পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করেছেন। একটানা দশবার এবং সবমিলিয়ে দ্বাদশ বারের মতো তিনি বাজেট পেশ করেছেন। তার এবারের বাজেটের আকার হচ্ছে, ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এই অর্থের পুরোটাই ব্যয়ের জন্য। অন্যদিকে আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি কীভাবে মিটানো হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে মেটানোর কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে আয়ের মূল উৎস নির্ধারণ করা হয়েছে রাজস্ব ও ভ্যাট। বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জনপ্রশাসনে। এ খাতে শতকরা ১৮ ভাগ বরাদ্দ করা হয়েছে। তারপর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৪.৬ শতাংশ। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২.২ শতাংশ। এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হচ্ছে আমলা শ্রেণী ও সরকারি চাকরিজীবীরা। তাদের সুযোগ-সুবিধার অন্ত নেই। একজন সরকারি কর্মচারী বিশেষ করে নবীন কর্মকর্তা চাকরির শুরুতেই যাতে একটি ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিক হতে পারেন তার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ নীতিমালার আওতায় অত্যন্ত সহনীয় ও পরিশোধযোগ্য ৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে তিনি ফ্ল্যাট বা বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন। বাজেট এমনভাবে করা হয়েছে যে, এতে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ বেশ সুবিধা পাবেন। মধ্যবিত্তরা পড়বেন বিপাকে, যা সবসময়ই হয়ে আসছে। এর কারণ হচ্ছে, ভোটের রাজনীতিতে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। এই দুই শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে ভোটে পার পাওয়া যায়। এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকার শিরোনামগুলোর সারমর্ম হচ্ছে, এটা ভোটার তুষ্ট করার বাজেট।
আমাদের দেশের অর্থনীতির যে আকার সে অনুযায়ী ঘোষিত বাজেটকে বড় বলা যায় না। আরও বড় বাজেট ঘোষণা করা যেত। তবে বাজেটের আকার বড় না ছোট, এটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হলো যথাযথভাবে বা টু দ্য পয়েন্টে তা বাস্তবায়ন করা। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, কোনো বছরই বাজেটের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। মাঝপথে তা কাটছাঁট হয়েছে। নতুন করে টার্গেট ঠিক করা হয়েছে। এভাবে বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়তি না হওয়ায় উন্নয়ন লক্ষ্য অনর্জিত থেকে গেছে। অন্যদিকে আমাদের আমলারা বাজেট বাস্তবায়নে যতটা না দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে থাকে। অর্থ বছর শেষে ঠিকই কাগজে কলমে দেখিয়ে দেয় বাজেট ৯০-৯৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এক শুভংকরের ফাঁকির মধ্য দিয়ে অর্থবছর শেষ করে। বাজেটের আয়ের যে মূল উৎস রাজস্ব ও ভ্যাট-তা আদায় করার জন্য যে দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসন দরকার তার ঘাটতি থাকার কারণেই কাক্সিক্ষত আয় করা যাচ্ছে না, ঘাটতিও মিটছে না। বলা বাহুল্য, ১৭ কোটি মানুষের দেশে নিবন্ধিত আয়করদাতার সংখ্যা প্রায় ৩৩ লাখ। এর মধ্যে আয়কর দিচ্ছে মাত্র ১১ থেকে ১২ লাখ মানুষ। এই কর দাতাদের ওপর নির্ভর করেই রাজস্ব আয় হচ্ছে। এটা একটা অকল্পনীয় ব্যাপার। অথচ রাজস্ব বোর্ডের উচিত করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দক্ষতা ও কৌশল অবলম্বন করে তা কোটির ঘরে নিয়ে যাওয়া। তাহলে বাজেটের আকার আরও বড় এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে না। বাজেটে দশটি অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ গতি পেলেও অন্যগুলোর গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে পড়েছে। এগুলোর জন্য বাজেটও বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছরও একই কাজ করা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ করা হচ্ছে ঠিকই, এ অনুযায়ী এসব প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ বছর শেষে নির্ধারিত অর্থের চেয়ে আরও বেশি বরাদ্দ করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময় ঠিক করা হলেও ঐ সময়ের মধ্যে এগুলো কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষ জনবলের অভাব, সময়ক্ষেপনের মাধ্যমে অপচয় ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্পগুলোর কাজ ঠিক সময়ে শেষ হচ্ছে না এবং ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, মেগা প্রকল্প মানে মেগা দুর্নীতি। এই যে এবারের বাজেটে জনপ্রশাসনে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার কারণ একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। নির্বাচনের বছরে প্রশাসনকে তুষ্ট রেখে ক্ষমতার পথ মসৃন করাই যে অন্যতম কারণ তাতে কারো দ্বিমত নেই। একে প্রশাসন তুষ্টির বাজেট বললেও অত্যুক্তি হবে না। অন্যদিকে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বরাদ্দ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক ও পরিবহন খাতে এতো বাজেট রাখার পরও এ খাতের উন্নতি কোথায়? সারাদেশের সড়কের যা-তা অবস্থা। ঈদের সময় মানুষ সড়ক পথ নিরাপদ নয় ও ভোগান্তিতে পড়তে হবে ভেবে যতটা সম্ভব তা এড়িয়ে যাচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে, এ খাতে যত বরাদ্দ দেয়া হোক না কেন এর উন্নয়ন খুব একটা হচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ খাতেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় এবং হচ্ছে। এবারের বাজেটকে উচ্চবিত্তের তুষ্টি ও মধ্যবিত্তের কষ্ট হিসেবে অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন। অথচ দেশের অর্থনীতির অন্যতম যোগানদাতা মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্তরা যদি কষ্টে পড়ে যায়, এগতে না পারে, তবে অর্থনীতিও স্থবির হতে বাধ্য। এর থেকে যদি নিম্নবিত্তের দিকে ধাবিত হয়, তবে অর্থনীতির জন্য তা অশনি সংকেত।
এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য চমকের কিছু নেই। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনেরও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। যে অবস্থায় রয়েছে, আগামী অর্থবছরেও তাদের একই অবস্থায় থাকতে হবে। ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে, ক্ষমতায় থাকা না থাকার নিয়ামক শক্তি হিসেবে পরিচিত প্রশাসন ও ধনিক শ্রেণীর। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ বাজেটের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক আয় বৈষম্য বিরাজ করছে, তা আরও বাড়িয়ে দেবে। ধনী আরও ধনী হবে, গরিব আরও গরিব। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর টানাপড়েন আরও তীব্র হয়ে উঠবে। এ শ্রেণীটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাজেট দিলেই হয় না, তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে না পারলে তা ব্যর্থ ব্যহত হতে বাধ্য। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। বিগত বছরগুলোতে বাজেট বাস্তবায়নের হার আশাব্যঞ্জক ছিল না। জোড়াতালি দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন দেখানোর একটা অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এবারের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে বাজেটে জনপ্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে, সেই প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা এই বাজেট বাস্তবায়নে কতটা ভূমিকা পালন করে তা এখন দেখার বিষয়। এ বছরে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন দল বহাল থাকলে বা নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে, আমরা নিশ্চিত বাজেট বাস্তবায়নের পুরো চিত্রই হয়তো বদলে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাজেট যেমন গণমুখী ও উন্নয়ন বান্ধব হওয়া প্রয়োজন, তেমনি তার বাস্তবায়ন দক্ষতাও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, আমরা আশা করি, তা মোকাবেলায় সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।