Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শবে কদর : এক মহিমান্বিত রজনী

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাহাবাদের মজলিস, বিশ্ব মানবের ইহা-পরকালের চিরশান্তি, মুক্তি ও উন্নতির পথ বাতলাতে বক্তব্য রাখছিলেন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর বক্তব্যে চলে আসে অতীত জনগোষ্ঠী বনি ইসরাইলের কিছু সংখ্যক দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত বিচক্ষণ মহাপুরুষের জীবনকথা। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রঃ) এর বর্ণনা এসেছে, দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের জীবনের সর্বশেষ হাজারটি মাস আল্লাহর উপাসনায় মশগুল ছিলেন। তন্মধ্যে কেউ দিনের বেলা জেহাদ ও রাত্রিবেলা এবাদতে মগ্ন থাকতেন, আবার কেউ দিবারাত্র এবাদতেই কাটাতেন। এ সময়ে তাদের থেকে পূণ্য ব্যতীত পাপ বা ভ্রষ্টতা কিংবা অপ্রিয় কিছু সংঘটিত হয়নি। সাহাবারাও আশ্চর্যবোধ করলেন ওইসব মনীষীর জীবনাদর্শনের বর্ণনা শুনে। সেই মুহূর্তে জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে আশার আলো পবিত্র কোরআনের ‘সূরা কদর’ নিয়ে উপস্থিত হন। সূরাটি শুনে সাহাবারা খুশিতে আত্মহারা। আল্লাহ ও রসূলের প্রশংসায় তাঁরা মাতোয়ারা হয়ে উঠেন।
কী সংবাদ দেওয়া হয়েছে সূরাটিতে, মুসলিম জীবনে শবে কদরের কী-ই বা প্রয়োজন, কী স্বার্থে নাজিল হলো সূরাটি? এর রহস্য উদঘাটনে সাহাবারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নবীর (দঃ) কাছ থেকে এর ব্যাখ্যা জানতে তাঁরা উদগ্রীব। নবী (দঃ) ব্যাখ্যা দিলেন, অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ কীভাবে শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির পথ ও পন্থা পেয়ে যায় সে বিষয়ের সন্ধান দিতে সূরাটি অবতারিত। সাহাবাদের অন্তরে খুশির জোয়ার নেমে এল। প্রিয় নবী (দঃ) বলে দিলেন, যাঁরা ঈমান সহকারে পুণ্যের আশায় রমজানের এ রাতে এবাদত করবে তাঁদের পূর্বকৃত সমস্ত পাপ মাফ করে দেওয়া হবে। নবী (দঃ) শবে কদর লাভের উদ্দেশ্যে রমজানের প্রতিটি রাত বিশেষ করে শেষ দশটি রাত জেগে থাকতেন ও পরিবারস্থ সকলকে জাগিয়ে দিতেন। শেষকালে গুরুত্ব সহকারে রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে অবস্থান (এ’তেকাফ) করতেন ও বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ দশটি রাতে শবেকদর তালাশ করবে। অন্য বর্ণনায় বলেছেন, বে-জোড় রাতে তালাশ করবে। আরও বলেছেন, শবে কদর নির্দিষ্ট করে আমাকে বলা হয়েছিল, এ সুসংবাদটি তোমাদের দিতে গিয়ে দেখি তোমাদের দুই ভাই ঝগড়ায় লিপ্ত, তাদের বিবাদের কারণে শবে কদরের নির্ধারিত তারিখ আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার আল্লাহ পাক এই রাতকে রমজানের কোনও এক রাতে গোপন করে রেখে দিয়েছেন। তালাশ করে বের করতে হবে।
শবে কদর দু’ধরনের হতে পারে। এক, যে রাতে পূর্ণ কোরআন লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজেল হয়েছিল সে রাতটি বছরের যে কোনও এক রাতেই হতে পারে, রমজানেও হতে পারে। দুই, আর যে রাতটিতে খোদাপ্রেমীদের মন পরিতুষ্ট হয় ও উপাসনায় পরিতৃপ্তি আসে, ফেরেস্তারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং মুসলমানরা আল্লাহর এবাদতে আত্মনিয়োগ করেন ও আল্লাহ পাক বান্দাদের মর্যদার উচ্চাসনে উন্নীত করেন, তাঁরা বিশেষ নুরপ্রাপ্ত হন, ফেরেস্তাদের নৈকট্য লাভ করেন, তাদের দোয়া-প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়, সে রাতটি রমজানে বিশেষ করে শেষ দশদিনের কোনও এক বে-জোড় রাতে হয়ে থাকে।
শবে কদরে জিব্রাইল (আঃ)-এর নেতৃত্বে অসংখ্য ফেরেস্তা করুণাময় আল্লাহ তায়লার নির্দেশে সবধরনের কল্যাণ, শান্তি নিয়ে অবতরণ করেন। কোনও কোনও বর্ণনায় সত্তর হাজার ফেরেস্তা অবতরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহর এবাদতে মশগুল এমন সব নর-নারীকেই তাঁরা সালাম বা অভিবাদন জানান। দুনিয়ার সর্বত্র তাঁরা বিচরণ করেন ও আল্লাহর গুণগান করেন এবং আল্লাহর এবাদতে রত বান্দাদের দোয়ার সঙ্গে আমিন বলতে থাকনে। প্রত্যেক মুমিন বান্দার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
কদরের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, পরিমাপ অর্থাৎ এক বছরের জন্য শবে বরাত, গৃহীত কার্যবিবরণী সংযোজন ও বিয়োজনের সঙ্গে কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট ফেরেস্তাদের কাছে সোপর্দ করে দেওয়া হয়। ধন-সম্পদ, উন্নতি-অবনতি, জন্ম-মৃত্যু, সমস্যা ও সমাধানের পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়।
দুই, মর্যাদাসম্পন্ন রজনী- এ রাতে প্রচুর সংখ্যক ফেরেস্তা পৃথিবীতে আসেন, বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়, এরাতে দোয়া-উপাসনার মর্যাদা রক্ষা করা হয়, পবিত্র কোরআনের মতো মহানিয়ামত মানবকূলের হেদায়েতের জন্য এ রাতেই নাজিল করা হয়। এ রাতের এবাদত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম করা হয়েছে যা তিরাশি বছর চার মাসের অধিক। ভোর অবধি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, বরকত, শান্তি বর্ষিত হয় এবং ক্ষমার দ্বার উন্মুক্ত থাকে।
তিন, সঙ্কোচন- অর্থাৎ অগনিত ফেরেস্তা অবতরণের ফলে ভূ-মন্ডল ও নভমন্ডলে সঙ্কোচনের সৃষ্টি হয়। ভোরের দিকে যখন ফেরেস্তারা আকাশপথে প্রত্যাবর্তন করেন তখন জিব্রাইল (আঃ)-কে ফেরেস্তারা জিজ্ঞাসা করেন খোদা বিশ্বাসীদের সমস্যাবলী ও প্রয়োজনাদির ব্যাপারে আজ কী সিদ্ধান্ত হলো? জিব্রাইল (আঃ) উত্তর দেন, পূণ্যবানদের ক্ষমা ও পাপীদের বেলায় সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে। এতটুকু শুনে আসমান-জমিনের সকল ফেরেস্তা আনন্দিত হয়ে আল্লাহর গুণগান শুরু করেন। এতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। শবে কদরের লক্ষণ কী তা অবগত হওয়া দরকার। এক, পূণ্যবানদের অন্তর কোমল হয়, তাঁরা খোদার দরবারে অবনত মস্তকে ভেঙ্গে পড়েন, অন্তরে শান্তি-স্নিগ্ধতা অনুভূত হয়। দুই, এবাদতে তৃপ্তি আসে। তিন, অনেকে খোদার নূর (আলো) দর্শন করেন। চার, গাছপালা সেজদারত থাকে। পাঁচ, অনেকে ফেরেস্তাদের সালাম-কালাম শ্রবণ করেন। ছয়, নির্মল বায়ু প্রবাহিত হতে থাকে। সাত, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে। কখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়। আট রাত নাতিশীতোষ্ণ থাকে। নয়, ফেরেস্তাদের ফেরার পথে পরদিন সকালে সূর্যের আবছা কিরণ থাকে। তবে উলামায়ে কেরাম বলেন, শবে কদরের চিহ্ন বা আলামত তালাশ না করে ইবাদত করাই বেশি উপকারি।
পূর্ববর্তী নবীগণের সময় শবে কদর ছিল না। একমাত্র মোহাম্মদ (দঃ)-এর উম্মতকে আল্লাহ তায়ালা দয়া পরবশ হয়ে দান করেছেন। এ রাত যার ভাগ্যে জুটল না সে হতভাগা আর যারা পেয়ে যায় তাদের মতো ভাগ্যবান আর কে? এ রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম অর্থাৎ হাজার মাসের রোজা-জেহাদ থেকেও এ রাতের এবাদত উত্তম। শবে কদর রমজানের রাতে বিশেষ করে শেষ দশ রাতে তালাশ করতে বলা হয়েছে। দিন-তারিখ অনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। নবী (দঃ) ও সাহাবাগণ নিজ নিজ পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে সম্ভাব্য দিন-তারিখ বর্ণনা করেছেন, নির্দিষ্ট করে বলেননি। কিন্তু আজকাল যেভাবে প্রতিবছর নির্দিষ্ট করে সাতাশতম রাতে শবে কদর পালিত হচ্ছে তা সঠিক পদ্ধতি নয়। গৎবাঁধা প্রথা অনুযায়ী পালন করে শবে কদরের মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে চলেছে। এতে শবে কদর মুর্খতার আবরণে চাপা পড়ে থেকে যায় আর মুসলমান রেওয়াজের বশে বঞ্চনার শিকার হন। এ উপলক্ষে শিরনির জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা শরিয়ত সম্মত নয়।
শবে কদরে দু’টি কাজ প্রমাণিত। এক, এবাদতের মাধ্যমে রাত জাগরণ, দুই, ইহ-পরকালের কল্যাণে দোয়া ও ক্ষমা-প্রার্থনা। এজন্য মসজিদে মসজিদে সমবেত এবাদতের কোন ভিত্তি নেই। বরং হাদিসে বর্ণিত আছে, একাগ্রচিত্তে আপন গৃহে নফল এবাদত করা পূণ্যের দিক দিয়ে মক্কা মদীনার চেয়েও উত্তম। এ রাতের ইবাদত ইনফিরাদী বা ব্যক্তিগত ইবাদত। সামষ্টিক নয়। একদা হযরত আয়শা (রা.) রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন হে আল্লাহর রাসূল। আমি যদি শবে কদর পেয়ে যাই তাহলে কি আমল করবো। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, তুমি দুআ করবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’- ‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে পছন্দ করেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ আল্লাহপাক আমাদেরকে শবেক্বদর পেয়ে সঠিক আমল করার তাওফীক দান করুন।
লেখক- সাংবাদিক কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন