পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ছোট্ট মেয়ে সেঁজুতি। বাড়ি নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায়। সে চিঠি লিখেছিল প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী দেখতে তার দাদির মতো। চিঠিতে সে প্রধানমন্ত্রীকে দাদু বলেই সম্বোধন করেছে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শিশু সেঁজুতির সে চিঠির জবাব দিয়েছেন। পত্র পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি ব্যতিক্রমধর্মী সন্দেহ নেই। সরকারের প্রধান নির্বাহীর গুরুদায়িত্ব পালন করার ফাঁকে একটি শিশুর চিঠিকে গুরুত্ব দেয়ার আবশ্যকতা ছিল না প্রধানমন্ত্রীর। তিনি সেঁজুতির চিঠির জবাব না দিলেও পারতেন। কিন্তু তিনি জবাব দিয়েছেন। শুধু জবাবই দেননি, তিনি তার একটি ছবিও উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন তার নতুন নাতনিকে। এটা একটা ভালো লাগার মতো খবর। এতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সংবেদনশীল মনের পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অচেনা ছোট্ট মেয়ে সেঁজুতির মায়াভরা কথা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। আর তা করবেই বা না কেন? সেঁজুতির চিঠির ভাষা পড়লেই কারণটি স্পষ্ট হয়ে যায়। সে প্রধানমন্ত্রীকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছে এবং বলেছে কিছুদিন আগে তার দাদী মারা গেছে, প্রধানমন্ত্রী দেখতে অবিকল তার মতো। একটি শিশু যখন এভাবে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়, তখন হৃদয় আছে এমন মানুষ সাড়া না দিয়ে পারে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও দিয়েছেন। আমরা এ সংবেদনশীলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। একই সাথে তার অফিসের সেসব কর্মকর্তাও ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন, যারা অপরিচিত একটি শিশুর চিঠি প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির করেছেন।
দেশে প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটছে। তার সব খবর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছানোর কথাও নয়। কিন্তু সেঁজুতির কথা পৌঁছেছে। সেঁজুতি ওর দাদীকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তার ছায়া দেখতে পেয়েছে। সেঁজুতির মতো হাজার হাজার শিশু এখন বাবা হারিয়ে কাঁদছে। কেউ তাদের কান্না শুনতে পায় না। প্রতিনিয়ত মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে। একজন মানুষ গুম খুন হওয়া কেবল একজন মানুষের পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া নয়। তার সাথে জড়িয়ে আছে আরো অনেকের হাহকার-দীর্ঘশ্বাস। যে যায় সে তো চলেই যায়। কিন্তু সৃষ্টি করে যায় এক বিরাট শূন্যতা, যা কখনোই পূরণ হয় না। দাদীহারা সেঁজুতির আঁকুতি প্রধানমন্ত্রীকে আপ্লুত করেছে সন্দেহ নেই। এমন অনেক সেঁজুতি গত কয়েক বছরে তাদের বাব-চাচা-মামাসহ প্রিয়জনদের হারিয়ে মাতম তুলেছে। কেউ চিৎকার বলছে, আমার বাবা কোথায়? কেউ বলছে আমার চাচ বা মামাকে এনে দাও। তাদের সে হাহকার-আর্তনাদ কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়? না, তা সম্ভবত পৌঁছায় না। আর পৌঁছায় না বলেই স্বজনহারা মানুষগুলোকে শুধু হাহাকার করতে শোনা যায়। তাদের বিলাপে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মানুষের তিরোধান ঘটবে এটা স্বাভাবিক। অসুখ-বিসুখ জরা-ব্যাধিতে মানুষ প্রতিদিনই মৃত্যু বরণ করছে। তাদের মৃত্যুতে স্বজনরা আহাজারি করে, কষ্ট পায়। তবে, তাদের সান্তনা এই যে, প্রিয়জনের মৃত্যু তাদের সামনেই ঘটেছে, তাকে তারা তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকার করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু যারা গুম হয়ে যাচ্ছে, কিংবা গুপ্তঘাতকের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে তাদের কী হচ্ছে? তারা এতোই ভাগ্যাহত যে, মৃত্যুর সময় স্বজনদের অশ্রæসজল চোখও তারা দেখতে পায় না।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এমনি এক পরিস্থিতিতে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন তাঁর সে বিখ্যাত কলামটি লিখেছিলেন, যেটার শিরোনাম ছিল, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই এটা ঠিক। তবে একজন মানুষের স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণ করার অধিকার আছে। এটা বেঁচে থাকার অধিকারের সাথে সম্পর্কিত। অথচ সে অধিকার আজ অনেকটাই সঙ্কুচিত। এখানে সেখানে মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে। সরকারি প্রশাসনের কাছে গিয়ে খুন-গুমের শিকার ব্যক্তিটির স্বজনরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। বরং বেশিরভাগ সময় তারা সম্মুখীন হয় বিরূপ পরিস্থিতির। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব গুম-খুনের অধিকাংশের জন্য অভিযুক্ত হচ্ছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে গুম-খুনের ওপর গণশুনানি হয়ে গেল। সেখানে গুম বা নিখোঁজ হওয়া প্রায় অর্ধশত পরিবারের সদস্যরা তাদের বেদনার কথা জানিয়েছেন, অভিযোগ তুলেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী বেশির ভাগ গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে। সে সব ঘটনায় মামলা না নেয়া, মামলা নেয়ায় গড়িমসি করা এবং মামলা নিলেও দীর্ঘদিন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কথা জানিয়েছেন শোকার্ত ওই পরিবারগুলোর সদস্যরা। এদের মধ্যে সাম্প্রতিক গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার, এমন কি আট-দশ বছর ধরে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও গণশুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। ‘মায়ের ডাক’ তাদের এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত গুম, বিচারবর্ভিভূত হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭২৭ জন ব্যক্তি।
গুম-খুন সম্পর্কে বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থার পরিসংখ্যান বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেসব পরিসংখ্যান এ কথা জানান দেয় যে, দেশে স্বাভাবিক পরস্থিতি বিরাজ করছে না। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিরা বেশিরভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। আর সে কারণেই এসব ঘটনার জন্য অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের দিকে। কথাবার্তা এদিক সেদিক করা হলেও এ ক্ষেত্রে সরকার দায় এড়াতে পারে না। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, এসব গুম-খুনের ঘটনায় সরকারি বাহিনী জড়িত নয়, তাতেও কি সরকার দায় এড়াতে পারে? কারণ, জনগণের জানমালের হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত। ফলে সে জনগণের কোনো এক সদস্য যদি কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা অপহৃত হন বা খুন হন, তাহলে সে ঘটনার হোতাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সে ক্ষেত্রে যদি সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে বা গড়িমসি করে, তাহলে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠবেই।
অস্বীকার করলেও এটা মিথ্যে হয়ে যাবে না যে, দেশে আজ স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। বিরোধী দল, বিশেষ করে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির জন্য সময়টা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে দিনের পর দিন কারাগারের অন্ধকারে দুঃসহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। আর তাদের স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পার করছে প্রতিটি দিন। কবে তাদের প্রিয় মানুষটি মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারবে- এ ভাবনায় তারা অশ্রæসিক্ত হচ্ছেন, বুকে কষ্টের পাথর বেঁধে প্রহর গুনছেন। কবে তাদের সে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে কেউ জানে না।
বাংলাদেশের নাগরিকদের রাজনীতি করার অধিকার সংবিধানই দিয়েছে। কিন্তু সে অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেকেই সরকারের রোষানলে পড়ে আজ প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন। এটা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, অতীতেও অনেক সরকার এ ধরনের নিবর্তনমূলক কাজ করেছে। সরকারের এ ধরনের আচরণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গন্থে লিখেছেন, “একদিন একদিন সকালে আমি ও রেণু (বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর ডাকনাম) বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমি তো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কতবড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।”( পৃষ্ঠা ২০৯)
আমরা জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন সংবেদনশীল মনের অধিকারী মানুষ। স্বজন হারানোর ব্যথা তিনি প্রতি পলে অনুভব করেন। আর তা করেন বলেই শিশু সেঁজুতির দাদী হারানোর বেদনা তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আর সেজন্যই তিনি ওর চিঠির উত্তর দিয়ে ওর দাদী হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও প্রশমিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর চিঠি যে সেঁজুতিকে আনন্দিত ও গর্বিত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী তার চিঠির জবাব দিয়েছেন, এটা ওর জীবনে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়েই থাকবে। দেশে সেঁজুতির মতো আরো অনেক স্বজনহারা শিশু আছে, যারা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার সাহস রাখে না, সুযোগও নেই। তাই বলে কি তাদের হাহাকার প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছাবে না? তিনি কি এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারেন না, যাতে আর কোনো মানুষকে গুম-খুনের শিকার হতে না হয়? তিনি কি পারেন না, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে বিনা বিচারে মানুষকে অসহনীয় কারাভোগ থেকে রেহাই দিতে?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।