Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বজ্রপাতে প্রাণহানি

| প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বজ্রপাতে গত রবি ও সোমবার দুইদিনে সারাদেশে অন্তত ৩৫ জনের মৃত্যু এবং ২ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে বজ্রপাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা পরিসংখ্যান বা পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী বলেই ধরে নেয়া যায়। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের এই হার ভয়াবহ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, দুর্যোগ ফোরামসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হিসাব অনুসারে গত ৫ বছরে বজ্রপাতে সারাদেশে ৩ হাজারের বেশী মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আবহাওয়া অধিদফতরের গত ৭ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বজ্রপাতের সংখ্যা এবং হতাহতের পরিমান ক্রমাগত হারে বাড়ছে। আমরা সামুদ্রিক ঝড় ও আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত প্রচার করি, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করি। কিন্তু বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার প্রায়োগিক কোন ব্যবস্থা আপাতত আমাদের হাতে নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির প্রবণতা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অস্বাভাবিক ক্ষরা, বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত বজ্রপাত বৃদ্ধির জন্যও ভ‚-মন্ডলের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রবণতাকে দায়ী করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
চলতি গ্রীষ্মের শুরু থেকেই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সাথে অস্বাভাবিক মাত্রার শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতে প্রাণহানি, ফসলহানি, গাছপালা ও কাঁচা বাড়িঘর ধ্বংসের হার অতীতের যে কোন সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাত আমাদের দেশে একটি চিরায়ত বাস্তবতা। কিন্তু বৃষ্টির সাথে সাথে শত্রæসেনাদের বিমান হামলার মত বজ্রপাতে একেকদিনে ডজন ডজন মানুষের মৃত্যু একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা। বৃষ্টিতে উন্মুক্ত স্থানে কর্মরত বা পথচারিরা বজ্রপাতে হতাহত হচ্ছে। বিষয়টি আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে। অস্বাভাবিক হারে বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে এখন নানাবিধ বিষয় বেরিয়ে আসছে। আমরা যতই বলি এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের কোন হাত নেই। বাস্তব চিত্র ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানীর অনিয়িন্ত্রিত ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও অমিত জীবনযাত্রার সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের দেশে হঠাৎ করেই আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ এবং বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিতে জীবন ও সম্পদহানির পেছনেও প্রায় একই প্রকার কারণকেই দায়ী করা যায়। বিশেষত বাতাসের দূষণের কারণে সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আকাশে কালো মেঘ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বজ্রপাত ও এসিড বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বায়ু, পানি, মাটি দূষণ এবং পাহাড় ধসের মত বিষয়গুলো নি:সন্দেহে মানব সৃষ্ট বিপর্যয়।
বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের আগে দিনের বেলায় রাতের অন্ধকার নেমে আসাও আমাদের নাগরিক জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা। একদিনের কয়েক ঘন্টা বৃষ্টির পর ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় কোমর সমান পানি জমে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। একই অবস্থা দাঁড়ায় দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও। নদী দূষন, বায়ু দূষণ, পরিবেশ দূষণ ও জীববৈচিত্র ধ্বংসের পাশাপাশি যানজটসহ নাগরিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে ইতিমধ্যেই ঢাকা নগরী বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে। জননিরাপত্তা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার মত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করেই আমরা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ণ করছি এবং উন্নয়নের দাবী করছি। বজ্রপাতে হতাহতের হার বৃদ্ধি আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ণ, নগরায়ণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমুহের নির্লিপ্ত ভ‚মিকা আমাদেরকে আরো বড় বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণঘাতি বজ্রপাত বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য অনুঘটকগুলোর সাথে ভ‚-পৃষ্টে বসানো ধাতব পিলার চুরি এবং অপরিকল্পিতভাবে বসানো মোবাইল ফোন টাওয়ারকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। রোদে-বৃষ্টিতে নিরলস কাজ করেই দেশের কৃষককরা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করেন। একইভাবে নানা ঝুঁকি নিয়ে দেশের শ্রমিকরাও দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে কাজ করেন। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষত: বাড়িতে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন এবং বজ্রপাতের সময় ধাতব কল, শিঁিড়র রেলিং বা পাইপ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা, বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা, খোলা জায়গায় কোন বড় গাছের নিচে আশ্রয় না নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রীষ্ম-বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে খেটে খাওয়া মানুষের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বজ্রপাতে হতাহত কৃষক-শ্রমিকের জন্য সরকারীভাবে ক্ষতিপুরণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানা যায়। এটি নি:সন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগি পদক্ষেপ। তবে পরিবেশগত দূষণ ও জনজীবনের বিশৃঙখলা সৃষ্টিকারী অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মান, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তৎপরতা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মহলকে আরো সক্রিয় ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্ঘট থেকে বাঁচতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বজ্রপাত

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন