চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ই‘তিকাফ। অবস্থান করা, নিজেকে আটকিয়ে রাখা, নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ রাখা। ইংরেজিতে Staying in the Mosque. জমহুর উলামায়ে কেরামগণের মতে, ‘মসজিদে কোনো বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ ধরণের অবস্থানকে ই‘তিকাফ বলে’। কুদুরী প্রণেতার মতে, ‘ই‘তিকাফের নিয়তে রোজা সহকারে মসজিদে অবস্থান করার নাম ই‘তিকাফ’। ই‘তিকাফ বিভিন্ন ধরণের। ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব। কেউ যদি ই‘তিকাফের মান্নত করে তাহলে সেই ই‘তিকাফ করা ওয়াজিব। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, একদা হজরত উমর (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, বললেন, আমি জাহেলিয়া যুগে মাসজিদে হারামে একরাত ই‘তিকাফ করার মান্নত করেছিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার মান্নত পূর্ণ কর’ -(বোখারী ও মুসলীম)। রামাদ্বান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করা সুন্নাত। যা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, রামাদ্বানের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। এছাড়া যত ধরণের ই‘তিকাফ আছে সবগুলো মুস্তাহাবের অন্তর্ভূক্ত। ওয়াজিব ই‘তিকাফের জন্য যে কয়দিন মান্নত করা হয় সে কয়দিন পালন করা ওয়াজিব। রামাদ্বান মাসের শেষ দশকে অর্থাৎ বিশ রামাদ্বান সূর্যাস্তের পূর্ব হতে রামাদ্বানের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত অবস্থান করা সুন্নাত। মুস্তাহাব ই‘তিকাফের ক্ষেত্রে নিম্নতম সময় হলো একদিন এক রাত, যা হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতানুসারে জানা যায়। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক (রহ.) এবং শায়খাইন এর মতানুসারে সকল প্রকার ই‘তিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত।
কখন ই‘তিকাফ শুরু করতে হবে তা নিয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম চতুষ্টয় তথা ইমাম হজরত আবু হানিফা, হজরত ইমাম মালেক, হজরত ইমাম আহমদ এবং হজরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.) গণের মতানুসারে, রামাদ্বানের একুশ তারিখ রাতের পূর্বে অর্থাৎ বিশ তারিখ দিন শেষে সূর্যাস্থের পূর্বে ই‘তিকাফে প্রবেশ করবে। আর হজরত সুফিয়ান সাওরী, হজরত আওযায়ী এবং হজরত আল্ লাইস (রহ.) গণের মতে, ই‘তিকাফ শুরু করতে হয় রামাদ্বানের বিশ তারিখ ফজর থেকে। উল্লেখ্য যে, রামাদ্বানের ই‘তিকাফের জন্য জামে’ মসজিদ শর্ত। হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ই‘তিকাফ করতেন, মসজিদে তাঁর জন্য বিছানা পাতা হতো অথবা তাওবার খুটিঁর পিছনে তাঁর জন্য খাটিয়া স্থাপন করা হতো’ -(ইবনে মাজাহ্)। অন্য হাদীসের মাধ্যমেও বোধগম্য হয় যে, তিনি মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন। ‘হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ই‘তিকাফ করতেন তিনি মসজিদ থেকে তাঁর শির মোবারক আমার দিকে এগিয়ে দিতেন আর আমি তা আঁচড়িয়ে দিতাম। তিনি মানবীয় প্রয়োজন ব্যতীত কখনো ঘরে ঢুকতেন না’ -(বোখারী ও মুসলীম)।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদ্বানের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদ্বানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন যাবৎ না আল্লাহ তাআলা তাকে উঠিয়ে নিলেন। তাঁর পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীগণ (উম্মাহাতুল মু’মিনীনগণ) ই‘তিকাফ করেছেন’ -(বোখারী ও মুসলীম)। অন্য হাদীসে এসেছে, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে প্রত্যেক বছর রামাদ্বানে একবার কোরআন পাঠ করা হতো। যে বছর তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হলো সে বছর রামাদ্বানে তাঁর নিকট দু’বার পাঠ করা হয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক বছর দশদিন ই‘তিকাফ করতেন, যে বছর তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হলো সে বছর তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন’ -(বোখারী)। আরও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদ্বানের শেষ দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। এক বছর তিনি ই‘তিকাফ করতে পারলেন না। অতঃপর যখন পরবর্তী বছর আসল তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ করলেন’ -(তিরমিজি, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ্)। হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ই‘তিকাফ করা অধিক গুরুত্ববহ। তাই ই‘তিকাফকে কোনভাবে কম গুরুত্ব দেয়া সমীচীন হবে না।
ই‘তিকাফ অবস্থায় বিভিন্ন ধরণের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ই‘তিকাফকারীর পক্ষে এ সুন্নাত পালন করা আবশ্যক- সে কোন রোগীকে দেখতে যাবে না, জানাজার নামাজে হাজির হবে না, স্ত্রী সহবাস করবে না এবং তার সাথে মেলামেশাও করবে না। যা না হলেই নয় এমন প্রয়োজন ব্যতীত কোন প্রয়োজনে বের হবে না। রোজা ব্যতীত ই‘তিকাফ হয় না এবং জামে’ মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ হয় না’ -(আবু দাউদ)।
ই‘তিকাফ অনেক গুরুত্ববহ। যার মাধ্যমে মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল ক্বদরকে খোঁজা হয়। যে রাত হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। এর চেয়ে আর অধিক মর্যাদার কি হতে পারে? এরপরও হাদীসের বাণী, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই‘তিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে ব্যক্তি গুণাহসমূহ হতে বিরত থাকে এবং তার জন্য নেকসমূহ লেখা হয় ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে বাইরে থেকে যাবতীয় নেক কাজ করে’ -(ইবনে মাজাহ)। মহান আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে ই‘তিকাফ করার এবং তার সাওয়াব অর্জনের তাওফিক প্রদান করেন। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।