Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাহাথির মোহাম্মদের অনন্য বিজয়

| প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বকে চমকে দিয়ে পুনরায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হলেন। মালয়েশিয়াকে সমৃদ্ধির কক্ষপথে তুলে দিয়ে যিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই তিনিই দেশের প্রয়োজনে পুনরায় ফিরে এসেছেন। এটা কল্পনাও করা যায় না যে, ৯২ বছর বয়সে কেউ নির্বাচিত হয়ে দেশের সরকারপ্রধান হবেন। মাহাথির মোহাম্মদ হয়েছেন। তিনিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক সরকারপ্রধান। আগামী জুনে তিনি ৯৩-তে পা দেবেন। গত বুধবার মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান (আশার জোট) ২২২ আসনের মধ্যে জয়লাভ করে ১১৩টিতে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল জোট পেয়েছে ৭৯টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১১২টি আসন। গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এক সংবাদ সম্মেলনে নাজিব রাজাক তার পরাজয়কে ‘জনগণের রায়’ বলে মেনে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া শেষে মাহাথির মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই না, আমরা শুধু আইনের শাসন পুনর্বহাল করতে চাই। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের জন্য আমরা নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করব না। তিনি প্রতিশ্রæতি দিয়ে বলেছেন, দুই বছর পর ক্ষমতা আর কারও হাতে তুলে দেবেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেশটিতে ক্ষমতায় ছিল রাজনৈতিক জোট ইউনাইটেড মালয়িজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) বা বারিশান ন্যাশনাল। ৬০ বছরেরর বেশি সময় ধরে এই জোট মালয়েশিয়া শাসন করেছে। এবারই প্রথম পরাজয়ের শিকার হয়েছে। মাহাথির মোহাম্মদ এই জোটে ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারপর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যান। এ সময়ের মধ্যে তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে উন্নত করেন। এ বছরের জানুয়ারিতে হঠাৎ করে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানে যোগ দিয়ে তারই আগের জোটকে পরাজিত করে বিজয়ী হন।
পুনরায় মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে মাহাথির মোহাম্মদ এক বিরল রেকর্ড করেছেন। তাকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি রাজনীতির জাদুকর, নতুন ইতিহাস রচয়িতা, রেকর্ড ভাঙ্গার কারিগর ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ৯২ বছর বয়সে রাজনীতিতে যুক্ত এবং বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যে শারিরীক সক্ষমতা ও মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োজন, মাহাথির মোহাম্মদ তা ধরে রাখতে পেরেছেন। এই বয়সে এসেও তিনি উপলব্ধি করেছেন, দেশের প্রয়োজনে তার এগিয়ে আসা জরুরী। তার এই ইচ্ছা এবং তাকে যে মালয়েশিয়ার প্রয়োজন ভোটের মাধ্যমে দেশটির জনগণ তা বুঝিয়ে দিয়েছে। কারণ নাজিব রাজাকের দুর্নীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সেবার ওপর নতুন নতুন কর আরোপে দেশটির জনগণ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা এর পরিবর্তন চাচ্ছিল। এ সময়ে মাহাথির মোহাম্মদের আগমণকে তারা বিপুলভাবে স্বাগত জানায় এবং তাকে নির্বাচিত করে। তারা মনে করে, যে মালয়েশিয়াকে মাহাথির অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সুশাসনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে দিয়ে গেছেন, তিনিই পারেন তাদেরকে পুনরায় স্বস্তি ও সমৃদ্ধি দিতে পারবেন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে দেশ আরও অনেক কিছু পাবে। মালয়েশিয়ার এক তরুণ সাংবাদিক সামান্থা ট্যান মাহাথিরের নেতৃত্বে বিরোধী জোটের বিজয় লাভকে বলেছেন, এ হচ্ছে মারদেকা বা স্বাধীনতা। উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম মালয়েশিয়া ক্ষমতায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাত থেকে যে মুক্তি পেল, সেটাই এই নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান প্রাপ্তি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার ভোটের এই ফলাফল অনেকটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মতো, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে এক পক্ষের শাসনের প্রবণতা আরো বেশি কর্তৃত্বীবাদী হয়ে উঠছে। মাহাথির মোহাম্মদের বিজয়ে মালয়েশিয়ার জনগণও ব্যাপক উল্লাসে মেতে উঠেছে। মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যে দুর্নীতি ও অনেকটা স্বেচ্ছাচারি শাসন ব্যবস্থা বলবৎ ছিল তা যে জনগণ পছন্দ করেনি তা এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী জোটকে বিজয়ী করে রায় দিয়েছে। তারা মনে করেছে, একমাত্র মাহাথিরই পারবেন তাদের এই দুর্দশা থেকে বের করে আনতে। মালয়েশিয়ার নির্বাচন থেকে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসকদেরও শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা যে চিরকাল থাকে না এবং জনগণ পছন্দ করে না তা সুযোগ পেলে বুঝিয়ে দেয়। মাহাথির মোহাম্মদও বুঝতে পেরেছেন তিনি যে প্রজাহিতৈষী হলেও কঠোর শাসক ছিলেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর অনেক সময় নিবর্তনমূলক নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করেছিলেন, যা সঠিক ছিল না। অতীতের ভুল স্বীকার করে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরিত্যাগে তিনি মনস্থির করেছেন। গণতন্ত্র, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং ভিন্নমতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনের আগেই তিনি এই অঙ্গীকার করেছিলেন। জনগণও তাকে বিজয়ী করে পুরস্কৃত করেছে।
মাহাথির মোহাম্মদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে অবসরে গেলেও তিনি থেমে থাকেননি। তিনি একটা দার্শনভিত্তিক জীবন চর্চা অব্যাহত রাখেন। তিনি তাঁর দেশ, মুসলিম বিশ্ব এবং গোটা বিশ্ব নিয়েই ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতেন। দেশের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জনগণের দুঃখ-কষ্ট নিয় যেমন সদা সোচ্চার ছিলেন, তেমনি মুসিলম বিশ্বসহ সারা বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়েও তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। বয়সে যথেষ্ট প্রবীন হলেও তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। বার্ধক্য তার কল্যাণ চিন্তা ও সাধনায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এটাও এক পরম বিস্ময়। তিনি তাঁর দর্শন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন এবং কার্যক্রম চালিয়েছেন। মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন। সর্বত্রই তিনি একজন আদর্শিক রোল মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। তিনি দার্শনিক রাষ্ট্র নায়কের প্রতীক। মুসলিম বিশ্বে তাঁর মতো এমন দর্শনভিত্তিক ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে। তাঁর কাছ থেকে মুসলিম নেতৃত্ব শিক্ষা নিতে পারে। বাংলাদেশেরও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তিনি ক্ষমতায় আসায় মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের যে সুসম্পর্ক রয়েছে তা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাহাথির

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন