Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শ্রমিকের সুউচ্চ মর্যাদা নিশ্চিত করেছে ইসলাম

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বলা হয়, অর্থ যার ক্ষমতা তার, বর্তমানে একমাত্র আর্থিক স্বাচ্ছন্দের উপরই মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ভরশীল। নৈতিকতা বা মানবতার বিচারে সে যত ঘৃণ্য প্রকৃতিরই হোক না কেন, মোটা অংকের ব্যালেন্স থাকলেই সামাজিকভাবে সমস্ত উপকরণ তার আয়ত্তে চলে আসে। পক্ষান্তরে বিত্তহীন ব্যক্তি বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থার মাপকাঠি অনুযায়ী তার কোন মূল্যই নেই। 

একজন শ্রমিক, যেহেতু তার কোন অর্থবল নেই তাই আজকের শ্রমিকদের অবস্থা প্রাচীনকালের দাসদের সামাজিক মর্যাদার চেয়ে বেশি নয়। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। বস্তুতান্ত্রিক আদর্শের বিপরীতে ইসলামের দৃষ্টিতে আর্থিক সঙ্গতিই সমাজে স্থান লাভের উপায় নয় বরং প্রত্যেক সৎকর্মশীল পরহেযগার ব্যক্তিই মর্যাদার অত্যুঙ্গ শৃঙ্গে আরোহণ করতে পারে। জন্মগত বা পেশাগত দিক থেকে যত নীচু মানেরই হোক না কেন, সে আপন কর্মের মাধ্যমে সমাজে স্বীয় মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পায়। এই মৌলিক সত্যটির দিকেই ইঙ্গিত দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে তারাই বেশি মর্যাদাবান যারা অধিক আল্লাহ ভীরু, পরহেযগার। ইসলামের এই দৃষ্টি ভঙ্গির ফলে আমরা দেখতে পাই, একজন সৎকর্মশীল পরহেযগার শ্রমজীবী অনেক উঁচু মর্যাদায় আসীন হয়েছে। পেশায় শ্রমিক বলে এখানে তার মর্যাদাহানিকর কোন পরিস্থিতি নেই। ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষিত করেছে। আমরা জানি, খোদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একজন শ্রমজীবী ছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের অংশীদার হিসাবে অর্থাৎ মুজারাবাতের ভিত্তিতে হযরত খাদীজা (রা.) এর ব্যবসায় খেটেছেন। তাঁর মতো একজন বিত্তহীনের গলায় সততা ও প্রজ্ঞার সম্যক পরিচয় পেয়েই খাদীজার মতো বড় পুঁজির অধিকারিনী এক মহিয়সী নারী মালা পরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
হযরত আলী (রা.) নিজে তাঁর মেহনতী যিন্দেগীর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলতেন, মদীনায় থাকাকালীন একবার ক্ষুদার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শহরতলির দিকে কাজের তালাসে বের হয়ে পড়লাম। এক স্থানে একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখতে পেলাম। মনে হলো, সে হয়ত মাটি ভিজাবে। তখন এক একটি খেজুরের বিনিময়ে এক এক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দেয়ার কাজ করলাম। পর্যায়ক্রমে ষোল বালতি পানি তুললাম। এতে আমার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। কাজ সেরে হাত মুখ ধুলাম। মেয়েটি আমাকে ষোলটি খোরমা পারিশ্রমিক দিয়ে দিল। তা নিয়ে নবী করীম (সা.)-এর কাছে আসলাম। সবিস্তার উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর নবী করীমও (সা.) আমার সঙ্গে তা খেলেন।
দেখা যায়, দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) একজন রাখাল শ্রমিক ছিলেন। মক্কার অদূরবর্তী কাদীদ থেকে দশ মাইল দূরে জান জান ময়দানে তাঁকে উট চরাতে হতো। খিলাফতের পর একবার এই মাঠ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল, চোখে পানি নেমে এল। সঙ্গীদের তখন নিজের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, এমন এক সময় ছিল যখন ঘোড়ার জিনের মামুলি এক টুকরো কাপড় পরে এই মাঠে আমি উট চরাতাম। পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লে পিতা বেদমভাবে প্রহার করতেন। আর আজ, আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কেউ হাকিম নেই।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) ছিলেন শ্রমজীবী সাহাবাগণের অন্যতম। মদীনায় দরবারে নববীতে হিজরত করে চলে আসার পর একটি মেয়ের বাসায় থাকতেন। শ্রমের বিনিময়ে তাঁকে জীবিকা চালাতে হতো। তিনি নিজে বলেন, আমি বুছরা-বিনতে গাজওয়ানের ঘরে খাবার এবং এক জোড়া জুতার বিনিময়ে কাজ করতাম। তারা উটে আরোহণ করলে তা হাঁকিয়ে নিয়ে যেতাম এবং নেমে আসলে তাঁদের খেদমত করতাম। একদিন আমাকে ঐ মেয়ে আদেশ করল, খালি পায়ে নেমে যাও, আবার উট দাঁড়ানো রেখেই এতে উঠে বস। অর্থাৎ জুতা জোড়া পরার এবং উট বসাবার সময়টুকুও দিত না। আল্লাহর অসীম কুদরত দেখ, আজ ঐ মেয়ে-ই আমার অর্ধাঙ্গিনী বলে পরিচিতা। বিয়ের পর একদিন তাকে (রসিকতা করে) বললাম, জুতা না পরে এবং উট না বসিয়েই এতে চড়ে বস। এর চেয়ে বেশি আর সামাজিক সাম্য কী হতে পারে, একজন মেহনতী মানুষ তারই মালিককে অনায়াসে বিয়ে করে নিতে পারে। অহেতুক আভিজাত্যের অহমিকা যেখানে কোন বাধারই সৃষ্টি করতে পারে না। ইসলাম এক একজন শ্রমজীবীর জন্যও অফুরন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তার জীবনে অপরিমেয় সুযোগ এনে দিয়েছে।
একবার দরবারে নববীতে হযরত উমর (রা.) এর জবান থেকে বের হয়ে পড়ল, বিলাল, তুমি কালো এক হাবশী। এ শুনে নবী করীম (সা.) বললেন, উমর, এখনো তোমার মধ্যে জাহিলিয়াতের অন্ধ অভিজাত্যের গন্ধ রয়ে গেছে। হযরত উমর অনুশোচনায় মাটিতে নুইয়ে পড়লেন। উঠতে বলা হলে বললেন, বিলাল আমাকে পা দিয়ে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত আমি উঠব না। শেষে সত্যই তিনি বিলালকে বাধ্য করলেন তাঁকে পা দিয়ে উঠিয়ে দিতে। একবার আবু যর (রা.) এর সঙ্গে হযরত বিলালের মনোমালিন্য ঘটে গিয়েছিল। আবু যর আরবের অভিজাত গোত্র গিফারের সরদার ছিলেন। তিনি নিজেকে হযরত বিলাল (রা.) অপেক্ষা কিছুটা উচ্চ বংশজাত মনে করেছিলেন। তাই তিনি তাঁকে বলে উঠলেন, আও! বান্দীর বেটা। নবী করীম (সা.) যখন একথা শুনলেন তখন আবু যরকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি একে গালি দিয়েছো? তিনি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন। ছোট করে বললেন, হ্যাঁ। তার মার নাম জড়িত করে গালি দিয়েছ? আবু যর অপরাধ স্বীকার করে নিলেন। এরপর অধীনস্থ খাদিমদের পরম নির্ভরস্থল মুহাম্মদ (সা.) বললেন, আবু যর তোমার গোঁড়ামি এখনও যায়নি। নবী করীম (সা.) সঙ্গে সঙ্গে এদের প্রকৃত মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে ইরশাদ করলেন, আবু যর, এরা (নীচ নয়) তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমত করছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর আজাদকৃত দাস-শ্রমিক ইকরামা (রা.) যখন বসরা যান, তখনকার অবস্থা বর্ণনা করে আইয়ুব সিকতিয়ানী বলেন, মানুষ ইকরামাকে একটু দেখার আশায় এভাবে ভেঙে পড়েছিল যে, অনেক ঘরের ছাদে পর্যন্তও উঠে গিয়েছিল। ইসলাম সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান দূর করেছে, এমনকি, নামগত পার্থক্যও দূর করে দিয়েছে। শ্রমিকদের মর্যাদাহানিকর কোন শব্দ ব্যবহার পর্যন্ত ইসলাম বরদাশত করেনি। কোন দাস-শ্রমিককে দাস বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কারণ এতে মনে অহঙ্কার এবং সে যে শ্রমিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ ধারণার জন্ম হতে পারে। নবী করীম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ দাস শ্রমিককে ‘দাস’ বলে ডাকতে পারবে না। আর মালিককেও ‘রব’ বলতে পারবে না। কারণ তোমরা সকলেই গোলাম। একমাত্র আল্লাহই সকলের রব বা প্রতিপালক।
লেখক: খতিব, বায়তুল করিম জামে মসজিদ, হালিশহর, চট্টগ্রাম



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমিকের


আরও
আরও পড়ুন