও ভঙ্গুর করে তোলা হয়েছে। দেশগুলোর রাষ্ট্রব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করে দেয়ার পেছনে শত বছরের জায়নবাদি চক্রান্ত পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের নীল নকশা সক্রিয় রয়েছে। তারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদি ইসরাইলের নিরাপত্তা চিরস্থায়ীভাবে নিশ্চিত করতে চায়। মাত্র এককোটি জায়নবাদি ইসরাইলীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধশত কোটি মুসলমানের জীবনকে সংশয়ের মুখে ঠেলে দিতে কুণ্ঠিত নয়। প্রতিবেশিদের সাথে চিরস্থায়ী বৈরিতা রেখে, শধুমাত্র অস্ত্রের জোরে এভাবে কখনো কোন জাতিরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়না। এভাবে জবর দখল ও আগ্রাসন চালিয়ে গত সত্তুর বছরেও ইসরাইল জায়নবাদিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান বাস্তবতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জায়নবাদি ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্নতর। তারা সম্ভবত ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের বর্তমান গন্ডির ভেতর শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি খুঁজে পায়না। তারা ক্রমান্বয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে স্থায়ী বৈরীতা, জাতিগত দ্বন্দ, শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ ও আইএস’র মত পশ্চিমা ও জায়নবাদের বশংবদ জঙ্গিগোষ্ঠি সৃষ্টি করে ও জিইয়ে রেখে আগামী শত বছরে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে চায়। এ জন্য যে সম্পদ, অস্ত্র ও সা¤্রাজ্যবাদি শক্তি প্রয়োজন তা ওদের আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বর্তমান বাস্তবতা প্রমান করছে জায়নবাদি ও যুদ্ধবাদী মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিরা একটি অমানবিক ও অবাস্তব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফর্মূলার বাস্তবায়ন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। ইরাক,সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার নিয়োগপ্রাপ্ত যুদ্ধবাদী প্রশাসনের আভ্যন্তরীণ ও আন্তজার্তিক নীতি কৌশলের মধ্যে ইসলামোফোবিক কর্মকান্ড এখন ওপেনসিক্রেট। গত শত বছর ধরে পশ্চিমা অর্থনীতি ও শিল্পবাণিজ্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান মনার্কি ব্যবস্থাও ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সৃষ্টি। পশ্চিমা বশংবদ রাজারা তেল বিক্রির সম্পদ পশ্চিমা ব্যাংকগুলোতেই গচ্ছিত রেখে নিরাপত্তার গ্যারান্টি খুঁজেছিল। নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার পর ঘোষিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজাদের গচ্ছিত শত শত বিলিয়ন ডলার এবং তাদের ডায়ন্যাস্টির নিরাপত্তার সামনে অভিযোগের জুজু খাড়া করার পাশাপাশি আইএস, আল-কায়েদার মত রহস্যময় দানবীয় প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে রাজতান্ত্রিক শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে।
বিশ্বের মূলধারার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ চলমান বিশ্বব্যবস্থার উপর টোটালিটারিয়ানিজম বা সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক মতবাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। মাল্টিকালচারালিজমের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিওকন রাজনীতিকদের বর্ণবাদি চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিনের। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবিøও বুশের যুদ্ধবাদী নীতির প্রতি সাধারণ মার্কিনীদের কোন সমর্থন ছিলনা, তার উত্তরাধিকার হিসেবে আড়াইশ বছরের মধ্যে প্রথম একজন আফ্রো-আমেরিকান মুসলমান বংশোদ্ভুত বারাক ওবামাকে নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েই তা প্রমানীত হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের জনগনের ইচ্ছায় ও স্বার্থে পরিচালিত হয়না। সেখানকার সা¤্রাজ্যবাদি ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের আশি শতাংশ মূলত এক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি, অর্থনীতি, করব্যবস্থা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, কর্পোরেট বাণিজ্য, কর্পোরেট মিডিয়া সর্বোপরি সব ক্ষমতার কেন্দ্র মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রণও পুঁজিবাদের সুবিধাভোগি কয়েকটি পরিবার ও গোষ্ঠির হাতে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভব্যাঙ্ক সহ পুরো ব্যাংকিং সেক্টর ও অর্থব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ কতিপয় জায়নবাদি ব্যাংকার, ধনকুবের ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। ব্যাংক, মিডিয়া ও অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের পথ ধরে সেখানকার রাজনীতি, নির্বাচনব্যবস্থা ও পররাষ্ট্রনীতির উপর জায়নবাদিদের একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে। মার্কিন জায়নবাদিরা ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অবিচ্ছেদ্য সা¤্রাজ্যবাদী অনুসঙ্গে আবদ্ধ করে রেখেছে। মূলত তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বা ভ’-রাজনৈতিক বিভাজনরেখা নেই। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জায়নবাদি ব্যাংকার ও বর্ণবাদী রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব অক্ষুন্ন থাকবে ততদিন সেখানে সত্যিকার অর্থে সেখানে জনগনের শাসন তথা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রসঙ্গক্রমে আমরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলছি, তখন আমাদের মত দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও জনগনের নিরাপত্তাহীনতা অনেক অনেক বেশী ভয়ঙ্কর ও ভঙ্গুর। বিশ্বযুদ্বে বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয়াবিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকের ভ’মিকায় থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতবাদ ও ব্যবস্থাপনা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আমাদের মত এশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে। মার্কিন নিওকনদের উপরইসরাইলী জায়নবাদ এখন এতটাই সুসংহতভাবে প্রভাব সৃষ্টি করছে যে, তারা এখন বিশ্বের প্রায় সব মানুষের ডেমোগ্রাফি, ভ’-রাজনীতি, অর্থনীতি, চিন্তাধারা, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য নিজেদের অনুকুলে পাল্টে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই মুর্হূতে তারা মুসলমান সম্ভাব্য ঐক্য প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং আগামী দিনের সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে সম্ভাব্য সবকিছুই করছে।
অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হলেও মাত্র তিন বছর আগেও উত্তর আফ্রিকায় ইয়েমেন ছিল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র। সৌদি আরবের নেতৃত্বে ইয়েমেনে হুথি বিরোধি যৌথ সামরিক অভিযানের শুরুতে বলা হয়েছিল এটি হবে খুব স্বল্প মেয়াদী যুদ্ধ। আড়াই বছর ধরে অবিমার বোমা বর্ষণ করে ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর বন্দর ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামো গুলোকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করা হলেও অভিযান তার লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সউদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরাইলের সামরিক সমর্থন নিয়েও হুথি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করা যায়নি। ইতিপূর্বে দশকব্যাপী আগ্রাসন-আক্রমন চালিয়েও মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগান তালেবান বা আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারেনি। তারা সে সব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়নি, অথবা হুথি দমনের নামে রাষ্ট্র হিসেবে ইয়েমেনকে ধ্বংস ও অকার্যকর করে দেয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সউদি আরবের ইমেজ সংকট সৃষ্টি করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। গত দেড় বছর ধরে জাতিসংঘের অঙ্গভুত বেশ কয়েকটি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ইয়েমেনে গণহত্যা, মহামারি ও মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। একটি রাষ্ট্র, তার লাখ লাখ শিশু ও নিরস্ত্র জনগোষ্ঠিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়? এই প্রশ্নের জবাব প্রকারান্তরে আগেই দেয়া হয়েছে। সিরিয়া ও পশ্চিম ইরাকের অবস্থা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিছুটা উঠে আসলেও ইয়েমেনের প্রকৃত চিত্র ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপণ করা হচ্ছে। সেখানকার অর্থনৈর্তিক কর্মকান্ড নিস্ক্রীয় হয়ে পড়েছে। সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাস্তা, ব্রীজ, স্কুল, হাসপাতাল, কৃষি খামার, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পর এখন খাদ্য ও পানির সংকটে সেখানে দুর্ভীক্ষাবস্থায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধে গত এক দশকে অন্তত ৫ কোটি মানুষ আভ্যন্তরীনভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রায় এককোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে এবং ইউরোপে শরনার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিমান হামলা থেকে জীবন বাঁচাতে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে কত নারী ও শিশুর সলিল সমাধি ঘটেছে তার কোন সঠিক তথ্য কারো হাতেই নেই। তুরস্কের উপকুলে শিশু আয়লান কুর্দির উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশের ছবি মধ্যপ্রাচ্যের শিশুদের বিপন্ন অবস্থার প্রতিক হয়ে উঠলেও ইয়েমেনের অবস্থার সাথে বিশ্বের আর সময়ের যুদ্ধপরিস্থিতির তুলনা করা যাচ্ছেনা। সেখানে লাখ লাখ শিশু, নারী ও আহত মানুষ এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে পালিয়ে যাওয়া শরনার্থী শিশুদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার শিশুর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা বলে বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। হাজার হাজার শিশু কোথায় কিভাবে গায়েব হয়ে গেল, তাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। কোন জায়নবাদি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠি যদি এসব শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিনত করতে চায়, তা অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত এককোটি শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনিবন্ধিত অভিবাসিদের বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছেন তাতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপীড়িত অভিবাসিদের শিশুরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ‘ব্যাটলফিল্ড আমেরিকা: ওয়ার অন আমেরিকান পিপল’ গ্রন্থের লেখক, জন হোয়াইটহেড’র লেখা একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আইসিএইচ বøগে প্রকাশিত হয়েছে। ‘কেজিং চিলড্রেন, সেপারেটিং ফ্যামিলিজ: হ্যাজ দ্য ওয়ার অন ইমিগ্রেশন গান টু ফার’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে নতুন ইমিগ্রেশন আইনে অভিবাসি শিশুদেরকে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বণ্য প্রানীর খাঁচাবন্দি করার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অনিবন্ধিত অভিবাসি পরিবারগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়ার সময় তাদের শিশুগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে। খামারের কুকুর, বানর ও শুকর শাবকের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় এসব মানব শিশুর সাথে তার চেয়েও খারাপ, অমানবিক আচরণ করার চিত্র তুলে ধরেছেন জন হোয়াইটহেড। এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, আফগান্তিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, গাজাস্ট্রিপ বা কোন শরনার্থী শিবিরের চিত্র নয়। মাল্টিকালচারালিজম, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অভিবাসন একই সুত্রে গাঁথা। মুসলমানদের একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করার এক নজিরবিহীন প্রক্রিয়া চলছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।