Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজনীতিবিদদের মানবিক চেতনার অধিকারী হতে হবে

ড. আব্দুল হাই তালুকদার | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ২:৪৯ পিএম, ১৩ মে, ২০১৮

দেশের রাজনীতি হতে হবে সর্বোৎকৃষ্ট নীতি দ্বারা পরিচালিত। উদার, সহনশীল ও মানব কল্যাণমুখী নীতি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। রাজনীতিকরা জনগণের কল্যাণের সাথে নিজের কল্যাণকে অভিন্ন জ্ঞান করবেন না। জনগণের পকেট মেরে নিজের পকেট ভরাকে আর যাই বলা হোক, রাজনীতি বলা যায় না। এরকম পকেট ভরানোকে রাজনীতি না বলে কুনীতি বা কুকাম বলা যায়। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিক কখোনই নিজের সুখকে প্রাধান্য দিবেন না। তার কর্মকান্ড মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সদা আবর্তিত হবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধিতে নিয়োজিত থাকলে তাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে দোষী হতে হবে। ভোট নেবার সময় একজন রাজনীতিক নানারকম চটকদার ও আকর্ষণীয় ওয়াদা দেন, দলীয় ইস্তেহার জনকল্যাণমুখী অবাস্তব প্রতিশ্রুতি  দেয়া রাজনৈতিক দলের অভ্যাস। বাস্তবে দেখা যায়, জনকল্যাণের চেয়ে নিজের কল্যাণে বেশি মনোযোগী ও তৎপর। জনসেবার বদলে নিজ ও গোষ্ঠিসেবায় এ দেশের রাজনীতিকরা সদা ব্যস্ত থাকেন। নির্বাচনের সময় দেয়া সুন্দর সুন্দর কথাগুলো ভুলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধিতে ব্যস্ত থাকেন। পাঁচ বছরে দেখা যায় মন্ত্রী, এমপি ও তাদের অনুসারীদের সম্পদ বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে হয়। সম্পদ বৃদ্ধির কারণ দেখাতে গিয়ে মাছ চাষ, চিংড়ি ঘের, লবণ চাষ প্রভৃতি খাত দেখানো হয়। কারও কারও সম্পদ বৃদ্ধি ৫ গুণ ১০ গুণ ১০০ গুণ ৫০০ গুণ পর্যন্ত ঘটে। রাজনীতিকদের মান সাংঘাতিকভাবে ধসে পড়েছে। তারা আর নীতির ধার ধারেন না। এটিকে সেবামূলক কর্ম না ভেবে, সম্পদ আহরণের ব্যবসা হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নীতি, নৈতিকতা, উচিত-অনুচিত শব্দগুলো নির্বাসিত হয়েছে। দীর্ঘ ৪৬ বছরে আমরা একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। রাজনীতিকদের কর্মকান্ড দেখে যুবসমাজ পর্যন্ত রোগাক্রান্ত হয়েছে। অনেক ছাত্র অতি অল্প সময়ে কোটিপতি হয়েছে বলে শোনা যায়। বিনা পরিশ্রমে কোটিপতি হবার লোভে ছাত্রনেতারা লেখাপড়া শিকেয় তুলে রেখে, বাণিজ্যে নেমে পড়েছে। ধান্দা করে তারা অনেকে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে, তা দেখে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়ে একই কাজে জড়িয়ে পড়েছে। সুনীতি, সুবচন তাদের কাছে তিতো লাগে, বরং টাকা উপার্জনের পথগুলো সকলে আকঁড়ে ধরতে চায়। ফলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা এবং তা থেকে কলহ, বিবাদ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি ও দলীয় কুন্দলে শত শত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। অকালে ঝরে যাওয়া যুবকদের জন্য দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। আমাদের যেখানে দুঃখ-কষ্ট হয়, তাদের পিতামাতার কথা একবার ভাবুন। এক বুক আশা নিয়ে ছেলেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে পিতা-মাতা ভাবেন ছেলে মানুষ হয়ে ফিরে এলে তাদের দুঃখ-কষ্টের অবসান হবে। মানুষ হয়ে ফেরার বদলে যখন লাশ হয়ে ফিরে, তখন তাদের দুঃখের কথা ভাবুন। এ ব্যধিগ্রস্ত কলুষিত রাজনীতিকে তারা লাথি মারে, অভিসম্পাত দেয়। রাজনীতির শিকার এসব তরুণ যুবক নিজেদের ভালো-মন্দও বোঝে না। লেখাপড়া বাদ দিয়ে টাকা বানাতে গিয়ে অকালে ঝড়ে পড়ছে। 

রাজনীতিকদের সম্পদ লিপ্সা ও ক্ষমতালিপ্সা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ব্যধিগস্ত, জরাগ্রস্ত ও পঙ্গু করে ফেলেছে। নিজ স্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে পরিচালিত রাজনীতিকরা জনগণের বদলে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। কী করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যাবে, কী করে মালয়েশিয়া বা ইউরোপ আমেরিকায় সেকেন্ড হোম বানানো যাবে তার প্রতিযোগিতায় রাজনীতিকরা ব্যস্ত। রাজনীতিকে পরিশীলিত ও জনপ্রিয় করার কোন তাগিদ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ যাবৎ কোন সরকার কমিশনার নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি। নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশলে ব্যস্ত হয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ক্ষমতা পেলে আর ছাড়তে চায় না। জনগণের মর্জির উপর নির্ভর না করে পেশীশক্তি ও চাতুর্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ায় সরকার নিজের বিদায়কে নিষ্কণ্টক ও বিপদমুক্ত ভাবতে পারে না। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার জনগণের ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভর করে বলে সেসব দেশে নির্বাচনে হাঙ্গামা, মারামারি, খুন খারাবি ঘটে না। আমাদের দেশের সরকার নির্বাচনে জোর করে বিজয়ী হতে চাওয়ায় অসংখ্য গরীব নিরীহ ও বোকা মানুষ জীবন দেয়। গত ইউপি নির্বাচনে দলীয় মার্কায় নির্বাচন করায় শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু কমিশনার নিয়োগের নীতিমালা করা হয়নি তাই নয়, সাংবিধানিক পদে নিয়োগের নীতিমালা না থাকায় সরকার দলীয় আনুগত্যশীল লোকদের নিয়োগ দিয়ে দলীয় শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যস্ত। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হলো বিচার বিভাগ। বিচারপতিদের নিয়োগের নীতিমালার অভাবে অনেকক্ষেত্রে পদের অনুপযুক্ত লোককে নিয়োগ দিয়ে বিচারবিভাগকে পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ভিসি, প্রভিসি পদে দলীয় লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে গত ন’বছরে প্রায় ৫০০ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কত ভালো রেজাল্টধারী প্রার্থী বাদ দিয়ে অতি সাধারণ মানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েও কিন্তু কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। ৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে বিশ^বিদ্যালয় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শিক্ষকদের কর্তৃক নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি দিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব অথরিটি নির্বাচনে ভিসি সাহেব পছন্দের লোককে নির্বাচিত করে নিয়ে নির্বিঘেœ নিশ্চিন্তে প্রশাসন পরিচালনা করতে চান। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা সহজ হয়। হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ। গত ২৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট, সিনেট, একাডেমিক কাউন্সিল, প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট এবং শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াসী শিক্ষক গ্রæপ সিন্ডিকেটে ৫টি পদের প্রভাষক পদে কোন প্রার্থী দিতে পারেনি। এমনভাবে দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যে, সাদা দলে কোন প্রভাষক নেই অর্থাৎ এ ন’বছরে বিএনপিমনা কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন দেবার জন্য ভিসি সাহেবের নিকট প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দল আমার মেয়ের নাম জমা দেয়। প্রাধ্যক্ষ হিসেবে ভিসি সাহেব নিয়োগ দিলে দল তাকে প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগারিতে সিন্ডিকেটে মনোনয়ন দিবে। ভিসি সাহেব আমার মেয়েকে নিয়োগ দিতে অস্বীকার করেন। ফলে দল তাকে মনোনয়ন দিতে পারেনি। আমার মেয়ে সম্পর্কে আগেও বলেছি। এই মেয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে। বিএ অনার্স ও এমএ উভয় পরীক্ষায় ১ম শ্রেণি প্রাপ্ত হয়েও আ.লীগের সময় তার চাকরি হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তার চাকরি হয়েছে। বর্তমানে সে প্রফেসর হিসেবে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত। দ্বিতীয় মেয়াদে আ.লীগের সময় বর্তমান ভিসির সময় তার পেরেন্ট ডিপার্টমেন্ট মনোবিজ্ঞান ৭/৮ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। আমার মেয়ে বিভাগে যাবার জন্য আবেদন করে। কিন্তু চৌকস তুখড় ছাত্র বর্তমান প্রশাসন চায় না। আমার মেয়ের চেয়ে অনেক নি¤œমানের শিক্ষক নিয়োগ দিলেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। দলীয়করণে জর্জরিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল তাতে দেখা গেল মেধাবী ও গুণসম্পন্ন শিক্ষকরা ভুল করেননি। ৭টি ক্যাটাগরিতে ৭০টি পদের বিপরীতে রবীন্দ্র গ্রুপ কয়েকটি পদ বেশি পেলেও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সাদা দল পেয়েছে। সিনেটে ৩৩টি পদের মধ্যে সাদা দল পেয়েছে ১৯টি। শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পদ পেয়েছে সাদা দল। নীল দল কেবল যুগ্ম-সম্পাদক ও ৮টি সদস্য পদ পেয়েছে। ৯টি অনুষদের ডিনের মধ্যে সাদা দল ৪টি ডিন পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সর্বোচ্চ কার্যকর বডি হলো সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটে ৫টি পদের মধ্যে প্রভাষক পদে তো সাদা দল প্রার্থী দিতে পারেনি। বাকী ৪টির মধ্যে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগরিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সাদা দল পেয়েছে। মাত্র ১টি সহকারী অধ্যাপক পদটি হলুদ প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিবেক এখনও ভোঁতা হয়ে যায়নি। চোখের সামনে এত অন্যায়, অবিচার ও শিক্ষা বিধ্বংসী কর্মকান্ড দেখে গুণী শিক্ষকরা প্রতিপাদমুখর হয়ে নিরবে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এ সরকারের আমলে এত উৎকট দলীয়করণ ও অনিয়ম হচ্ছে যে, শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রশ্ন ফাঁস ও পাতাগুনে নম্বর দেবার নির্দেশনা শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছে। শিক্ষার গুণগতমান এতটা নি¤œগামী যে, এ জাতি বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দেহ। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তামাশা বন্ধ না হলে, দক্ষ ও যোগ্য লোকের হাতে নেতৃত্ব দেয়া না গেলে, এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অচিরেই ধ্বংস হবে। শিক্ষামন্ত্রী যেন এ ব্যবস্থা ধ্বংসের লাইসেন্স পেয়েছেন। চোখের সামনে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া দেখে পরীক্ষা বন্ধ না করে, চালিয়ে যাওয়ায় অবাক ও বিস্মিত হতে হয়। নিচের স্তরের লেখাপড়া ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান বজায় রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাঁধ সেধেছে বিশ্রী রাজনীতি ও উৎকট দলীয়করণ। আগেই বলেছি, রাজনীতির শিকার হয়ে বহু শিক্ষার্থী অকালে জীবন দিচ্ছে। উৎকট দলীয়করণে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মান বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগের বদলে দলীয় সদস্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে।
সরকার দেশের ভালোমন্দ বা ভবিষ্যত চিন্তা করে কাজ করছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা সরকারকে বিচলিত করে রেখেছে। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী অপবাদ ঘুঁচাতে সুন্দর পরিবেশে সমতল মাঠে সকল দলকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই করা যেতে পারে। রাবি নির্বাচন, সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, সরকারি দলের পরাজয় ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ এসব নির্বাচনে কারচুপি, জালিয়াতি ও ফল পালটানোর কোন সুযোগ নেই। শিক্ষিত, ভদ্র ও বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষগুলো সরকারের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করেছেন এসব নির্বাচনে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যেকোন স্থানীয় নির্বাচনে সরকার চাইলেই বিজয়ী হতে পারবে। যার প্রমাণ উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, ইউপি নির্বাচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারি দলের ভ‚মিধস বিজয়। ঢাকা, চিটাগাং সিটি নির্বাচনে মানুষ দেখেছে কীভাবে বিরোধী দলের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া যায়। আমাদের কথা হলো, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিন। বর্তমানে সরকারের ক্ষমতায় থাকায় প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, তারা আর একবার পরীক্ষামূলক হলেও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনে আগ্রহী। তারা সকল রকম যুক্তি, উপদেশ ও পরামর্শ আগ্রাহ্য করে একগুঁয়েমীভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মতো একটি জনসম্পৃক্ত দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার নানা অপকৌশল অবলম্বন করছে। বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে, সেকারণে কোনরকম আলোচনা বা সংলাপ আয়োজন না করে বিএনপিকে কোণঠাসা করার কৌশল অবলম্বন করছে। সাজানো, গোছানো ও ঘষামাজা কাগজপত্র দিয়ে ফরমায়েশী রায় নিয়ে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনকে জেলে পুরে রেখেছে। বলা হচ্ছে, আদালত রায় দিয়েছে আমরা কী করব? কথা হলো, জামিন দিতে তো আদালত বাধা দিচ্ছে না। বলতে গেলে অতি অল্প সময়ে হাইকোর্ট বেগম জিয়াকে ৪ মাসের জামিন দিয়েছেন। মানুষ আদালতের কর্মকান্ডে খুশি হতে না হতেই চেম্বার জজ স্থগিত না করে সুপ্রিমকোর্টে পাঠিয়ে দেন। সুপ্রিমকোর্ট জামিনের বদলে লিভটু আপিল গ্রহণ করে দীর্ঘ সময় দিয়ে শুনানীর তারিখ ঘোষণা করেন। সবই নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারের বিরোধিতা না থাকলে ৭ দিনের মধ্যে বেগম জিয়া জামিনে বেরিয়ে আসতেন। এরূপ ক্ষেত্রে জামিন পাবার অনেক উদাহরণ বাংলাদেশের আইন-আদালতে আছে। সাজা বহাল থাকা অবস্থায় মন্ত্রিত্ব করছেন, এদেশের মানুষ তাও প্রত্যক্ষ করছে। শুধু আপত্তি খালেদা জিয়াকে নিয়ে। আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, বেগম জিয়াকে ভুঁয়া, বানোয়াট মিথ্যা মামলায় রায় নিয়ে জোর করে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। ইদানীং অনেক জ্ঞানী, গুণী, বিশিষ্ট রাজনীতিক এ মামলা নিয়ে অনেক কটাক্ষ করে মামলাটি যে সাজা দেবার উপযুক্ত নয় সে বিষয়ে মন্তব্য করছেন। বেগম জিয়া ষড়যন্ত্রের শিকার। তাকে বন্দি রেখে যেনতেনভাবে নির্বাচন এবার আর সম্ভব হবে না। কিন্তু দেশবাসীর সাথে সারা বিশ^ একটি ভালো নির্বাচন দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। সরকার নগ্নভাবে মামলা-হামলা করে বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখার নীতি অবলম্বন করেছে, তাতে মনে হচ্ছে এবারও সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার অলীক স্বপ্ন দেখছে। বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে, যেসব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে তা প্রবল পুলিশী বাধায় পড়ে পন্ড করার কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর জুলুম নির্যাতন, মামলা, হামলা, গুম, খুন অপহরণ চলছে। এর অবসান কাম্য। সরকারের উচিত জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখানো। জনগণ শান্তি, নিরাপত্তা, আইনের শাসন ও নিজেদের মর্যাদা চায়।
ড. কামাল হোসেনের কথায় বলতে চাই, দেশের জনগণ ছাগল বা বোকা নয়। ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে রাস্তায় নামছে না। তার মানে এই নয়, তারা, কখনোই রাস্তায় নেমে আসবে না। অন্ধকার যতই ঘনীভূত হয়, আলো ততই এগিয়ে আসে। জনসমর্থন ছাড়া গায়ের জোরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইলে পরিণতি শুভ হয় না। স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতি আমরা অনেক প্রত্যক্ষ করেছি। রুশ বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব, যুগান্তকারী ঘটনা। এসব ঘটনা অতি অল্প কয়েকদিনের সংঘটিত হয়েছে। ফরাসী স¤্রাট, রাশিয়ার জার-এর পরাজয় ও করুণ অবস্থা চিন্তা করলে বোঝা যায়, শাসক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জনগণের ক্ষমতার কাছে অতিতুচ্ছ। স্বৈরাচারী এরশাদের কথাই ধরুন। এদেশের ছাত্রজনতা মাত্র কয়েকদিনেই তার করুণ পরিণতি ঘটিয়েছে। আমাদের কথা হলো, অনেক হয়েছে, এখন ইতি টানুন। রাজনীতিকে নীতির রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কার্যকর উদ্যোগ নিন। রাজনীতিকরা হবে জনগণের সেবক ও বন্ধু। তারা হবেন উদার, সহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর ক্ষমতা ছেড়ে দিন। জনগণকে বিশেষ করে তরুণ ও যুব সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে দেশকে সর্বগ্রাসী সংকট থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব কেবল বেগম জিয়া ও বিএনপির নয়। এ দেশ আমার আপনার সকলের। তাই দেশকে বাঁচাতে ও গণতন্ত্র ফেরাতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে তরুণ সমাজকে নেতৃত্ব দেবার আহবান জানাচ্ছি।

লেখক: প্রফেসর (অব.) দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন