Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিরিয়ায় পশ্চিমা জোটের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

| প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এক সপ্তাহ তীব্র উত্তেজনা ও বাকযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গত শুক্রবার সিরিয়ার বিভিন্ন অবকাঠামো ও স্থাপনার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। বাশার আল আসাদ সরকার আর যাতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যেই এই হামলা বলে পশ্চিমারা দাবি করেছে। গত ৭ এপ্রিল শনিবার সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডোমা শহরে রাসায়নিক হামলা হয়। এতে বহু লোক নিহত হয়। মানবাধিকার কর্মী ও চিকিৎসকরা জানায়, সরকারী বাহিনী এই রাসায়নিক হামলা চালায়, যাতে অনেকে নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই রাসায়নিক হামলার জন্য সরকারী বাহিনী ও রাশিয়া দায়ী। বাশার আল আসাদ সরকার ও রাশিয়া এ অভিযোগ অস্বীকার করে। রাশিয়া দাবি করে, ডোমায় কোনো রাসায়নিক হামলাই হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো জানান, ডোমায় সিরীয় সরকার যে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে, তার প্রমাণ তার কাছে আছে। ওদিকে রাসায়নিক হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হামলার জবাব হিসাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে বলে জানান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এক টুইটে তিনি ‘ক্ষেপণাস্ত্র আসছে’ বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। রাশিয়া পাল্টা হুমকি দিয়ে বলে, সিরিয়ার দিকে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালে ভূপতিত করা হবে। এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘প্রস্তুুত হও রাশিয়া।’ এই বাকযুদ্ধের মুখে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পেন্টগণের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মোট তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। একটি হচ্ছে দামেস্কের কাছে রাসায়নিক অস্ত্রপ্রস্তুতকারী গবেষণাগার। অন্য দু’টি হলো হোমসে রাসায়নিক অস্ত্ররক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র ও রাসায়নিক অস্ত্রের যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ কেন্দ্র। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যৌথভাবে ১০০টির মতো এয়ার-গ্রাউন্ড ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
পূর্ব গৌতার ডুমায় বাশার আসাদ সরকারের রাসায়নিক হামলা এই প্রথম নয়। ২০১৩ সালের আগস্টে একইভাবে রাসায়নিক হামলা চালানো হয়, যাতে বহুলোক নিহতে হয়। শুধু তাই নয়, গত বছর শেইকুনে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব গ্রামে সরকারী বিমান বাহিনী সারিন গ্যাস হামলা চালায়। সেখানেও অনেক লোক হতাহত হয়। বলা বাহুল্য, ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাশার আল আসাদের বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে আসছে। এই সঙ্গে চলছে উৎসাদন ও বিতাড়ন। এ পর্যন্ত ৫ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি-সহায়সম্পদ হারিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসাবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। পালানোর সময় সিরীয় কত শিশু ও নাগরিকের যে সাগারে সলিল সমাধি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শিশু আইলানের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বিশ্ববাসী কখনো ভুলতে পারবে না। এটা অনেক আগেই প্রতীয়মাণ হয়েছে, বাশার আল আসাদ সরকারকে সরিয়ে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারলেই কেবল সিরিয়ায় শান্তি ফিরে আসতে পারে। বাশার আল আসাদের সরকারের পতনের মাধ্যমেই অবসান হতে পারে গৃহযুদ্ধের, অবসান হতে পারে হত্যা, নির্যাতন এবং শরণার্থী হওয়ার মতো দুর্বিষহ অধ্যায়ের। অত্যন্ত দু:খজনক ও বেদনাদায়ক বাস্তবতা এই যে, এই ‘সমাধান সূত্রটি’ জানা থাকার পরও পশ্চিমা শক্তিচক্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্ররা গত ৭ বছরে কিছুই করতে পারেনি। বাশার আল আসাদ সরকারের অপসারণ বা পতনে কোনো কঠোর ও কার্যকরযোগ্য ব্যবস্থা নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তেমন ব্যবস্থা নিলে অনেক আগেই সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসতো। যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসনের দায়সারা ও লোকদেখানো উদ্যোগ-পদক্ষেপ বাশার আল আসাদ সরকারকে বাধ্য ও নমিত করতে পারেনি। গৃহযুদ্ধ এতোদিন প্রলম্বিত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররাই দায়ী। তাদের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের অভিমতও এটা। ইতোমধ্যে বাশার আল আসাদ সরকার তার নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে, মিত্রদের বিশেষ করে ইরান ও রাশিয়ার নিরংকুশ সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়া, ইরান ও রাশিয়া একটি শক্তিবলয় তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। ইরানকে ভিত্তি করে ওই অঞ্চলে শিয়াইজমের যে উত্থান ঘটেছে তার জন্যও মূলত পশ্চিমারাই দায়ী। ইরান ছাড়াও ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমন, লেবানন প্রভৃতি দেশে শিয়াদের আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থে রাশিয়া এদের মিত্রে পরিণত হয়েছে। ওই এলাকার সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা ও আরব মিত্ররা শুরুতেই যদি সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিতে অগ্রসর হতো, যথাযোগ্য পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিতো তাহলে এ অবস্থা আদৌ সৃষ্টি হতে পারতো না।
সিরিয়ায়সহ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাশার আল আসাদ সরকারের অপসারণ ও ইরানের আগ্রাসী নীতি ও পদক্ষেপ রুখে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এটা হতে পারে সামরিক ব্যবস্থায় অথবা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিশ্ব পরিস্থিতিতে কী প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এখনো তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তারা তাদের এই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কীনা, রাখবে কী না সেটাও স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াও খেয়াল রাখার মতো। রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিন্দা করেছে। এই হামলাকে আগ্রাসন হিসাবে চিহ্নিত করেছে। হামলার পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা হলে, অনেকেই মনে করেন, একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা উড়িয়ে দেয়নি। ডোমায় রাসায়নিক হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির বাকযুদ্ধ দেখে অনেকেই বলেছিলেন, নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের অবতারণা হতে যাচ্ছে। এমনকি এই স্নায়ুযুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেও রূপান্তরিত হতে পারে। তেমন কিছু হলে বিশ্বের অবস্থা কী হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। যুদ্ধ, তা আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক হোক, কারো কাম্য হতে পারে না। এমতাবস্থায় ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যুদ্ধ নয়, সমঝোতা ও শান্তির পথই কাম্য। সিরিয়া সংকটের সমাধান সূত্র, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবায়নের পথে এগুনোই হবে সর্বোত্তম। জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এটা হলে প্রত্যাশিত শান্তি ও উদ্ভূত আশংকার অবসান-দুই-ই সম্ভবপর হতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিরিয়া

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন