Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আল আকসা ও জেরুজালেম প্রশ্নে নতুন বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রায় সত্তুর বছর ধরে টান টান উত্তেজনা সত্বেও স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের প্রত্যক্ষ কোন সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে দুই কোরিয়ার বিভক্তির পর থেকে দুই দেশ সর্বদা মারমুখী অবস্থানে থাকলেও তারা আর কখনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়ায়নি। ষাচেন দশকের প্রাককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশ কিউবায় সমাজতন্ত্র কায়েম হওয়ার পর থেকে দেশটি মার্কিনীদের কাছে বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকলেও এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি কখণো মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয়নি। স সব দু:সময় ও বৈরীতা পেরিয়ে রাষ্ট্রগুলো এখন নতুন বিশ্ববাস্তবতার মুখোখি হয়ে আপস, সমঝোতা ও সহাবমস্থানের নীতিতে উপনীত হতে সক্ষম হচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমানদের বেলায়। বিশ্বের একমাত্র দখলদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল গত সত্তুর বছর ধরে ফিলিস্তিনী ভিকটিমদের উপর ক্রমাগত অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে যাচ্ছে। এবার ইসরাইল যখন তার প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী পালন করছে, তখন একই সময়ে ফিলিস্তিনী ৭০তম নাকবা বা বিপর্যয় দিবস পালন করছে। ফিলিস্তিনীদের ভাগ্র্য নিয়ে ৭০ বছর ধরে পশ্চিমা দুনিয়া ইঁদুর বিড়াল খেললেও পশ্চিমা দুনিয়ার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পুরনো খোলস পাল্টে সব আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং ক‚টনৈতিক ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ইসরাইলের পক্ষে সরাসরি রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিনীদের দ্বৈতনীতির কারণে গত ৭০ বছরেও আরব-ইসরাইল সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। জায়নবাদি ইসরাইলীদের আগ্রাসনে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনী কোন স্থায়ী আবাস বা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। একসময়ের সমৃদ্ধ ফিলিস্তিনের নাগরিকরা মার মার খেতে খেতে নি:স্ব হয়ে পড়লেও তাদেরই ভ’মি দখল করে গড়ে ওঠা ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রতিদ্বন্দি সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যকে স্থায়ীভাবে পশ্চিমাদের বশংবদ করে রাখতে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইঙ্গ-ফরাসী,মার্কিন-জায়নিস্ট মহাপরিকল্পনা এক শতাব্দী পেরিয়ে এসে যখন একোবিংশ শতকের নতুন বিশ্ব বাস্তবতার মুখোমুখি, বিশ্ব সম্প্রদায় যখন ফিলিস্তিনীদের বঞ্চনার ইতিহাসের মূল্যায়ণ করতে শুরু করেছে, বিশ্বশান্তির জন্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে এই সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে জায়নবাদিরা এখন মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে তারা মধ্যপ্রাচ্যের সবচে স্থিতিশীল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইরানকে টার্গেট করেছে। মূলত: গত তিন দশক ধরেই ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে ক্ষমতার পরিবর্তন করে একটি পশ্চিমা বশংবদ সরকার বসাতে চাইছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ বাঁধিয়ে তা আট বছর পর্যন্ত জিইয়ে রাখার পেছনে পশ্চিমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি বড় প্রতিবেশী দেশকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরাইলের প্রতিদ্বন্দি হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে উভয়ের সম্ভাবনার ভিত্তি ভেঙ্গে দেয়া। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সাথে আপসকামী ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পশ্চিমাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রথমে কুয়েত দখলের মত সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় ধরনের খেসারত দিতে বাধ্য হয়েছেন। আট বছরব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধ, অত:পর প্রথম গাল্ফ ওয়ার এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়েও যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের প্রভাবকে ইসরাইলের বশংবদ করা যাচ্ছিলনা তখনই ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশনের মিথ্যা অভিযোগ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খড়গ তুলে ইরাক ও আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন দখলদারিত্বের যুদ্ধ মঞ্চস্থ করা হয়।
পশ্চিমা তথ্য অনুসারে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনের প্রায় আটলাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৬,৫৭০০০ আরব মুসলমান, ৮১০০০ আরব খৃষ্টান এবং ৫৯, ০০০ ইহুদি। অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক ইহুদিদের সংখ্যা ছিল শতকরা আট ভাগেরও কম। এই মাইনরিটি গ্রæপকে সেখানকার সব ভ’মির দখল বুঝিয়ে দিতে সামরিক শক্তি বেপরোয়া ব্যবহারে জায়নবাদী নীতিকে পশ্চিমাদের নির্লজ্জ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক সভ্যতার জন্য একটি চরম কলঙ্কজনক অধ্যায়। মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাথে অনেক রক্তাক্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও উত্থান-পতনের ইতিহাস আছে। এসব ইতিহাসের মূল্যায়নেও ঐতিহাসিকরা নানাভাবে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের ভ‚মিতে ইহুদিদের জায়নবাদি দখলদারিত্বের সমত্যুল্য বর্বরতার ইতিহাস মধ্যযুগ থেকে এখন পর্যন্ত নজিরবিহিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যনীতির পরিনর্তন অথবা তাদের চুড়ান্ত পতন না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার কোন সম্ভাবনা আপাতত: দেখা যাচ্ছেনা। নাইন-ইলেভেনের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে পশ্চিমা সামরিক এজেন্ডার বাস্তবায়ন চলছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব ও রিজিম চেঞ্জের পর অন্য সবগুলো দেশকে সন্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তুলতে ওয়ার অন টেররের অস্ত্রের পাশাপাশি আইএস’র মত সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে পশ্চিমাদের ভ‚মিকা এখন ওপেন সিক্রেট। এতকিছুর পরও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, জেরুজালেম ও আল আকসা পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের অটুট ঐক্য গড়ে উঠেছে। পূর্ব জেরুজালেম এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রয়াস ও সমর্থনও ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। জেরুজালেম প্রশ্নে ইহুদি প্রভাব থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও গত ৭০ বছর ধরে বিশ্বসম্প্রদায়ের সাথে সহমত পোষন করেই চলেছিল। এমনকি আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ায় দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের নীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গত দুই দশক ধরে দুর্বল মধ্যস্থতাকারীর ভ‚মিকায় দেখা গেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে গত ৫ বছরে আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক পর্যায়ে বেশ লক্ষ্যনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ফিস্তিনিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে প্রথমবারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলনের প্রস্তাব গ্রহনের আগে ইসরাইলী ও মার্কিনীদের প্রবল ক‚টনৈতিক চাপের মুখে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ভোটাভোটিতে অংশগ্রহণকারী ১৭২টি দেশের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ১১৯ ভোট এবং বিপক্ষে ইসরাইল, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ ৮টি ভোট পড়ে এবং ৪৫ টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় দিক হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান আছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এক ভোটাভুটিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৪৯৮জন সদস্য পক্ষে ভোট দেন, এর বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ৮৮টি এবং ১১১জন সদস্য ভোটদান থেকে বিরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ক‚টনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব অগ্রাহ্য করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সারাবিশ্বে এই ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনা দেখা দেয় তা নস্যাৎ করতেই সিরিয়ায় বিদ্রোহ, আইএস’র উত্থান, গাজায় সামরিক আগ্রাসন, ইয়েমেনে বিদ্রোহ সহ আরো অনেক কিছুই করা হয়। পক্ষান্তরে রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্ত অবস্থানের মধ্য দিয়ে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিত সমঝোতা চুক্তি ইসরাইলের যুদ্ধ পরিকল্পনার উত্তাপে পানি ঢেলে দেয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার বিদায়ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে চরম বর্ণবাদি ও ইসলামোফোবিক ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় জায়নবাদিদের জন্য যে নতুন সুযোগ এনে দেয় বর্তমানে তারই বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
সত্তুরতম নাকবা দিবসকে সামনে রেখে ফিলিস্তিনীরা ভ‚মি পুনরুদ্ধারের দাবীতে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলী সীমান্তে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেছিল ভ‚মি দিবস ৩০ মার্চ, যা ১৫ মে নাকবা দিবস পর্যন্ত অব্যাহত থাকার ঘোষনা দেয়া হয়েছিল। ইসরাইল সীমান্ত বেড়া থেকে কয়েকশ গজ দূরে অবস্থানরত ফিলিস্তিনীদের হাতে পাথর, গুলতি আর কিছুই ছিলনা। তবে ওরা ঘুড়ির মাধ্যমে সীমান্তের ওপারে ইসরাইলী সেনাদের কাছে তাদের বিক্ষোভের বার্তা পাঠিয়েছিল। গাজায় দশকব্যাপী ইসরাইলী অবরোধ এবং জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিবাদে এবারের ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’ ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযুক্ত করেছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী ইসরাইল সীমান্তের কাছে তাবু গেঁেড় বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণের উপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। তাদের এই বিক্ষোভ ও দাবীর ন্যায্যতা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। ইসরাইলীদের অভিযোগ হচ্ছে, এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক হামাস। তারা ফিলিস্তিনী বেসামরিক নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। নিজেদের সীমান্তে বিক্ষোভ সমাবেশ ও টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ ঠেকাতে ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাদের ¯œাইপার স্কোয়াড মোতায়েন করে। প্রতিদিন শত শত মানুষকে পাখির মত গুলি করলেও ফিলিস্তিনীরা পিছু হটেনি। দেড়মাসে দেড়শতাধিক মানুষকে হত্যা এবং ১২ হাজারের বেশী নারী, শিশু ও যুবককে আহত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামনে বর্বরতার আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ইসরাইল। তবে হত্যাকান্ডের ভয় দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের আন্তনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে গত ৭০ বছরেও দমিয়ে রাখা যায়নি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের শক্তি ইসরাইলের সামরিক আধিপত্যের গর্বকে ¤øান করে দিয়েছে বার বার। ইসরাইলী বর্বরতার বিরুদ্ধে পাথর-গুলতি নিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে হামাস হেজবুল্লাহর মত অকুতোভয় মিলিশিয়া বাহিনী ক্রমেই দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে এই দুই মিলিশিয়া বাহিনীর কাছে অন্তত দুইবার গøানীকর পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও চৌকষ বাহিনীর দাবীদার আইডিএফ। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্প্রসারণবাদি আগ্রাসী নীতির কারণে গত ৭০ বছরেও ইসরাইল তার প্রতিবেশীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের উপর সর্বাত্মক অবরোধ ও বার বার সামরিক হামলা চালিয়েও তাদের প্রতিবাদের শক্তি নি:শেষ করতে পারেনি। বরং তাদের প্রদিবাদি চেতনা ও আত্মদানের শক্তি ইসরাইলের জায়নবাদি শক্তিকে রাজনৈতিক-ক‚টনৈতিকভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। উপরন্তু হামাস-হেজবুল্লাহর শক্তি ও সক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধি এখন ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুভ’মি দখল করতে সক্ষম হলেও সংগ্রামী যোদ্ধা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রনের সংগ্রামকে একদিনের জন্যও স্তব্ধ করে দেয়া যায়নি। ইসরাইলের নিরাপত্তা ও সামরিক সমৃদ্ধির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার বরাদ্দ দিলেও উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই করেনি। উপরন্তু যখন তখন সামরিক আগ্রাসন, বছরের পর বছর ধরে স্থল, নৌ ও বিমানপথে অবরোধ সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অচল করে দিয়ে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার জায়নবাদি তৎপরতায় শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিনীরা। ইসরাইলের মানবতা বিরোধি কর্মকান্ড বিশ্বসম্প্রদায় মেনে নিচ্ছেনা, একইভাবে ইসরাইলের এসব অপকর্মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা এখন তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও সমর্থন করছেনা। ভ‚মি দিবসের সমাবেশে ইসরাইলের ¯œাইপার হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির হতাহতের ঘটনায় সারাবিশ্ব বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনীদের নিরাপত্তার প্রশ্নে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবের পক্ষে নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রায় সব সদস্যের সমর্থন পাওয়া গেলেও একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। কুয়েতের আনা প্রস্তাবের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের ১০ সদস্য রাষ্ট্র ভোট দিয়েছে ৪টি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে এবং একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের এই ভোটাভুটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে হিউমিলিয়েশন বা তাদের ক‚টনৈতিক লজ্জা বলে ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ইসরাইলী ¯œাইপারদের দেড়শতাধিক ফিলিস্তিনীর মৃত্যু এবং ১২ হাজারের বেশী আহত হওয়ার পর বেসামরিক ফিলিস্তিনীদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রস্তাবকে জাতিসংঘের ইসরাইল বিরোধি ও পক্ষপাতমূলক অবস্থান বলে গলাবাজি করেছেন জাতিসংঘের নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি।
মার্কিনীদের অন্ধ ইসরাইল প্রেম দুইরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের পথে প্রধান অন্তরায়। যদিও জবরদস্তিমূলকভাবে গড়ে ওঠা ইসরাইলের অস্তিত্ব অনেক আরব এবং মুসলমানরা মেনে নিতে রাজি নন। দুই রাষ্ট্রের সমাধান মেনে নিয়ে খোদ ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছিল। তবে সম্প্রতি মাহমুদ আব্বাসের দল ইসরাইলের স্বীকৃতি স্থগিত ঘোষনা করেছে। জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই দুই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের সার্বজনীন স্বীকৃত পথ স্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে দেয়ার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করেছে। এ কথা মার্কিন নীতি নির্ধারকরা ভাল করেই জানেন যে, জেরুজালেমের উপর মুসলমানদের ঐতিহাসিক অধিকারের প্রশ্নটির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি, স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে বিশ্বসম্প্রদায়ের অবস্থান এখনো অটুট রয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন শুধু ফিলিস্তিন সংকটকেই জটিল তোলেনি, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলের একমাত্র পন্থা হিসেবে ইসরাইলের নীলনকশা বাস্তবায়নে একটি বড় আকারের যুদ্ধবাদি নীতি গ্রহণ করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কেবিনেটে ইতিমধ্যে কুখ্যাত যুদ্ধবাদি ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই সেক্রেটারী অব স্টেটের দায়িত্ব থেকে অপেক্ষাকৃত উদার রেক্স টিলারসনকে সরিয়ে চরম মুসলিমবিদ্বেষী মাইক পম্পেইকে বসিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বসিয়েছেন বুশের যুদ্ধবাদি প্রশাসনের অন্যতম হোঁতা জন বোল্টনকে। আর বোল্টন সম্প্রতি ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাফ হিসেবে সাবেক বুশ প্রশাসনে তার আন্ডার সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করা ফ্রেড ফেলিজ্বকে নিয়োগ দিয়েছেন। একজন ইসলামোফোব বা ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে ফ্রেড ফেলিজ সমধিক পরিচিত। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত নিকি হ্যালিও ইতিমধ্যে ইসরাইলের পুতুল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। অর্থাৎ হবুচন্দ্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনে জায়নবাদি, মুসলিমবিদ্বেষী ও যুদ্ধবাদী গবুচন্দ্রদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে কার্যত একটি মুসলিমবিদ্বেষী ওয়ার কেবিনেট গড়ে তুলেছেন। তারা এখন সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ’র পুরনো পরিকল্পনার ব্যর্থতার ক্ষতের উপর নতুন যুদ্ধের প্রলেপ দিতে শুরু করেছে। সেই সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং বেসামরিক ফিলিস্তিনীদের নিরাপত্তার যে কোন সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, লেবানন, লিবিয়া ও আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত সংঘাত, যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতার আগুন জ্বালিয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পুরনো কৌশল এখন কাজ করবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেক ক্ষেত্রে বৈরিতা ও মতপার্থক্য সত্বেও গত কয়েক মাসে ওআইসি ও আরবলীগের মত সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিন প্রশ্নে বেশকিছু ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশ পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনে প্রতিবেশীদের সাথে বৈরিতা ও অনাস্থাপূর্ণ আচরণ করছে। তাদের হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পারমানবিক শক্তি ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য কোন রকম হুমকি হয়ে দাড়ায়নি। উপরন্তু তাদের সমরশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য সহায়ক না হয়ে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে। ইয়েমেন এবং কাতার হচ্ছে সাম্প্রতিক উদাহরণ। বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলমান এবং বাকি দুনিয়ার বেশীরভাগ মানুষের সমর্থনপুষ্ট ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য আঞ্চলিক বিরোধ ভুলে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশকে একটি একক ইসরাইল বিরোধি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলতে হবে।এবারের আল কুদস দিবস উপলক্ষ্যে বিশ্বমুসলমানের মধ্যে এই প্রত্যাশা অনেক বেশী প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মার্কিন প্রেসক্রিপশন ছেড়ে নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হলে বিশ্বের সব পরাশক্তি তাদেরকে সমীহ করতে বাধ্য হবে।
[email protected]



 

Show all comments
  • বুলবুল আহমেদ ৬ জুন, ২০১৮, ২:৪৭ এএম says : 0
    লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো
    Total Reply(0) Reply
  • মাহবুব ৬ জুন, ২০১৮, ১১:৫৮ পিএম says : 0
    এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন এহেন অবস্থায় আমাদের করণীয় কি হতে পারে,তা নিয়ে ইতিমধ্যে যে প্রচেষ্টার তালিকা লক্ষনীয়,তা সফলতার স্তরে নিয়ে যাবার জন্য যে দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন,তার সংকট বিদ্যমান।এ সংকট পূরনে এক্যবদ্ধতা দক্ষতার অভাব আংশিক পূরন করবে কিন্তু সে এক্যও সুদূরপরাহত।এমন জটিল অবস্থায় উগ্রতার সৃষ্টিকে যারা কঠোর হস্তে দমন করতে চান ,তারা সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করছেন না।বরং উগ্রতা সৃষ্টির সহায়ক ক্ষত নিরাময়ে মলম প্রদানই কার্যকর ও টেকসই একমাত্র সমাধান।যে সত্যকথা সাবেক চীনা প্রেসিডেন্ট হূ জিনতাও পাকিস্তান সফরে বলেছিলেন---"জঙ্গীবাদের কারণ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে"। অথচ আমরা এ কথা বললে তা নিয়ে বিশ্লষণ না করেই জঙ্গীবাদের প্রতি সহানুভূতিশীলতার অপবাদ দেওয়া হয়।এটা কত বড় জ্ঞানদৈন্যতা ভবিষ্যত পৃথিবীর ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ থাকবে।আমরা আন্যায়ভাবে একটি প্রাণি হত্যাও অপছন্দ ও ঘৃণা করি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মধ্যপ্রাচ্য


আরও
আরও পড়ুন