বাংলা সন ইসলামী ঐতিহ্যেরই অংশ
বাংলাসন ইসলামী ঐতিহ্যজাত। এ সনের উদ্ভাবন ঘটেছে হিজরিসন থেকে। এর উদ্ভাবন, প্রবর্তন সবই মুসলমানরা করেছে।
বাংলাদেশে তিনটি সনের হিসাবে বর্ষ গণনা করা হয়, আর সেগুলো হচ্ছে হিজরি সন, বাংলা সন এবং খ্রিস্টীয় সন। সে কারণে এখানকার মানুষ প্রতিবছর তিন রকমের নবর্বষের সান্নিধ্যে আসে। বাংলা নববর্ষ আসে বসন্তকালকে বিদায় জানিয়ে কাল বৈশাখীর সম্ভাবনাকে বুকে ধরে গ্রীষ্মকালের সূচনাতে। ১ বৈশাখ পালিত হয় নববর্ষ। খ্রিস্টীয় বা ইংরেজি নববর্ষ আসে প্রচন্ড শীতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ১ জানুয়ারিতে। হিজরি নববর্ষ আসে ১ মুহররমে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে। এই দেশে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে পঞ্জিকার ব্যবহার সার্বজনীন রূপ লাভ করতে পারেনি। অবশ্য চান্দ্র কলার নিরীক্ষণ এবং সে অনুযায়ী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, তিথি, একাদশী ইত্যাদি নিরূপণ করার প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত খ্রিস্টীয় ও বাংলা সন দুটি সৌর বর্ষ এবং হিজরি সনটি চান্দ্র বর্ষ। সূর্যের পরিক্রমার হিসাবে যে সন গণনা করা হয় সেই সনকে সৌরসন বা সৌরবর্ষ এবং চাঁদের পরিক্রমার হিসাবে যে সন গণনা করা হয় তাকে বলা হয় চান্দ্রবর্ষ বা চান্দ্রসন। এই সন শব্দটি আরবি থেকে এসেছে এবং এখানে প্রচলিত সাল শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ থেকে। আমরা যে তারিখ শব্দটি ব্যবহার করি এটাও আরবি।
বাংলাদেশে প্রচলিত তিনটি সনের মধ্যে হিজরি সনই হচ্ছে প্রাচীন সন। এখানে ইসলাম প্রচার প্রথম ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর চল্লিশ দশকের দিকে। তখন থেকেই এখানে হিজরি সনের আগমন ঘটেছে। আর সম্রাট আকবরের আমলে হিজরি সনকে সৌর গণনায় এনে যে সন এখানে প্রচলিত হয়েছে সেটা বাংলা সন। আর খ্রিস্টীয় সন এখানে এসেছে ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পর।
কুরআন মজীদে বর্ষ গণনার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: ‘আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দুটি নিদর্শন। রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে আলোকপ্রদ করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের রব্-এর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং যাতে তোমরা বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পারো’ (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ১২)।
ইসলাম সৌর ও চান্দ্র উভয় প্রকারের বর্ষ গণনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন মজীদে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ এনে ইরশাদ হয়েছে: ‘সূর্য চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে’ (সূরা আর রহমান: আয়াত ৫), ‘তিনি (আল্লাহ্) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে, যা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিবসকে’ (সূরা ইব্রাহিম: আয়াত ৩৩)।
মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়ের হিসাবে ধরে রাখার মননও সঞ্চারিত হয় এবং তার থেকেই সূর্য পরিক্রমার হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবেরও উদ্ভব ঘটে। এমনিভাবে সূর্য পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটে তা সৌরসন আর চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটে তা চান্দ্রসন। সূর্যের নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। একে বলা হয় সৌর বছরে দৈর্ঘ্য। অন্যদিকে চন্দ্রকলার হ্রাস ও বৃদ্ধি সম্পাদনে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা, যে কারণে এক চান্দ্র বছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সন উৎপত্তিগতভাবে ইসলামের উত্তরাধিকার বহন করছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ১ মুহররম থেকে হিসাব করে হিজরতের ১৭ বর্ষ অর্থাৎ ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর রাদি আল্লাহ্ তা‘আলা আন্হু হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। এই সন প্রবর্তনের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলে হিজরি সনের প্রচলনও এখানে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়। ৫৮৯ হিজরি মুতাবিক ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। এই সময় থেকে এখানে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে এবং তা জাতীয় সনে পরিণত হয়, যা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশী যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৯৬৩ হিজরিতে মুঘল বাদশাহ্ আকবর পিতা বাদশাহ্ হুমায়ূনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বহু সংস্কারমূলক কাজ করেন। হিজরি সন চান্দ্র হওয়ায় ঋতুর সাথে এর মাসগুলো স্থির থাকতে পারে না, ফলে রাজস্ব আদায়ে কয়েক বছর পরপর দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হওয়া দেখে বাদশাহ্ আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে একটি নতুন সৌরসন উদ্ভাবনের জন্য তদানীন্তনকালের একজন বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহুল্লাহ্ সিরাজীকে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে দায়িত্ব দেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরি সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করে তা ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ্ আকবরের দরবারে পেশ করেন। আকবর তাতে অনুমোদন দান করেন এবং এক ফরমান জারী করে এই সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ঘোষণা দেন। হিজরি সনের এই সৌররূপ নতুন সনের সঙ্গে হিজরি সনের আরবি মাসগুলোর স্থলে যে যে অঞ্চলে এ সন গেলো সে সে অঞ্চলে প্রচলিত মাস তাতে সংযোজিত হয়। এক তথ্য হতে জানা যায়, হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই যে অঞ্চলে এই নতুন সন গেল সেই অঞ্চলে মুহররমে যে মাস ছিল সেই মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। এই নতুন সন প্রর্বতনের বছরেই আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবা বাংলায় তা চলে আসে। তখন এখানে মুহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই। এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। শকাব্দের নববর্ষ আসে চৈত্র মাসে, আর সেই চৈত্র মাস হয় নতুন সনের দ্বাদশ মাস। এই নতুন সন বাংলাদেশে এসে বাংলা সন নামে অভিহিত হয়। এই বাংলা সনের সঙ্গে শকাব্দের যে মাসগুলো সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের নামে, যেমন: বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রাবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্রমাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস, চৈত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস। এখানে উল্লেখ্য, বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণের নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্র বৎসর। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নববর্ষ সূচিত হতো হেমন্তকালের যে মাসটিতে সেই মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। এই মাস অঘ্রাণ উচ্চারণে যশোর, খুলনাসহ কয়েকটি অঞ্চলে উচ্চারিত হয়। এক সময় নবান্নের আনন্দ বৈভব মেখে হেমন্তকালে নববর্ষ আসতো এক বিশেষ আমেজে।
বাংলা সনের উৎপত্তি ইসলামী উৎস থেকে। এ যে হিজরি সনেরই সৌররূপ এবং মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমীর ফতেহুল্লাহ্ সিরাজী কর্তৃক হিজরি সনকে সৌর গণনায় এনে একটি নতুন সনে পরিণত করা হয়। সে সম্পর্কে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে সভাপতি করে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘের সুপারিশমালার প্রারম্ভে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশমালার প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছে যে, মুঘল আমলে বাদশা আকবরের সময় হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত করা হয়েছিল তা থেকে বছর গণনা করতে হবে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত উক্ত কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার কিছু কিছু সংস্কার করা হয়। বাংলা সনের মাসগুলো যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক দিবসের হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়, তা ভেবে বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ থেকে বাংলা সনের পঞ্চম মাস ভাদ্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩১ দিনে হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং একইভাবে ষষ্ঠ মাস আশ্বিন থেকে দ্বাদশ মাস চৈত্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩০ দিনে হওয়ার কথা বলা হয়। লিপইয়ার বা অধিবর্ষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অধিবর্ষ বা লিপইয়ারের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। আরো বলা হয় যে, ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য তা অধিবর্ষ বা লিপইয়ার বলে গণ্য হবে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে সংস্কারকৃত বাংলা সন আশির দশকে এসে সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে। বাংলা সনের উদ্ভাবক আমীর ফতেহুল্লাহ্ সিরাজী আর এর সংস্কারক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। বাংলা সন বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সন। এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস ইসলামী উত্তরাধিকার সঞ্জাত। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্যগত অনুভব।
হিজরি চান্দ্রসনকে সৌরসনের হিসাবে এনে বাংলা সনের উদ্ভব হলেও এর প্রত্যেক মাসেই যে বিভিন্ন তিতির সম্পর্ক রয়েছে তা চাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চান্দ্র মাসের হিসাবে রয়েছে ৩০টি তিথি। এই তিথিগুলো দুই পক্ষে বিভক্ত আর তা হচ্ছে শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। এই পক্ষগুলোতে রয়েছে অমাবস্যা, প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্মী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী ও চতুর্দশী, রয়েছে পূর্ণিমা। পূর্ণিমার চাঁদের জ্যোৎস্নায় বিধৌত হয়ে বাংলার প্রকৃতি এক অনাবিল আনন্দ বিভায় বিম্বিত হয়।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সর্বপ্রাচীন সন হচ্ছে হিজরি আর এই হিজরি সন থেকেই বিকশিত হয়েছে বাংলা সন। তাই হিজরি সনের সঙ্গে যেমন বাংলা সনের সম্পর্ক সুনিবিড়, তেমনি এই দুটি সনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কও সুনিবিড়।
লেখক: মুফাস্সিরে কুরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।