পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সরকারবিরোধী শিবিরে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ দিন ধরে এই সরকারের কবল থেকে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট একাই আন্দোলন করে যাচ্ছিল। কিন্তু আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক লড়াই বলতে যা বোঝায়, সেটি জনগণের চোখে এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য বিএনপি এবং জামায়াত কয়েক সপ্তাহের জন্য মাঠে নেমে এসেছিল। সেই আন্দোলনটি ঢাকার বাইরে এতই বেগবান হয়েছিল যে, মফস্বল শহরগুলো প্রায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। কিন্তু শক্তির অভাবে হোক, অথবা ভয়ে হোক অথবা সরকারের সাঁড়াশি আক্রমণের কারণে হোক, ঢাকা মহানগরীতে সেই আন্দোলন দানা বেধে উঠতে পারেনি। এরপরপরই জামায়াতে ইসলামীর ওপর হেভি ক্র্যাক ডাউন হয়। জামায়াতে ইসলামীকে মোটামুটি দমন করার পর শুরু হয় বিএনপির ওপর ক্র্যাক ডাউন। বিএনপির আন্দোলন কিছু মানববন্ধন এবং প্রেস ব্রিফিং ও প্রেস কনফারেন্সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিএনপি যত কোণঠাসা হয় সরকারও ততো মারমুখি হয়। এই অবস্থার চ‚ড়ান্ত পরিণতিতে গত ৮ ফেব্রæয়ারি একটি সাজানো মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং তারেক রহমান ও অন্যদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
মানুষের মনে ধারণা হয়েছিল যে, বেগম খালেদা জিয়াকে যদি সত্যি সত্যিই জেলে ঢুকানো হয় তাহলে সারা দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠবে। কিন্তু সেটি হলো না। স্বয়ং বেগম জিয়ার নির্দেশে আন্দোলনকে গণতান্ত্রিকতা, নিয়মতান্ত্রিকতা এবং অহিংস-নন ভায়োলেন্সের মধ্যে আটকে রাখা হয়। বিএনপির হাইকমান্ড হয়তো মনে করেছিলেন যে, এই ধরণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা যাবে এবং গণতন্ত্রকে কর্তৃত্ববাদের জিঞ্জির থেকে বের করে আনা যাবে। কিন্তু বিগত ৩ মাসের অভিজ্ঞতায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপির ঐ চিন্তাধারা সঠিক ছিলনা। উপরন্তু অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়া আরো ৪টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এক শ্রেণীর পত্রিকা এটিকে বলছে ‘শোন এ্যারেস্ট’। অবশ্য সঠিক ইংরেজি হবে শোন এ্যারেস্টেড।
যাই হোক, আজ ৮ মে মঙ্গলবার সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ বেগম জিয়ার জামিনের ওপর রায় দেবেন। যদি কোনো কারণে জামিন না দেওয়া হয় তাহলে সেটি ভিন্ন কথা। তবে সাধারণ বিবেচনায় জামিন না দেওয়ার কথা নয়। কারণ এটি জামিনযোগ্য এবং জামিনের ন্যায্যতা রয়েছে বলেই হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন। তাই সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের জামিন মঞ্জুরকে নাকচ করে দেবেন তেমনটি মনে হয় না। যাই হোক, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ যদি হাইকোর্টের জামিন বহাল রাখেন তাহলেও তিনি মুক্তি পাবেন না।কারণ ঐ যে অপর ৪টি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সেগুলি একটির পর একটি সামনে এসে দাঁড়াবে। ফলে তিনি জেলের খাঁচা থেকে বের হতে পারবেন না। গত শুক্রবার ৪ মে সুপ্রীম কোর্ট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক, আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, দেশে কোনো আইনের শাসন নাই। সুতরাং আইনি লড়াই করে কোনো অবস্থাতেই বেগম জিয়াকে কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে বের করে আনা সম্ভব হবেনা। সেজন্য বিএনপির নেতাকর্মী এবং জনগণকে রাজপথে নেমে আসতে হবে।
\দুই\
আমি এই লেখাটি শুরু করেছিলাম এই বলে যে, বিরোধীশিবিরে নতুন করে শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে। এব্যাপারে বেশ কিছুদিন থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। রাজনীতির অন্দরমহলে যাদের পদচারণা রয়েছে তারা জানেন যে, বিরোধীশিবিরে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের জন্য বেশ কিছুদিন থেকেই বিএনপি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং বিভিন্ন দলের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছিল। এই সরকারের আমলে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠেছে, আইনের শাসনের ওপর বহুদলীয় গণতান্ত্রিকতার ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে। যতদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে ,গণতন্ত্রের ললিতবাণী বাস্তবে রূপলাভ না করবে, ততদিন বেগম জিয়া মুক্ত হবেন না, লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী হাজার হাজার মামলার রজ্জু থেকে মুক্ত হবেন না, কলামিস্টরা হাত খুলে লিখতে পারবেন না এবং বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে ক্রন্দন করবে।
সুখের বিষয়, এই বোধোদয় শুধু বিএনপি ও জামায়াতে নয়, যারা বিএনপি-জামায়াত ঘরানার আশে পাশেও নেই এখন এটি তাদের অধিকাংশের মধ্যেও জাগ্রত হয়েছে। এরা নিজেরা বেশ কিছুদিন থেকে একটি কমন প্ল্যাটফর্মে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আসম আব্দুর রবের জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য যুক্তফ্রন্ট নামক একটি আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। আমরা তখন শুনেছিলাম যে, এই প্ল্যাটফর্মে আরো যোগদান করবেন ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এবং কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। তখন তারা কেন এক সাথে যুক্তফ্রন্টে শামিল হননি সেটি আমাদের অজানা। তবে গত ৪ মে শুক্রবার সুপ্রীম কোর্ট মিলনায়তনে সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির উদ্যোগে ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ড. কামাল হোসেন। যারা আলোচক ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট খন্দাকার মাহবুব হোসেন, বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিষ্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন সভায় সভাপতিত্ব করেন সুপ্রীম কোর্ট বারের সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন। শোনা গিয়েছিল যে, প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আসম আব্দুর রব এবং কাদের সিদ্দিকীও এই সভায় যোগদান করবেন। তবে তাদেরকে অবশ্য এই সভায় দেখা যায়নি।
এই সভার খবর ৩/৪টি দৈনিকে বিস্তারিত এসেছে এবং অবশিষ্ট দৈনিকে অংশ বিশেষ এসেছে। আমরা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি আর করতে চাইনা। তবে আশার কথা হলো এই যে, ড. কামাল হোসেন থেকে শুরু করে প্রায় সব বক্তাই অভিন্ন কন্ঠে বলেছেন যে, দেশ রসাতলে গেছে। তারা আরো বলেছেন যে, স্বৈরতন্ত্র তার কালো থাবা বিস্তার করেছে। সুতরাং আর বসে থাকার সময় নাই। এখন অবিলম্বে সকলকে রাজপথে নেমে আসতে হবে। ড. কামাল হোসেন নিজ থেকে বলেছেন যে, (তার ভাষায়) এই ‘নির্লজ্জ’, ‘অনৈতিক’ ও ‘স্বৈর শাসকের’ বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি নিজে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় গিয়ে অন্য সকলদের সাথে নিয়ে জনসভা করতে চান। মান্না বলেছেন, আসুন, আমরা সকলে মিলে এই সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়ি। রাজপথের আন্দোলনে আমি সামনের সারিতে থাকবো। তবে বিএনপির নেতৃবৃন্দকে মাঝের কাতারে বা শেষে থাকলে চলবে না। তাদেরকেও সামনে আসতে হবে। জ্বালাময়ী ভাষায় বকতৃতা করেছেন আসিফ নজরুল এবং ড. শাহদীন মালিক। এই মর্মে কানা ঘুষা চলছে যে, অতি শীঘ্রই ড. চৌধুরী , আসম রব এবং কাদের সিদ্দিকী এই ব্যান্ডওয়াগনে শামিল হবেন।
\তিন\
এসব খবরে সর্বশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং জনগণের মাঝে নতুন করে আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণও চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। এসব নেতার কাছ থেকে জানা গেছে যে, পবিত্র ঈদের পর বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও এসব নেতার একটি বৃহত্তর ঐক্য মঞ্চ গঠিত হবে এবং তার পরপরই গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুন প্রতিষ্ঠার মহান লক্ষ্যে একটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক মঞ্চের তরফ থেকে আন্দোলনের ডাক দিয়ে নেতারা রাজপথে নেমে আসবেন। তাদের আগে পিছে থাকবেন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতা ও কর্মীরা।
তবে বিষয়টি যত সহজ বলে মনে করা হচ্ছে আসলে সেটি ততো সহজ নয়। কারণ এর মধ্যে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান অত্যন্ত পরিস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে তার কিছু করার নাই। তিনি খালেদা জিয়াকে জেলে দেননি। যারা তাকে জেলে দিয়েছে তারাই তাকে মুক্তি দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। সোজা কথায়, আদালত তাকে জেল দিয়েছে। আদালতই জানে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে কিনা? অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলন করে, রাজপথে নেমে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। আইন-আদালতের মাধ্যমেই তার মুক্তির জন্য বিএনপিকে চেষ্টা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় যে কথাটি বলেছেন সেটি হলো, কেউ নির্বাচনে এলো কি এলো না, সেটি তাদের ব্যাপার। কাউকে নির্বাচনে আনার গরজ তাদের নাই। তারা এলেও নির্বাচন হবে, না এলেও নির্বাচন হবে। আর তৃতীয় যে কথাটি তিনি বলেন, সেটি হলো, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এটিই হলো সাংবিধানিক ব্যবস্থা। সংবিধনাকে ভঙ্গ করে কোনো কিছু করা হবে না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার বিরোধী দলের একটি দাবিও মেনে নেবে না। এর উত্তরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার সহ সেনা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। এই সব দাবি গ্রহণ না করলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না এবং কোনো নির্বাচনও করতে দেবে না।
শেখ হাসিনা এবং মির্জা ফখরুল যা বলেছেন সেটা যদি তারা মিন করে থাকেন তাহলে আমাদের বলতেই হচ্ছে যে, সরকার এবং ২০ দলীয় জোট মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে। রাজপথের আন্দোলন ছাড়া বিএনপির এসব দাবি দাওয়া আদায়ের কোনো পথ নাই।এমন কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরী, আসম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং কাদের সিদ্দিকী যদি তাদের দল সহ রাজপথে নামতে পারেন তাহলে বিএনপির নেতৃত্বধীন ২০ দলীয় জোট এবং কামাল, চৌধুরী, মান্না প্রমুখের সম্মিলিত শক্তির কাছে সরকার তাদের স্বৈরতান্ত্রিক একগুয়েমি বজায় রাখতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে বিপুল সংশয় রয়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।