পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাম্মামে সউদী আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সমাপনী কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনের কল্যাণে আমরা তা জানতে পেরেছি। এর প্রায় কাছাকাছি সময়ে আমরা আরও একটা সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত খবরে জানতে পেরেছি। সিরিয়ায় যৌথ বিমান হামলা চালিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের তিনটি নেতৃস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। একটি মুসলিম দেশ সিরিয়ায় হামলা চালায় তিনটি নেতৃস্থানীয় খৃস্টান দেশ এমন এক সময়ে যখন সিরিয়ার কাছাকাছি সৌদী আরবে সামরিক কুচকাওয়াজ চলে অথচ ওই হামলার কোন প্রতিবাদ হয় না। এর অর্থ যে মুসলিম বিশ্বের চরম অনৈক্য তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সিরিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের তিনটি নেতৃস্থানীয় দেশ যে যৌথ সামরিক হামলা চালায় সে হামলার লক্ষ্য ছিল দেশটির তিনটি স্থাপনা। এর একটি ছিল সিরিয়ার বিজ্ঞান গবেষণাগার। গত শুক্রবার পরিচালিত এই যৌথ হামলাকারীদের বক্তব্য ছিল এটি নাকি ছিল রাসায়নিক অস্ত্রাগার। এই হামলায় বিমান থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। রাশিয়া অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহতের দাবী করলেও যুক্তরাষ্ট্র সে দাবী নাকচ করে দিয়েছে। সিরিয়া বলেছে হামলার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবী তিনটি লক্ষ্যেই আঘাত সফল হয়েছে। হামলা প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল অবশ্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে। এদিকে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র প্রকল্প বন্ধ করতে জাতিসংঘে নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব সবাইকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে সিরিয়া সরকার দৌমায় রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে এই অভিযোগে পশ্চিমা বিশ্বের দেশ তিনটি এই হামলা চালায়। এর আগে একই ধরনের অভিযোগ ইরাকসহ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে এনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। পরে সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। খবর বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স ও ডেইলী মেইল।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় সিরিয়ার তিনটি স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান থেকে অত্যাধুনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার দুটি মিত্র দেশ। এবার যে হামলা চালানো হয়েছে সেটি এক বছর আগের হামলার চেয়েও ছিল শক্তিশালী। সেবার যুক্তরাষ্ট্র একাই ছিল, এবার সিরিয়ার তিনটি স্থাপনা লক্ষ্য করে যে হামলা চালানো হয়, তাতে তার সঙ্গে ছিল আরো দুটি মিত্র দেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। আগেরবার হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল একটি, আর এবার অন্তত তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলার লক্ষ্য সফল হয়েছে বলে দাবী করেছেন। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন সিরিয়া সরকার যদি ফের রাসায়নিক হামলা চালায় তা হলে আমরাও ফের হামলা চালাতে প্রস্তুত। তবে তার সফলতার দাবী নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে খোদ দেশটিতে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় সাবেক ওবামা প্রশাসনের সমালোচনা করেছে। যেসব স্থানে হামলা চালানো হয়েছে তার একটি মানচিত্রও প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। সিরিয়ার দামেস্কের বারর্জেই রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, হোমসের পশ্চিমে হিমশিন জের রাসায়নিক অস্ত্র বাঙ্কার হামলার লক্ষ্য ছিল। এছাড়া কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হয়। সিরিয়ানরা বলছে, হামলা চালালেও কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিন দেশ মিলে ১০৫টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র ডানা বলেছেন প্রত্যেকটি হামলা সফল হয়েছে। হোমস শহরের দুটি স্থাপনার চিত্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তুলেছে ডিজিটানপ্পোর নামের একটি কোম্পানী। হামলার আগে শুক্রবার এবং হামলার পর শনিবারের ছবি প্রকাশ করেছে কোম্পানীটি। এতে দেখা যায় দু’টি স্থাপনাই ধ্বংস হয়ে গেছে। দামেস্কের বারজেহ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে হামলা সম্পর্কে প্লানেট ডটকম জানিয়েছে, তাদের তোলা ছবিতে গবেষণা কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মার্ক ওয়েনার জানান, হামলার পক্ষে দেশ তিনটি যেসব যুক্তি দেখাচ্ছে, তাতে প্রধানত জোর দেওয়া হচ্ছে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার উপর। তারা বলছে এই হামলার লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট আসাদের বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে এরকম রাসায়নিক হামলা প্রতিরোধ করা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, এটা যুক্তরাজ্য করেছে তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বার্থে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে বিচার করলে এসব যুক্তি কিন্তু বিশ্বকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী কোন দেশ আত্মরক্ষার্থে এবং কোন জনগোষ্ঠী, যারা নির্মূল হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে তাদের রক্ষায় সামরিক বল প্রয়োগ করতে পারে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং শৃংখলা বজায় রাখার মত বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনেও বল প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা হতে হবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে। ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ সনদ পরবর্তী আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিশোধ হিসাবে সামরিক বল প্রয়োগ বা কোন দেশকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সামরিক হামলা করা যায় না।
১৯৮১ সালে ইসরাইল যখন ইরাকের পারমাণবিক চুন্নিতে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে দেয়, তখন কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ তার নিন্দা করেছিল। কেনিয়া এবং তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জবাবে ১৯৯৮ সালে সুদানের-এক কথিত রাসায়নিক অস্ত্র কারখানায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়। সেটারও নিন্দা করেছিল জাতিসংঘ। তিন দেশের যুক্তি যে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে সিরিয়াকে বাধ্য করতে তারা এই হামলা চালিয়েছে। ২০১৩ সালে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র নিরোধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদে সই করলেও তা মানছেনা।
গত ৭ এপ্রিল দৌমায় রাসায়নিক হামলা হয় বলে অভিযোগ পশ্চিমা বিশ্বের। এতে ৭০ জনের বেশী নিহত হয়েছিল। সিরিয়ার অরর্গানাইজেশন ফর দ্যা প্রহিবিশান অব ক্যামিকেল উইপন্স তদন্ত করার আগেই হামলা চালানো হয়। হামলার তদন্ত নিয়ে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের তিন সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যুক্তি দিচ্ছে যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়ার কোন বাস্তব সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে তারা আন্তর্জাতিক শৃংখলা বজায় রাখার কাজটি করেছেন। কিন্তু এই যুক্তিটি যেন ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের যুক্তিটিকেই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তরিও জতেরেস মনে করে দিয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের মূল ভূমিকাকে সবার শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
হামলার বৈধতা নিয়ে যুক্তরাজ্যেও প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী লেবার পার্টির নেতা জেরোবি করবিন এই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, হামলায় অংশ নেয়ার আগে পার্লামেন্টের অনুমোদন নেয়নি প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সরকার। প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুজুগে হামলায় অংশ নেবেন কেন, প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। অন্যদিকে সিরিয়া সরকার যাতে রাসায়নিক অস্ত্র প্রকল্প বন্ধ করে তা কার্যকর করতে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন প্রস্তাব আনছে ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছে।
উপরে যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে তার উপসংহার টানতে এবার আমরা সমগ্র বিশ্বের সর্বশেষ পরিস্থিতির দিকে তাকাবো। সুক্ষ্ণ পর্যালোচনা করতে গেলে আমরা দেখি, আজকের বিশ্ব যেন সর্বত্রই বিশ্বশান্তির, মানবতার অবমূল্যায়নের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আমরা যে মানুষ এবং সৃষ্টির সেরা হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য যে মানবতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া, তা যেন আমরা ভুলেই যেতে বসেছি। জোর যার মুল্লুক তারÑএই অমানবিক নীতিকে অবলম্বন করে পশ্চিমা বিশ্ব আজ মানবসমাজকে কোথায় টেনে নামিয়েছে। সেটার দিকে যদি আমরা তাকাই তা হলে দেখবো, মানবতা, মানবকল্যাণ, বিশ্বশান্তি এগুলো যেন আমরা ভুলেই গেছি। এই দু:খজনক অবস্থা থেকে আমরা যতদ্রুত মুক্তি পাই ততই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। সিরিয়ার সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির দৃষ্টান্ত থেকে আমরা যত দ্রুত ধ্বংস ও অকল্যাণে পথ পরিহার করে মানবতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।