Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রফতানি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে

মো. মাঈনউদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আয়তনে ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলেও বাংলাদেশের অনেক সম্পদ রয়েছে। রয়েছে জনসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ। কৃষি এখনও আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। আছে পোশাকশিল্প, মৎস্য খাত, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রকৌশলী পণ্য, হোমটেক্সটাইলসহ প্রায় সাত শতাধিক ছোট-বড় পণ্য। এসব পণ্য আমরা বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত আমাদের জনশক্তি থেকেও রেমিট্যান্স আহরিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশ থেকে কাক্সিক্ষত হারে রফতানি হচ্ছে না। ও দিকে মে ২০২২ থেকে চলছে ডলারের বাজারের অস্থিরতা। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় দিয়ে ডলারের চাহিদা মিটছে না। এছাড়া প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিদেশি বিল পরিশোধ, জাহাজ ও বিমান ভাড়া, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ মিটানো, সরকারি ও বেসরকারি বিল পরিশোধসহ আয় ও নানা খাতে ডলারের খরচ। ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। আবার চলতি বছরে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ শোধ দিতে হবে। তাই সংকট মোকাবেলায় রফতানি আয় বড়ানো পদক্ষেপ ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির প্রতি জোর দিতে হবে। হুন্ডির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে বৈধ পথে রেমিটেন্স দেশে আনতে হবে।

বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে হয়েছে ৩৭০৬ কোটি ডলার। যেখানে সর্বোচ্চ মজুত উঠেছিল ৪৮০০ কোটি ডলার। বিশ্ব অর্থনীতির টাল মাটাল অবস্থায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরে ২০২২-২৩ এ ৫ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য এবং ৯০০ কোটি ডলারের সেবাপণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ সালে মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১ শত কোটি ডলার। বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি ডলারেরও কিছু বেশি। ২০২০ -২১ অর্থ বছরে রফতানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পণ্যকে গ্রহণ করার জন্য কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানিমুখী সব পণ্যের রফতানি বাড়ানো যেতে পারে। এই জন্যই সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের বিকল্প নেই। বর্তমানে আমাদের রফতানি আয় আটকে আছে মাত্র ৭ বা ৮টি পণ্যের মাঝে। সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগের পরও রফতানি আয় নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে থমকে আছে। রফতানিতে প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ওভেন-নিট ওয়্যার নিরঙ্কুশ অবস্থানে আছে। পোশাক খাতে নিট ও ওভেন থেকেই আসে মোট রফতানির ৮১ শতাংশ। রফতানিতে হোম টেক্সটাইলের অংশ ৩.১১ শতাংশ। অর্থাৎ মোট রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। রফতানিতে প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাট জাত পণ্য, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য ইত্যাদি। রফতানি আয় আরও বাড়াতে হলে শুধু পোশাক খাতের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ। এইসব দেশেও ভোক্তারা বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এতে দোকানগুলোতেও পোশাক বিক্রি কমে যাচ্ছে। বিজিএমই’র এক পরিচালকের মতে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে। নতুন ক্রয়াদেশ কম আসছে। তাই রফতানি আয় বাড়াতে হলে অন্যান্য রফতানি পণ্য যেমন, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও পাট ও পাটজাত পণ্যসহ রফতানিযোগ্য পণ্য সংখ্যা বাড়ানো ও রফতানি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের রফতানির নীতি ও কাঠামোতেও যেসব সমস্যা আছে তা দূর করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমরা ব্যাপক হারে পণ্য আমদানি করি, কিন্তু রফতানি করি মাত্র হাতেগণা কিছু পণ্য। ফলে ভারতের সাথে আমাদের আমদানি ও রফতানি ব্যবধান অনেক। এই ব্যবধান দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিগত বছরগুলোতে ভারতে রফতানি বৃদ্ধি পেলেও তা সম্ভাবনা অনুযায়ী খুবই কম। এই ক্ষেত্রে কিছু শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। এগুলো যদি দূর করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি কয়েকগুণ বাড়বে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের ধরন এবং বাণিজ্যের যে উপায় অর্থাৎ নদী ও স্থল বন্দরের কাঠামোগত অবকাঠামো অবস্থা অনেক দুর্বল। এটাও রফতানি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। তবে গার্মেন্ট সেক্টরের বাংলাদেশ ভারত থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি করে তা যথাযথ ব্যবহার করে রফতানি করে যাচ্ছে। এই রফতানির পরিমাণও বাড়ানো সম্ভব। তথ্য ও প্রযুক্তি প্রসারের কারণে পোশাক শ্রমিকদের দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। পোশাক খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। শ্রমিকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তি ও কর্ম কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে রফতানিতে সক্ষমতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এস এন্ড পি গ্লোবাল রেটিংস বাংলাদেশের ঋণমান প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ঋণমান নির্ণয় করা হয়েছে দীর্ঘ মেয়াদে বিবি মাইনাস ও স্বল্প মেয়াদের জন্য বি। দীর্ঘ সময় ধরে যদি পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে, আমদানি চাহিদা বাড়তে থাকে তাহলে টাকার আরো অবমূল্যায়ন হতে পারে। ফলে অর্থনীতি বহিঃস্থ খাতের আরও অবনতি হতে পারে। এসব বিষয় চিন্তা করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে রফতানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আধুনিক যুগে জাতীয় উন্নয়ন প্রশ্নে উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকতে পারে না । উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক খাত, যা ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়ে চলছে। এই সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি জনশক্তি কাজ করছে। এতে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসার কথা তা আসছে না। কারণ, প্রবাসে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির অভাব। দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠির। আবার কারখানার মালিকরাও দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও উন্নয়ন স্তিমিত হয়ে আসছে। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিকল্প নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি হাতে কলমে শিখানো, বাস্তবিক অর্থে আধুনিক মেশিন তৈরি করা, চালানো, জীবন ও প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার ও এর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার শিখতে পারে। দক্ষ শ্রমিক থাকলে কারখানার উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। ফলে শ্রমিকের মজুরী মালিক পক্ষ বাড়াতে বাধ্য হবে। দক্ষ শ্রমিক ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আমাদের রফতানি পণ্য যদি মান সম্পন্ন হয় ও সঠিক সময়ে জোগান দেওয়া যায় তাহলে সুনামও বৃদ্ধি পাবে, রফতানি আরো বৃদ্ধির পথ সুগম হবে। বর্তমান সংকট মোকাবেলায় শুধু কৃচ্ছ্রসাধন করলে হবে না, পরিকল্পিত ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রফতানি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে
আরও পড়ুন